Category Archives: Blog

  • অর্থনৈতিক সংকট ও করোনা মহামারির প্রভাবে গত কয়েক বছর কোরবানির পশুর চাহিদা ছিল কম। গত বছরও দেশের গবাদি পশু দিয়েই কোরবানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। এ বছর চাহিদা...

  • ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার বলরামপুর গ্রামের কৃষক মো. আলী রাজ (হাসেম আলী)। প্রতিবছর তিনি কোরবানি দেন। এবার কোরবানি ছাড়াও ঈদের পরদিন রয়েছে একমাত্র কন্যার বিয়ের অনুষ্ঠান। আয়োজন বড় না হলেও আত্মীয়-স্বজনরা...

  • দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি উপকূলীয় জেলায় একসময় প্রচুর কৃষিজমি ছিল। এর মধ্যে সাতক্ষীরা রয়েছে। কিন্তু গত চার দশকে এই জেলায় ৬০ হাজার হেক্টর চাষযোগ্য জমি কমেছে। তিন ফসলি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে...

  • দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান শস্যে পরিণত হয়েছে বোরো ধান। মোট উৎপাদিত চালের অর্ধেকই জোগান দেয় বোরো। বোরোতে এই সাফল্যই বিশ্বে তৃতীয় শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশের অবস্থান এনে দিয়েছে বাংলাদেশকে। অথচ সেই বোরো চাষেই আয়ের দিক থেকে কৃষকের অর্জন শূন্য। লাভ দূরে থাক, উল্টো নিয়মিত গুনতে হচ্ছে লোকসান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বোরো ধানে কৃষকের লোকসানের অন্যতম কারণ এতে উৎপাদন খরচ বেশি। আউশ-আমনে সেচ খরচের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু বোরোতে সেচের পেছনে বড় অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয় কৃষককে। খরচ বেশি হলেও সে তুলনায় ধানের দাম পান না কৃষক। ফলে গুনতে হয় লোকসান। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে গত বোরো মৌসুমে প্রতি মণ ধান ১ হাজার ৪০ টাকায় কেনার ঘোষণা দিয়েছিল খাদ্য অধিদপ্তর। কিন্তু ধান সংগ্রহ কার্যক্রমে গড়িমসির কারণে সরকার ঘোষিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে ফড়িয়াদের কাছে ধান বিক্রি করতে হয়েছে কৃষককে। হাওড়ের সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদনকারী জেলা সুনামগঞ্জের কৃষকরা জানান, অঞ্চলভেদে প্রতি মণ ধান উৎপাদনে ৭০০-৮৫০ টাকা খরচ হলেও ওই ধান বিক্রি করতে হয়েছে মাত্র ৬০০-৭৫০ টাকায়। এতে উৎপাদন খরচ তো ওঠেইনি উল্টো গুনতে হয়েছে লোকসান। শুধু সুনামগঞ্জ নয়, একই চিত্র ছিল দেশের প্রায় সব জায়গায়। এদিকে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, প্রতি হেক্টর বোরো আবাদে কৃষকের এখন ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৬ হাজার ৩৫ টাকা। তবে আউশ ও আমনে লাভের মুখ দেখছে কৃষক। প্রতি হেক্টর আউশ আবাদে কৃষকের মুনাফা হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার ৭১০ টাকা। অন্যদিকে আমন ধানে মুনাফা হচ্ছে ৯ হাজার ৬৯০ টাকা। ‘প্রমোটিং এগ্রি ফুড সেক্টর ট্রান্সফরমিং ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদন তৈরিতে সারজেন্ট অ্যান্ড গ্রাফহামের ‘বিল্ডিং রেজিল্যান্স অ্যান্ড কম্পিটেটিভনেস এলং ভ্যালু-চেইনস ইন এগ্রি ফুড সিস্টেম’ শীর্ষক গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যে গবেষণাটি মূলত বিশ্বব্যাংকের ‘এগ্রিকালচার স্ট্র্যাটেজিস ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ফুড প্র্যাকটিস’ শীর্ষক গবেষণার ব্যাকগ্রাউন্ড পেপার হিসেবে ছিল। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, প্রতি হেক্টর বোরো আবাদে কৃষকের গড় ফলন ধরা হয়েছে প্রায় চার হাজার কেজি। প্রতি কেজি ধানের দাম ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ টাকা। ফলে প্রতি হেক্টর বোরো আবাদে কৃষকের মোট আয় হয় ৫৬ হাজার ১৫ টাকা। এর বিপরীতে কৃষকের খরচ হচ্ছে প্রায় ৬২ হাজার ৫০ টাকা। এসব খরচের মধ্যে বীজে ৩ হাজার ৪৮৫ টাকা, সারে ৭ হাজার ৫৬৫ টাকা, কীটনাশক ও বালাইনাশকে ৩ হাজার ৯৯৫ টাকা, কৃষিযন্ত্র বাবদ ৮ হাজার ১৬০ টাকা, সেচে ১০ হাজার ৩০ টাকা, ভাড়া করা শ্রমের খরচ ২৩ হাজার ৯৭০ টাকা এবং নিজেদের পরিবারের শ্রম খরচ ৪ হাজার ৭৬০ টাকা ধরা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, নিজেদের পরিবারের শ্রম খরচ বাদ দিলে কৃষকের আয় ও ব্যয় অনেকটাই সমান সমান। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বে খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে বলে বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থা শঙ্কা প্রকাশ করলেও বাংলাদেশের দানাদার খাদ্যশস্য বিশেষ করে চালের উদ্বৃত্ত উৎপাদন হবে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। সংস্থাটি এও বলেছে, চলতি বছরে প্রথমবারের মতো চাল উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়াকে টপকে তৃতীয় স্থানে চলে আসবে বাংলাদেশ। দেশের এ অর্জনে বড় অবদান রাখবে শুধুই বোরো আবাদ। যে বোরো দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও বৈশ্বিক সুনাম অর্জন ও বৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখছে, সেই ধান আবাদে কৃষক লোকসান গুনছে কেন? মুনাফা না হলেও কেনই বা তারা বোরো আবাদ করছে? এসব প্রশ্নের জবাবে সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বণিক বার্তাকে বলেন, বোরোতে সেচের খরচ এবং শ্রমিক খরচ অত্যধিক বেশি হওয়ার কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমানো যাচ্ছে না। পাশাপাশি অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি তো আছেই। মূলত তিনটি কারণে বোরো ধান থেকে কৃষক সরতে পারছে না।  প্রথম কারণটি হচ্ছে, নিজের নিত্য চালের চাহিদা মেটাতে ধান উৎপাদন ধরে রাখতে চায় কৃষক। এই শস্য আবাদ করলে স্বল্প সময়ে বাড়তি চাল উৎপাদন করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, ধান বিক্রি করে নিশ্চিত নগদ অর্থ ঘরে আসে। কেজিপ্রতি ধানের দাম কিন্তু খুব বেশি পার্থক্য হয় না। তৃতীয় কারণটি হলো বেশির ভাগ কৃষকের দ্বিতীয় কোনো অপশন নেই। বিশেষ করে হাওড় অঞ্চলের কৃষকরা মূলত একটি ধান করতে পারে। তিনি বলেন, ধানের দাম না বাড়িয়ে ভোক্তা সন্তুষ্ট রাখতে হলে সেচে ভর্তুকি বাড়ানো এবং যান্ত্রিকীকরণ বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে হবে। কৃষিকে লাভজনক না করতে পারলে কৃষকের পরবর্তী প্রজন্ম কৃষিতে থাকতে চাইবে না। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে গত অর্থবছরে প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে বোরো আবাদ হয় ৪৮-৪৯ লাখ হেক্টরে, যা মোট ধান আবাদের প্রায় ৪২ শতাংশ। অন্যদিকে আমনের আবাদ হচ্ছে ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে এবং আউশের আবাদ হয় ১১-১২ লাখ হেক্টরে। অন্যদিকে গত অর্থবছরে ৩ কোটি ৮৮ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বোরোতে ২ কোটি ৪ লাখ টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এরই মধ্যে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়ার পথে রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে কিছুটা ক্ষতি হলেও লক্ষ্যমাত্রা থেকে বিচ্যুতির আশঙ্কা কম। ফলে বোরো আবাদের মাধ্যমে মোট চালের চাহিদা পূরণ হবে প্রায় ৫০ শতাংশ। বোরোতে কৃষকের আয় না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সচিব মো. নাসিরুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা জেনেছি আউশ, আমন ও বোরো এ তিনটি ধানের মধ্যে কৃষককে সবচেয়ে কম মুনাফা দিচ্ছে বোরো ধান। তবে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনটি এখনো আমরা পাইনি। বোরোতে মুনাফা কম দিচ্ছে এমন বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে ধানের আবাদকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। বোরো আবাদ থেকে সরে আউশ ও আমনে জোর দিতে প্রণোদনাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। আবার আমন ও বোরোর মাঝখানে একটি স্বল্পমেয়াদি বাড়তি শস্য আবাদ করতে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। বোরোর পরিবর্তে রবি মৌসুমে অন্যান্য অর্থকরী ফসল ও আমদানিনির্ভর শস্য আবাদে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করতে অর্থায়ন ও উপকরণ সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। এটির ফলও আমরা এরই মধ্যে পেয়েছি। তবে সেটি ধীরে হলেও সামনের দিনে তা আরো গতি পাবে। গতি পাওয়ার আগ পর্যন্ত চালের উৎপাদন ঠিক রাখতে আমরা বোরো আবাদে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমানোয় নজর দিচ্ছি। বিশেষ করে সেচ ও বীজের দাম কমানো হয়েছে। পাশাপাশি সারের দামও কমানো হয়েছে। এছাড়া যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষকের শ্রম খরচ কমানো হচ্ছে। কৃষিতে নতুন মডেল সিনক্রোনাইজড আবাদ পদ্ধতি চালুর মাধ্যমে সার্বিক উৎপাদন খরচ অনেক কমিয়ে আনতে পারব।

  • এক দুধকালে একটি গাভী গড়ে আড়াই হাজার কেজি দুধ দেয়। এটি বৈশ্বিক গড়। কিন্তু বাংলাদেশে একটি গাভী দুধ দেয় গড়ে ২০৫ কেজি। একই অবস্থা মাংসের উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রেও। সারা বিশ্বে যেখানে প্রতিটি গরু থেকে গড়ে ২২০ কেজি মাংস উৎপাদন হয়, সেখানে বাংলাদেশে পাওয়া যায় ৭২ কেজিরও কম। শুধু দুধ বা মাংস উৎপাদন নয়, প্রাণিসম্পদ খাতের প্রায় সব ক্ষেত্রেই উৎপাদনশীলতায় বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে উন্নত দেশ তো বটেই, এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়েও উৎপাদনশীলতা কম বাংলাদেশের। বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত জাত না আসায় গাভীর দুধ উৎপাদন সক্ষমতা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। একই কারণে পিছিয়ে দুধ-মাংসের উৎপাদনশীলতাও। শুধু ভালো জাত না থাকার কারণে বেশি পরিমাণে খাদ্য দিয়েও কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ দুধ ও মাংস পাওয়া যাচ্ছে না। উন্নত বিশ্বে যেখানে সাড়ে তিন থেকে চার কেজি খাদ্য দিলে এক কেজি মাংস উৎপাদন করতে সক্ষম, সেখানে বাংলাদেশের গরুকে দিতে হয় সাত থেকে সাড়ে আট কেজি খাদ্য। এতে খরচ বাড়লেও সে অনুযায়ী লাভবান হতে পারছেন না খামারিরা। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক ও একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, সারা বিশ্বে প্রাণিসম্পদ খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার যে হারে এগিয়েছে তার ধারেকাছেও যেতে পারেনি বাংলাদেশ। আমাদের কৃষক ও খামারিরা প্রযুক্তি বাস্তবায়নে পরিপূর্ণ দক্ষ না হলেও প্রযুক্তি গ্রহণে খুব আগ্রহী। কিন্তু আমরা সেই প্রযুক্তি দিতে পারছি না। বিশেষ করে পশুর জাত উন্নয়নে অনেক পিছিয়ে গেছি। এখনো প্রাচীন একটি ব্রিড নিয়েই গরু মোটাতাজা করে যাচ্ছি। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও খাদ্যের মানে রয়েছে অনেক ঘাটতি। পশুগুলো এখনো পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না। আবার একজন পশু চিকিৎসক বা ডাক্তারকে কয়েক লাখ পশু-প্রাণীকে সেবা দিতে হয়। ফলে সেবার মানে থেকে যাচ্ছে ঘাটতি। ফলে উন্নত ব্রিড না থাকা, খাদ্য ও চিকিৎসাসেবার মানে পিছিয়ে থাকার কারণেই প্রাণিসম্পদের উৎপাদনশীলতায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি। প্রাণিসম্পদের উৎপাদনশীলতায় বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদনেও। এফএওস্ট্যাটের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিটি গরু থেকে গড় মাংস উৎপাদন হচ্ছে ৭১ দশমিক ২০ কেজি, যেখানে বৈশ্বিক গড় ২১৯ দশমিক ৩৬ কেজি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানে ১৯৬ কেজি, শ্রীলংকায় ১৩৭ কেজি এবং ভারতে ১০৩ কেজি মাংস উৎপাদন হয় প্রতিটি গরু থেকে। দেশে প্রতিটি ছাগল থেকে গড়ে সাত কেজি করে মাংস পাওয়া গেলেও এক্ষেত্রে বৈশ্বিক গড় ১২ দশমিক ৩২০ কেজি। যদিও আফগানিস্তানে একটি ছাগল থেকে গড়ে ১৩ কেজি, শ্রীলংকায় ২০ কেজি এবং পাকিস্তানে ১৭ দশমিক ১৮ কেজি মাংস পাওয়া যায়। অন্যদিকে দেশে প্রতিটি মুরগির মাংস দিচ্ছে গড়ে এক কেজির নিচে বা প্রায় ৭০০ গ্রাম, যেখানে বৈশ্বিক গড় ১ কেজি ৬৪০ গ্রাম। আবার প্রতিটি হাঁস থেকে মাংস পাওয়ার বৈশ্বিক গড় ১ কেজি ৪৯০ গ্রাম হলেও বাংলাদেশে পাওয়া যায় প্রায় এক কেজি। ডিমের ক্ষেত্রেও অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে প্রতিটি মুরগি গড়ে ২ দশমিক ১৯ কেজি ডিম দেয়। যদিও এক্ষেত্রে বৈশ্বিক গড় ১০ দশমিক ৪ কেজি। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতে একটি মুরগি থেকে প্রায় ১৩ কেজি এবং শ্রীলংকায় ১২ দশমিক ২২ কেজি ডিম পাওয়া যায়। এ বিষয়ে এসিআই অ্যানিমেল হেলথের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. ফা হ আনসারী বলেন, মাংস ও দুধের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে খামারিদের খরচ কমানোর একটি সম্পর্ক রয়েছে। উৎপাদনশীলতা বাড়ানো গেলে কম খরচে ভোক্তাকে দুধ ও মাংস সরবরাহ সম্ভব হবে। তখন খামারিরাও লাভবান হতে পারবেন। কিন্তু গরুর জাত উদ্ভাবনে দেশে ৩৫ বছরের আগের সেই ব্রিড নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। অনেক পশুই এখন ইনব্রিড শুরু হয়ে গেছে। আর এ কারণেই মাংস বা দুধ উৎপাদনক্ষমতা কমে গেছে। অথচ উন্নত বিশ্বে জাত উদ্ভাবনে প্রতিনিয়তই গবেষণা এবং নতুন নতুন সিমেন দিচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি অ্যামব্রায়ো সম্প্রসারণ করছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে রয়েছে। আবার দুধ ও মাংস বিপণনের ক্ষেত্রে খামারিদের নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে না। খাদ্য সরবরাহে যেমন সংকট রয়েছে, তেমনি খামারি পর্যায়ে ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটিও রয়েছে। ফলে খামারিদের আরো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দুধ: গরুর দুধের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এখানে প্রতিটি গরু গড়ে ২০৫ দশমিক ৩২ কেজি দুধ দিচ্ছে। যদিও এক্ষেত্রে বৈশ্বিক গড় ২ হাজার ৪৪৯ দশমিক ১২ কেজি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতে প্রতিটি গরু গড়ে ১ হাজার ৫৮৮ কেজি, পাকিস্তানে ১ হাজার ২৩০ কেজি, ভুটানে ১ হাজার ৩৮৬ কেজি এবং শ্রীলংকায় প্রায় ৯৭৮ কেজি দুধ দিচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রতিটি ছাগল দুধ দিচ্ছে ৩৮ দশমিক ২৮ কেজি। যদিও বৈশ্বিক গড় ৮৬ দশমিক ৭০ কেজি। ভারতের ছাগল দিচ্ছে প্রায় ১৬৭ কেজি দুধ। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) কেন্দ্রীয় মহাসচিব মো. শাহ এমরান বণিক বার্তাকে বলেন, ভারতের একজন খামারি প্রতিটি গাভী থেকে ২০ কেজির বেশি দুধ পাচ্ছেন। আর আমরা পাচ্ছি মাত্র ছয়-আট কেজি। আবার ওরা উৎপাদনে কম খরচ করলেও আমাদের দ্বিগুণের বেশি খরচ করতে হচ্ছে। ফলে খামারিরা কোনোভাবেই দুগ্ধ শিল্পে লাভবান হতে পারছেন না। এর পেছনে সরকারের নীতিসহায়তার ভীষণ দুর্বলতা রয়েছে। দেশে দুধের উৎপাদন বাড়তির দিকে থাকলেও আমদানিকে অবারিত করে রাখা হয়েছে। ফলে খামারিরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। আবার উন্নত গাভীর জন্য সিমেন আমদানি বা অ্যামব্রয়ো পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করা হচ্ছে না। অন্যদিকে খামারিদের এখনো বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল ও জমির খাজনা দিতে হচ্ছে বাণিজ্যিক রেটে। ফলে তারা উৎপাদনশীলতা যেমন বাড়াতে পারছেন না, তেমনি খরচও কমাতে পারছেন না। উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণনসহ প্রক্রিয়াকরণের প্রতিটি পর্যায়ে এখনো পদক্ষেপ না নিলে দেশের দুগ্ধ খাত আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (ডিএলএস) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ৪০ কোটি ২৫ লাখ ৬৩ হাজার গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি উৎপাদন হয়েছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩৯ কোটি ৩১ লাখ ৩১ হাজার। উৎপাদনশীলতা ভালো না থাকার কারণে প্রাণিসম্পদের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি খুব বেশি জোরালো হচ্ছে না। দেশের খামারিরা প্রতিদিন প্রায় ৪ কোটি ৬৮ লাখ পিস ডিম উৎপাদন করছেন। ডিমের মোট উৎপাদনে ভালো উল্লম্ফন থাকলেও এখানেও ঘাটতি রয়েছে উৎপাদনশীলতায়। চাহিদার সমান মাংসের উৎপাদন হলেও দুধের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৫৩ লাখ টন। ঘাটতির কারণে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ হাজার ৮২১ কোটি টাকার দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য আমদানি হয়েছে।

  • দুই দশক আগেও গ্রামীণ পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস ছিল শস্য খাত। সে সময় মোট গ্রামীণ আয়ে শস্য খাতের অবদান ছিল প্রায় এক-চতুর্থাংশ। এর পরেই অবস্থান ছিল ছোটখাটো ব্যবসা বা ক্ষুদ্র উদ্যোগের। একই সঙ্গে বড় হতে থাকে অকৃষিজ সেবা ও রেমিট্যান্স খাতের অবদানও। ফলে বর্তমানে এসে দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ পরিবারের আয়ে শস্য খাতের অবদান নেমে এসেছে অর্ধেকেরও নিচে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামীণ পরিবারগুলোয় এখন শস্যনির্ভর কর্মসংস্থান অনেক কম হচ্ছে। এর বিপরীতে বেড়েছে কৃষিজ ও অকৃষিজ কর্মসংস্থান। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও ছোট ব্যবসা, যান্ত্রিকীকরণ, বিপণনসংশ্লিষ্ট নানা কার্যক্রমের অবদান এখন বেড়েছে। একই সঙ্গে গ্রামীণ কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে মত্স্য, প্রাণী ও বনায়নের মতো শস্যবহির্ভূত উপখাতও। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে কৃষি খাতে মোট কর্মসংস্থানের হার ৪০ শতাংশ। ২০০০ সালেও দেশের গ্রামীণ পরিবারগুলোর আয়ে শস্য খাতের অবদান ছিল ২৫ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তা নেমে এসেছে ১২ শতাংশে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, কিছু যৌক্তিক কারণেই গ্রামীণ মানুষের আয় ও কর্মসংস্থানে শস্য খাত পিছিয়ে পড়েছে। একটি রূপান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অন্য খাতগুলো এগিয়ে আসছে। তবে শস্য খাত মূলত আবহাওয়ানির্ভর হওয়ার কারণে সবসময়ই ঝুঁকিতে থাকে। এছাড়া ফসলের মূল্যের ওঠানামাটাও হয় অনেক বেশি। ফলে কৃষকদের উৎপাদন ও বিপণনসংশ্লিষ্ট নানা ঝুঁকি নিয়ে এ খাতে নিয়োজিত থাকতে হয়। খাদ্য ও আয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাগিদেই তাদের একপর্যায়ে এসে অকৃষিজ কর্মকাণ্ডে ঝুঁকতে হয়। গ্রামীণ কর্মসংস্থান ও আয়ে শস্য খাতের অবদান ধরে রাখতে হলে অবশ্যই আবহাওয়া নির্ভরতা কমাতে হবে জানিয়ে কৃষি অর্থনীতি সমিতির সাবেক এ সভাপতি বলেন, মাটির সংস্পর্শ ছাড়াই কৃষি খাতকে এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ও নীতি গ্রহণ করতে হবে। ক্ষুদ্র জমিকে বৃহদায়তন করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি কৃষির বাণিজ্যিকীকরণের জন্য কারিগরি প্রযুক্তির রূপান্তর ও যান্ত্রিকীকরণকে দ্রুত এগিয়ে নিতে হবে। শস্য খাতে প্রযুক্তি ও জ্ঞানভিত্তিক কৃষির প্রয়োগই সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারে। গ্রামীণ মানুষের আয়ে অকৃষিজ খাতের অবদান এখন দিন দিন বাড়ছে। বিবিএসের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘রিপোর্ট অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল স্ট্যাটিসটিকস ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশের গ্রামীণ পরিবারগুলোর বার্ষিক আয় এখন প্রায় ২ লাখ ২ হাজার ৭২৪ টাকা বা মাসে প্রায় ১৬ হাজার ৮৯৩ টাকা। এর মধ্যে কৃষি এরপর ্ব পৃষ্ঠা ২ কলাম ১ খাত থেকে আসে ৩৮ দশমিক ২১ শতাংশ। বাকি প্রায় ৬১ দশমিক ৭৯ শতাংশ আসে অকৃষি খাত থেকে। বিভাগ অনুসারে কৃষি খাত থেকে আয় সবচেয়ে কম হয় ঢাকা ও সিলেট বিভাগে। এ দুটি বিভাগের বাসিন্দাদের আয়ে কৃষি খাতের অবদান যথাক্রমে ২৮ দশমিক ৮ ও ৩০ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কেএএস মুরশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, গ্রামীণ আয় ও কর্মসংস্থানের এ ধরনের পরিবর্তন দুটো বিষয়ের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। একটি হলো কৃষিতে বহুমুখীকরণ হয়েছে কিন্তু শস্য খাতে এখনো কাঙ্ক্ষিত বহুমুখীকরণ হয়নি। দ্বিতীয়টি হলো শস্য খাতে এখনো বোরো ধানকেন্দ্রিক বিনিয়োগ হচ্ছে, যেটি কিনা খুব বেশি মুনাফা দিতে পারছে না। কৃষি খাতে রূপান্তর প্রক্রিয়া দ্রুত আনতে না পারলে এ খাতের ক্রমহ্রাসমান প্রবৃদ্ধির চিত্র আরো খারাপের দিকে যেতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, প্রথাগত কৃষি থেকে আধুনিক কৃষিতে যেতে হবে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি সক্ষম করে তুলতে হবে শস্য খাতকে। এজন্য বাড়তি বিনিয়োগ ও আর্থিক প্যাকেজ সঠিকভাবে দিতে হবে। পাশাপাশি মূল্য সংযোজন ও তারুণ্যনির্ভর কৃষিতে গুরুত্বারোপ করতে হবে। শস্য খাতে এখন মোটামুটিভাবে একটি কাঠামোগত পরিবর্তন খুব প্রয়োজন। এছাড়া সার্বিক কৃষি খাতেও মানহীনতা রয়েছে কর্মসংস্থানের। কৃষিতে বর্তমানে মোট কর্মসংস্থান প্রায় আড়াই কোটি। এর ৩৫ দশমিক ৯০ শতাংশই কাজ করছে পারিবারিক সহায়তাকারী হিসেবে। আত্মকর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৩৩ দশমিক ৫২ শতাংশের। কৃষি শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এ বিষয়ে এসিআই এগ্রি বিজনেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. ফা হ আনসারী বলেন, শস্য খাতের সমসাময়িক প্রতিবন্ধকতাগুলোকে অনুধাবন করতে হবে এবং সে অনুসারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। শস্য বহুমুখীকরণ ও উৎপাদনশীলতায় আমরা এখন অনেকটাই পিছিয়ে। প্রযুক্তি ও যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়া বিকল্প টেকসই কোনো উপায় নেই। এছাড়া প্রতিকূল পরিবেশের উপযোগী প্রযুক্তি ও উৎপাদন কৌশল, হাইব্রিড শস্যের প্রসার, পানিসাশ্রয়ী সেচ পদ্ধতি, সার ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি প্রযোজন। এতে কর্মসংস্থান যেমন বাড়বে, তেমনি কৃষকের আয়ও বৃদ্ধি পাবে। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি রোধে ও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় নতুন জাত, ভূমি ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। জমির উর্বরতাশক্তি ধরে রাখা এবং ফসলের বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।

  • খাদ্য ও কৃষিপণ্য আমদানি বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে প্রতি বছর। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, তুলা বাদে অন্যসব খাদ্য ও কৃষিপণ্য আমদানিতে প্রতি বছর ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এর সঙ্গে তুলা আমদানিতে ব্যয়কৃত অর্থ যোগ করলে খাদ্য ও কৃষিপণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের বার্ষিক ব্যয় দাঁড়ায় ৮০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। প্রতি বছর শুধু খাদ্যশস্য আমদানিতেই বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয় বাংলাদেশকে। ভোজ্যতেল, তেলবীজ, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, ডালবীজ, ফল ও মসলাপণ্যের ক্ষেত্রেও এখনো ব্যাপক মাত্রায় আমদানিনির্ভর রয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। যদিও সঠিক পরিকল্পনাভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এসব পণ্যের আমদানিনির্ভরতা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এফএওর বার্ষিক পরিসংখ্যানে উপস্থাপিত ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দেশে আমদানীকৃত কৃষি ও খাদ্যপণ্যের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক বলছে, এ সময়ে বার্ষিক গড়ে ৭২০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। চলতি বিনিময় হারের ভিত্তিতে রূপান্তরের পর বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশিতে। বিশ্বব্যাংকের উপস্থাপিত এ পরিসংখ্যানের বাইরে তুলা আমদানিকে আমলে নেয়া হলে দেশে খাদ্য ও কৃষিপণ্য আমদানিতে ব্যয় ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও তুলা আমদানিতে সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যানে উপস্থাপিত তথ্য বলছে, তুলার বাইরে অন্যান্য কৃষি ও খাদ্যপণ্যের মোট আমদানি ব্যয়ের অর্ধেকেরও বেশি খরচ হচ্ছে চারটি পণ্য আমদানিতে। এর মধ্যে ভোজ্যতেলেই ব্যয় হচ্ছে ২৬ শতাংশ (পাম অয়েলে ১৬ এবং সয়াবিন ও অন্যান্য ভোজ্যতেল ১০ শতাংশ)। এছাড়া গম ও চিনি আমদানিতে খরচ হচ্ছে মোট আমদানি ব্যয়ের যথাক্রমে ১৪ ও ১১ শতাংশ। এছাড়া মোট ব্যয়ের ৬ শতাংশ শুকনা সবজি আমদানিতে, ৬ শতাংশ চালে ও ৬ শতাংশ সয়াবিন বীজ আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে। পাশাপাশি দুধ ও ক্রিম আমদানিতে ৪ শতাংশ, ভুট্টায় ৩ ও পশুখাদ্যে ৩ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে। এর বাইরেও অয়েল কেক, আপেল ও অন্যান্য ফল, পেঁয়াজ এবং অন্যান্য মসলার প্রতিটিতে ব্যয় হচ্ছে ২ শতাংশ করে। ১ শতাংশ করে ব্যয় হচ্ছে সাতটি পণ্য আমদানিতে। এগুলো হলো সিট্রাসজাতীয় ফল, আটা, ময়দা ও অন্যান্য পণ্য, আদা, জাফরান, হলুদ, ছোলা ও মত্স্যজাত পণ্য। খাদ্য ও কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক হারে আমদানিনির্ভরতা প্রসঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ পুলের সদস্য এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সাবেক মহাপরিচালক হামিদুর রহমান মনে করছেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদনে সক্ষম থাকলেও সে সুযোগ কাজে লাগানো হয়নি বাংলাদেশে। এর ফলে আমদানিনির্ভরতা বৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপও বেড়েছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দানাদার খাদ্যশস্য ছাড়াও অন্যান্য শস্যের উৎপাদন বাড়িয়ে শস্যের বহুমুখীকরণ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিচ্ছে। কয়েক বছর ধরেই চালে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পাশাপাশি উদ্বৃত্ত উৎপাদনও হচ্ছে। সে অর্জনকে সামনে নিয়ে দেশে কৃষিপণ্যের উৎপাদন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। কৃষি মন্ত্রণালয় বর্তমানে তেল ও ডালজাতীয় শস্যের আবাদ বৃদ্ধিতে কাজ করছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, এজন্য বোরো ও আমন মৌসুমে আরো উচ্চফলনশীল জাতের ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে সময়কাল কমিয়ে আনা হচ্ছে। এতে কয়েক লাখ হেক্টর জমি বেরিয়ে আসবে। তখন এসব জমিতে তেল ও ডালজাতীয় শস্য আবাদ করা সম্ভব হবে। আবহাওয়াগত বিষয় থাকায় গম উৎপাদন সে হারে না বাড়লেও উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগানো হচ্ছে। মসলাজাতীয় শস্যের আবাদ এলাকা এরই মধ্যে বাড়ানো হয়েছে। সেজন্য স্বল্প সুদে কৃষককে ঋণ দেয়ার পাশাপাশি উদ্ভাবিত বিভিন্ন নতুন জাত কৃষকদের মধ্যে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। সম্প্রসারণকর্মীরা মাঠ পর্যায়ে আমদানিনির্ভর ফসল আবাদে কৃষকদের উৎসাহ ও পরামর্শ দিচ্ছেন। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১২ লাখ টন গম উৎপাদনের বিপরীতে আমদানি হয়েছে প্রায় ৫৭ লাখ টন। উৎপাদনে একধরনের স্থবিরতা থাকায় গম আমদানিতে ব্যয় ছাড়িয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। একই অবস্থা ভোজ্যতেল ও তেলবীজেও। এ দুই ধরনের পণ্যের চাহিদার সিংহভাগই পূরণ করতে হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে। এসব পণ্য আমদানিতে প্রতি বছর বেরিয়ে যাচ্ছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে দেশে ডালশস্যের চাহিদার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পূরণ হচ্ছে স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে। এ চাহিদা প্রতিনিয়ত বেড়ে চললেও ডালশস্যের পণ্যের আবাদ কমছে ধারাবাহিকভাবে। ফলে গত ১০ অর্থবছরে ডালজাতীয় পণ্যের আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে গত কয়েক বছরে দেশে দুধের উৎপাদন দ্বিগুণ বেড়ে ৯৯ লাখ টনে উন্নীত হলেও পূরণ হচ্ছে না চাহিদা। এর পরও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রায় ৫০ লাখ টন। ফলে এক্ষেত্রেও একধরনের আমদানিনির্ভরতা থেকেই যাচ্ছে। যদিও সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করলে দেশে উৎপাদনের মাধ্যমেই দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা মেটানো সম্ভব। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ডেইরি ডেভেলপমেন্ট ফোরামের (বিডিডিএফ) সভাপতি অ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম স্মৃতি এমপি বণিক বার্তাকে বলেন, আগামী দুই থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব। এজন্য শুধু তিনটি কাজ করতে হবে। প্রথমত গুঁড়া দুধ আমদানি, বিশেষ করে বাল্ক ফিল্ড মিল্ক আমদানিতে শুল্কহার বাড়াতে হবে। দেশেই গুঁড়া দুধের প্ল্যান্ট তৈরিতে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। দ্বিতীয়ত এ শিল্পের বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, জমির খাজনাকে বাণিজ্যিকের আওতা থেকে কৃষি খাতের আওতায় আনতে হবে এবং খামারিদের দুধ সংগ্রহ ও বাজারজাতের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার জন্য ২০ বছর আয়কর রেয়াত সুবিধার পাশাপাশি ভালো জাত উন্নয়ন, পশুখাদ্য ও চিকিৎসা সুবিধা সম্প্রসারণ করতে হবে। বর্তমান সরকার এসব বিষয় বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে।

  • দেশের বেসরকারি পাটকলগুলো মুনাফায় থাকলেও ক্রমাগত লোকসানেই চলেছে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) অধীন সরকারি পাটকলগুলো। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও বিজেএমসির অধীন পাটকলগুলো লোকসান দিয়েছে প্রায় ৫৭৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু শ্রমিক আন্দোলন থামাতেই ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬৬ কোটি টাকা। পরিসংখ্যান বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র তিনবার মুনাফার দেখা পেয়েছে বিজেএমসি। এর মধ্যে সর্বশেষ ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল সংস্থাটি। এর পর থেকে প্রতি বছর ক্রমাগত লোকসানেই রয়েছে সংস্থাটি। এ বিপুল পরিমাণ ক্ষতির জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর অব্যবস্থাপনা ও পরিচালনাগত অদক্ষতাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয়, ব্যয় ও লোকসানের পরিসংখ্যান (প্রভিশনাল) এবং লোকসানের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিজেএমসি দেখিয়েছে, এ সময় বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক আন্দোলন থামানো ও গেট মিটিং পরিচালনায় সংস্থাটির ব্যয় হয়েছে ৬৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, যা মোট লোকসানের প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ। এছাড়া সিবিএ কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যয় হয়েছে ৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা, যা মোট লোকসানের দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত দুই বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়ন বা কারখানাগুলোর আধুনিকায়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া শ্রমিকদের জন্য কোনো বরাদ্দ বা সহযোগিতার কোনো অর্থও দেয়া হয়নি বলে দাবি তাদের। একই সঙ্গে আন্দোলন থামাতে শ্রমিকদের কোনো অর্থ দেয়া হয়নি বলেও জানিয়েছেন তারা। এ বিষয়ে খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিলের প্রকল্প প্রধান কামরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, শ্রমিক আন্দোলন থামাতে শ্রমিকদের অর্থ প্রদানের প্রশ্নই ওঠে না। আমরা গত কয়েক বছরে শুধু কারখানার নিয়মিত পরিচালনা ঠিক রাখার জন্য কিছু যন্ত্রাংশ মেরামত করেছি। কিন্তু নতুন কোনো যন্ত্র বসানো হয়নি। আধুনিকায়ন কিংবা এ ধরনের কোনো বিনিয়োগ এ কারখানায় হয়নি। এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বণিক বার্তাকে বলেন, এ ধরনের ব্যয় করার আইনি বৈধতা আছে কিনা, বা থাকলেও কী ধরনের ব্যয়ের স্বাধীনতা আছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ব্যয়কে বিভিন্ন নামে চালিয়ে দেয়ার যে প্রবণতা, সেটি এ ধরনের তথ্যের মাধ্যমে উঠে এসেছে। শ্রমিকদের ঠিকভাবে বেতন দিতে পারে না, অথচ কিছু শ্রমিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা এ ধরনের নামে কিংবা সুবিধাজনক খাত দেখিয়ে অর্থ সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে শ্রমিকদের উন্নয়নে যে অর্থ সরকার দিচ্ছে, সেটি আসলে তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরেই এ ধরনের অনৈতিক ব্যয় ও খরচ দেখিয়ে আসছে কিছু সুবিধাবাদী গোষ্ঠী। তাই বিজেএমসি থেকে কতটুকু কারা কীভাবে সুবিধা নিয়েছে, সেটি দেখার জন্য আন্তর্জাতিক মানের অডিটের মাধ্যমে এগুলো বের করা দরকার। সেটি কারখানা পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হতে হবে। বিষয়টি নিয়ে বিজেএমসি কর্তৃপক্ষ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। বিজেএমসি সূত্রে জানা গেছে, এর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও মোট ৪৯৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছিল বিজেএমসি। অন্যদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লোকসান ৫৭৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। লোকসানের কারণ বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এ সময় কারখানাগুলোয় অতিরিক্ত ৯ হাজার ১৭৭ জন অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োজিত করতে হয়েছে। এজন্য ৪৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে, যা মোট লোকসানের ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ব্যাংকঋণের সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৭৫ দশমিক ১১ কোটি টাকা, যা ক্ষতির ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ। সক্ষমতা অনুসারে উৎপাদন না হওয়ার কারণেই ২০১৮-১৯ অর্থবছর সবচেয়ে বেশি লোকসানে পড়তে হয়েছে সংস্থাটিকে, যার পরিমাণ ৩৩৪ কোটি ৪১ লাখ টাকা বা মোট লোকসানের ৫৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। বিশ্লেষণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট বাবদ ২৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা ক্ষতির কথাও তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সামাজিক দায়বদ্ধতা বাবদ ২২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ের কথা জানানো হয়েছে বিশ্লেষণে। যদিও বিষয়টিতে আপত্তি তুলছেন দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার বেশ কয়েকটি শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। এ বিষয়ে যশোরের কার্পেটিং জুট মিল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বাদশা মিয়া এবং খুলনার প্লাটিনাম জুট মিলের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ন কবির খান বণিক বার্তাকে জানান, সিবিএ অফিস চালানোর জন্য কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক বরাদ্দ তারা পান না। কোনো ধরনের আন্দোলন হলে মিল বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা থেকে তারা নিজ উদ্যোগে শ্রমিকদের বুঝিয়েছেন। টাকার বিনিময়ে কোনো কাজ করেননি। ফলে এখানে অর্থ আসার কোনো প্রয়োজনও নেই। জানা গেছে, বর্তমানে দেশে পাটপণ্য উৎপাদনে বিজেএমসির অবদান মাত্র ৮ দশমিক ২১ শতাংশ। রফতানিতে এ হার আরো কম, ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। নামমাত্র উৎপাদন ও অনুল্লেখ্য রফতানির জন্য সরকারি বাজেট থেকে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকির মাধ্যমে সংস্থাটির মিলগুলোর কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রয়োজনের অধিক শ্রমিক দিয়ে এসব মিল পরিচালনা করা হলেও সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে না পারারও অভিযোগ রয়েছে। ফলে প্রতি বছরই বাড়তে থাকে লোকসানের পরিমাণ। স্বাধীনতার পর অল্প কয়েকবার মুনাফার দেখা পেয়েছে সংস্থাটি। এদিকে অপ্রয়োজন হলেও সংস্থাটির কারখানাগুলোয় প্রতি বছর নিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রচুর শ্রমিক। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও বিজেএমসির কারখানাগুলোয় শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৬২ হাজার ১১৩ জন। প্রয়োজনের অধিক শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হলেও উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়নি। উল্টো তা ছিল বরাবরের মতোই নিম্নমুখী। ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও সংস্থাটির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৬৪১ টন, এর বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৬৯ হাজার ১১১ টন। এ সময় দৈনিক গড় উৎপাদন ছিল ২৪৯ দশমিক ৬২ টন, যা আগের অর্থবছরেও (২০১৭-১৮) ছিল ৪৭০ দশমিক ৫৭ টন।

  • গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) দেশে চাল ও গম আমদানি হয়েছে প্রায় ৬৪ লাখ ৩৪ হাজার টন, যা গত চার দশকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর মধ্যে চালের পরিমাণ খুবই সামান্য। আমদানির সিংহভাগই...

  • ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১১ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) গড়ে প্রতি মাসে ব্যয় হয়েছে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবায়নের হার ছিল গড়ে ৫ দশমিক ২২ শতাংশ। কিন্তু অর্থবছরের শেষ মাসে গিয়ে বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়েছে ব্যয় ও বাস্তবায়নে। জুনে ব্যয় হয়েছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে এডিপিতে মোট ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা, আর বাস্তবায়নের হার ছিল ৮০ দশমিক ২৮ শতাংশ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে এডিপি ব্যয় ও বাস্তবায়নের এসব তথ্য উঠে এসেছে। বার্ষিক প্রতিবেদনটি শিগগির আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার ও ব্যয়ে রেকর্ড গড়েছিল বাংলাদেশ। এ সময়ে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা এবং বাস্তবায়নের হার ছিল ৯৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তবে রেকর্ডের পরের অর্থবছরে এসে বাস্তবায়নে আবারো পতন ঘটে। দুই যুগের বেশি সময় পর বাস্তবায়নের হার সর্বনিম্নে ঠেকে সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে। আইএমইডির সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজ উল্লাহ এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের নিজস্ব কিছু উদ্ভাবনী কর্মসূচির মাধ্যমে ব্যয় ও বাস্তবায়নে রেকর্ড অর্জন করেছিলাম। কিন্তু সংগত কারণেই সেটি ধরে রাখতে পারিনি। তবে আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। করোনার আগেই পরিকল্পনামন্ত্রী বিভাগীয় পর্যায়ে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ও জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক শুরু করেছিলেন। প্রতি মাসে ডিসিদের নিয়ে আমিও বৈঠক করেছি। আইএমইডির মহাপরিচালকরা পিডিদের সঙ্গে প্রতি মাসে কমপক্ষে ছয়টি বৈঠক করতেন। কিন্তু সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের শেষদিকে সাধারণ ছুটির কারণে আমরা কিছুটা পিছিয়ে পড়ি। অর্থবছরের শেষ মাসে অর্থ ব্যয় ও বাস্তবায়নে এমন উল্লম্ফন কতটা যৌক্তিক এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, আমাদের আর্থিক ব্যয়টা সব সময়ই ফিজিক্যাল ব্যয় থেকে কম হয়। সাধারণত বছরের শেষদিকে এসে অর্থ পরিশোধ করতে হয়। তবে তদারকির মাধ্যমে এ দুটি ক্ষেত্রে আরো সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রীর দিকনির্দেশনা এসেছে। উন্নয়ন ও জীবন দুটিকে একসঙ্গে এগিয়ে নিতে যথাসময়ে এডিপি বাস্তবায়ন এবং আরো কার্যকরভাবে অর্থের ব্যবহার নিশ্চিত করতে আমরা নতুন কর্ম-উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১১ মাস পর্যন্ত এডিপিতে মোট ব্যয় ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২১ কোটি টাকা এবং বাস্তবায়নের হার ছিল ৫৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ। তবে অর্থবছর শেষে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ শুধু জুনেই ৪৬ হাজার ১০৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়। যদিও পূর্ববর্তী মাসগুলোতে এটি ছিল খুবই কম। গত অর্থবছরের শেষ ছয় মাসের এডিপি ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, মে মাসে ১৬ হাজার ৫৮১ কোটি, এপ্রিলে ৮ হাজার ১৩৬ কোটি, মার্চে ১০ হাজার ৫৬১ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ১১ হাজার ১৬৩ কোটি, জানুয়ারিতে ১২ হাজার ২৬১ কোটি এবং ডিসেম্বরে ১৫ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বিগত অর্থবছরগুলোয় এডিপি বাস্তবায়ন হার ৯০ শতাংশের বেশি হলেও ২৭ বছর পর এবারই তা ৮০ শতাংশে নামল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। কিন্তু মাঝপথে এসে গত মার্চে বরাদ্দ কমিয়ে সংশোধিত এডিপির আকার নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ১ হাজার ১৯৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ফলে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের আরএডিপির অর্থ ব্যয় হয়নি ৩৯ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা, যা অর্থ মন্ত্রণালয়ের ছাড়ের প্রয়োজন হবে না। যদি অর্থ মন্ত্রণালয় এ অর্থ ছাড়ও করে, তাহলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফেরত চলে যাবে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত অর্থবছর এডিপি বাস্তবায়ন হার কম হওয়ার প্রধান কারণ নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। করোনার কারণে চলতি বছরের ২৬ মার্চ থেকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। মার্চ পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৪৫ শতাংশ। এপ্রিল পর্যন্ত তা বেড়ে হয়েছে ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ এক মাসে মাত্র ৪ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছিল। মে মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ৫৭ শতাংশে উন্নীত হয়। আর বছর শেষে এডিপি বাস্তবায়িত হয় ৮০ শতাংশ। সে হিসেবে এক মাসে ২৩ শতাংশ টাকা খরচ হয়েছে। টাকার অংকে ৪৬ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। এর আগে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়েছে ৩৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম আট মাসে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ব্যয় করতে পেরেছে ৭৯ হাজার ৭৮৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। নয় মাসে অর্থাৎ মার্চ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছিল ৯০ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের হার ছিল ৪৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বা এপ্রিল পর্যন্ত যা ছিল ৪৯ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং টাকার অঙ্কে ব্যয় হয়েছিল ৯৮ হাজার ৮৪০ টাকা। সাধারণ ছুটিতে এপ্রিল, মে ও জুনে উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যক্রম স্থবির ছিল। বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আরএডিপি বাস্তবায়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শুধু বিল পরিশোধ ছাড়া তেমন কিছুই হয়নি। আইএমইডির প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত অর্থবছর সবচেয়ে কম ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ আরএডিপি বাস্তবায়ন করেছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। এ তালিকায় পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ৩৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ, খাদ্য মন্ত্রণালয় ৪৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ, জননিরাপত্তা বিভাগ ৫১ শতাংশ, আইন ও বিচার বিভাগ ৫১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। তবে সর্বোচ্চ আরএডিপি বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ, স্থানীয় সরকার, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক, সেতু বিভাগ, শিল্প মন্ত্রণালয়, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।

To Top