কৃষকের খরচ কমিয়ে আনতে গত এক দশকে সারের মূল্য কমানো হয়েছে পাঁচবার। আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর চাপ উপেক্ষা করে অব্যাহত রাখা হয়েছে ভর্তুকি। গত এক যুগে শুধু সারেই প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। ভর্তুকি নিয়ে সরকারের এ ভালো নীতির সুফল পাচ্ছে দেশের কৃষি খাত। বেড়েছে শস্যের উৎপাদন, কমেছে কৃষকের খরচের চাপ।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশে বিভিন্ন শস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় দেড় কোটি টন, যা এখন বেড়ে ৭ কোটি ১৫ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। যদিও এ সময়ের ব্যবধানে কমেছে কৃষিজমির পরিমাণ।
বাংলাদেশকে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা প্রদানে ২০১১-১২ অর্থবছরে বেশকিছু শর্ত দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তাদের দেয়া শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল ভর্তুকি কাঠামোতে পরিবর্তন এনে বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকি কমানো। কিন্তু আইএমএফের চাপ উপেক্ষা করে সারে ভর্তুকি অব্যাহত রেখেছে সরকার। গত এক দশকে পাঁচ দফা কমিয়েছে সারের মূল্য।
দাম কমিয়ে ৮০ টাকার টিএসপি সার ২২, ৭০ টাকার এমওপি সার ১৫ ও ৯০ টাকার ডিএপি সার ১৬ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে।
সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বর মাসেই কমানো হয়েছে ডিএপি সারের দাম। আগে এ সারের কেজিপ্রতি মূল্য ছিল ২৫ টাকা। এখন তা ৩৬ শতাংশ কমিয়ে ১৬ টাকা করা হয়েছে। ডিলার পর্যায়ে বর্তমান ২৩ টাকার পরিবর্তে ১৪ টাকা কেজিতে ডিএপি সার কিনতে পারছেন কৃষক। এতে ডিএপি সারে সরকারের বছরের প্রণোদনা বাবদ খরচ হবে ৮০০ কোটি টাকা। সারে সরকারের এ ভর্তুকি সহায়তা কার্যক্রম শস্যের উৎপাদন বাড়াতে সহায়ক হচ্ছে।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান নীতিই হলো কৃষকের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার পাশাপাশি সারের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করা। কৃষকের পাশে থাকতে পারলেই দেশের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব। সে বিবেচনায় সারের দাম কমানোর মাধ্যমে ভর্তুকি সহায়তা বাড়াতে সরকার কখনই কার্পণ্য করে না। সামনের দিনেও সারের দাম সহনীয় রাখতে কৃষকবান্ধব নীতিতে অটল থাকবে সরকার। কৃষিপণ্যের বিপণন ও প্রক্রিয়াজাতে ভর্তুকি বাড়ানোসহ এর আওতা আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।
২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ৬৫ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকার ভর্তুকি সহায়তা দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে সার বাবদ ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৫৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৭ হাজার কোটি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে সারে। সব মিলিয়ে গত ১২ বছরে শুধু সারেই প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়া হয়েছে।
সারের ভর্তুকি কার্যক্রমের কারণে পাঁচটি শস্যের ক্ষেত্রে গ্রস মার্জিন বা মোট আয় কী পরিমাণ হচ্ছে এবং ভর্তুকি না থাকলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াত—এ দুইয়ের পার্থক্য উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায়। ‘বিল্ডিং রেজিলেন্স অ্যান্ড কমপিটিটিভনেস অ্যালং ভ্যালু-চেইনস ইন এগ্রি-ফুড সিস্টেম’ শীর্ষক ওই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ভর্তুকি ছাড়া প্রতি হেক্টরে ভুট্টায় কৃষকের মোট আয় (গ্রস মার্জিন) হতো ২৯৮ ডলার, যা ভর্তুকির কারণে ৪১২ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ফলে ভর্তুকিতে প্রায় ১১৪ ডলার বাড়তি আয় করতে পারছেন কৃষক। সয়াবিনের ক্ষেত্রে ভর্তুকি বাদে প্রতি হেক্টরে কৃষকের মার্জিন হতো ৫৩ ডলার, যা ভর্তুকির কারণে ২৩৮ ডলার পাচ্ছেন কৃষক। ফলে প্রায় ১৮৫ ডলার বাড়তি আয় করতে পারছেন কৃষক।
আমন ধানের ক্ষেত্রে ভর্তুকি বাদে প্রতি হেক্টরে কৃষকের আয় হতো ৪০ ডলার, যা বর্তমানে ১১৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। এতে প্রায় ৭৪ ডলার বাড়তি আয় হচ্ছে। আউশ ধানের ক্ষেত্রে ভর্তুকি বাদে প্রতি হেক্টরে কৃষকের মার্জিন হতো ৫৩ ডলার, যা বর্তমানে ১২৬ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ফলে ভর্তুকির কারণে প্রায় ৭৩ ডলার বাড়তি আয় করতে পারছেন কৃষক। তবে বোরো ধানে ভর্তুকি না দিলে মোট ক্ষতি হতো ১৭১ ডলার। ভর্তুকির কারণে মোট ক্ষতি ৭১ ডলারে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ফলে মোট ক্ষতি ১০০ ডলার পর্যন্ত কমানো যাচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫৬ লাখ ১০ হাজার টন। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট রাসায়নিক সারের চাহিদা নিরূপণ হয় ৫৯ লাখ ৩৪ হাজার টন। এর মধ্যে ইউরিয়া ২৬ দশমিক ৫০ লাখ টন, টিএসপি ৭ দশমিক ৫০ লাখ, ডিএপি ৯ লাখ, এমওপি ৮ দশমিক ৫০ লাখ ও এমএপি শূন্য দশমিক ৫০ লাখ টন। এছাড়া অন্যান্য রাসায়নিক সারের মধ্যে জিপসাম ৪ লাখ টন, জিংক সালফেট ১ লাখ ৩৩ হাজার, অ্যামোনিয়াম সালফেট ১০ হাজার, ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ৮০ হাজার ও বোরন ৪১ হাজার টন। অন্যদিকে এনপিকেএস ৭০ হাজার টন নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব সারের বাজারমূল্য থেকে অনেক মূল্যে সারের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সরকার ভর্তুকি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।