গ্রামীণ আয়ে শস্য খাতের অবদান অর্ধেক কমে গেছে
দুই দশক আগেও গ্রামীণ পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস ছিল শস্য খাত। সে সময় মোট গ্রামীণ আয়ে শস্য খাতের অবদান ছিল প্রায় এক-চতুর্থাংশ। এর পরেই অবস্থান ছিল ছোটখাটো ব্যবসা বা ক্ষুদ্র উদ্যোগের। একই সঙ্গে বড় হতে থাকে অকৃষিজ সেবা ও রেমিট্যান্স খাতের অবদানও। ফলে বর্তমানে এসে দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ পরিবারের আয়ে শস্য খাতের অবদান নেমে এসেছে অর্ধেকেরও নিচে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামীণ পরিবারগুলোয় এখন শস্যনির্ভর কর্মসংস্থান অনেক কম হচ্ছে। এর বিপরীতে বেড়েছে কৃষিজ ও অকৃষিজ কর্মসংস্থান। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও ছোট ব্যবসা, যান্ত্রিকীকরণ, বিপণনসংশ্লিষ্ট নানা কার্যক্রমের অবদান এখন বেড়েছে। একই সঙ্গে গ্রামীণ কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে মত্স্য, প্রাণী ও বনায়নের মতো শস্যবহির্ভূত উপখাতও। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে কৃষি খাতে মোট কর্মসংস্থানের হার ৪০ শতাংশ। ২০০০ সালেও দেশের গ্রামীণ পরিবারগুলোর আয়ে শস্য খাতের অবদান ছিল ২৫ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তা নেমে এসেছে ১২ শতাংশে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, কিছু যৌক্তিক কারণেই গ্রামীণ মানুষের আয় ও কর্মসংস্থানে শস্য খাত পিছিয়ে পড়েছে। একটি রূপান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অন্য খাতগুলো এগিয়ে আসছে। তবে শস্য খাত মূলত আবহাওয়ানির্ভর হওয়ার কারণে সবসময়ই ঝুঁকিতে থাকে। এছাড়া ফসলের মূল্যের ওঠানামাটাও হয় অনেক বেশি। ফলে কৃষকদের উৎপাদন ও বিপণনসংশ্লিষ্ট নানা ঝুঁকি নিয়ে এ খাতে নিয়োজিত থাকতে হয়। খাদ্য ও আয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাগিদেই তাদের একপর্যায়ে এসে অকৃষিজ কর্মকাণ্ডে ঝুঁকতে হয়। গ্রামীণ কর্মসংস্থান ও আয়ে শস্য খাতের অবদান ধরে রাখতে হলে অবশ্যই আবহাওয়া নির্ভরতা কমাতে হবে জানিয়ে কৃষি অর্থনীতি সমিতির সাবেক এ সভাপতি বলেন, মাটির সংস্পর্শ ছাড়াই কৃষি খাতকে এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ও নীতি গ্রহণ করতে হবে। ক্ষুদ্র জমিকে বৃহদায়তন করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি কৃষির বাণিজ্যিকীকরণের জন্য কারিগরি প্রযুক্তির রূপান্তর ও যান্ত্রিকীকরণকে দ্রুত এগিয়ে নিতে হবে। শস্য খাতে প্রযুক্তি ও জ্ঞানভিত্তিক কৃষির প্রয়োগই সরকারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারে। গ্রামীণ মানুষের আয়ে অকৃষিজ খাতের অবদান এখন দিন দিন বাড়ছে। বিবিএসের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘রিপোর্ট অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল স্ট্যাটিসটিকস ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশের গ্রামীণ পরিবারগুলোর বার্ষিক আয় এখন প্রায় ২ লাখ ২ হাজার ৭২৪ টাকা বা মাসে প্রায় ১৬ হাজার ৮৯৩ টাকা। এর মধ্যে কৃষি এরপর ্ব পৃষ্ঠা ২ কলাম ১ খাত থেকে আসে ৩৮ দশমিক ২১ শতাংশ। বাকি প্রায় ৬১ দশমিক ৭৯ শতাংশ আসে অকৃষি খাত থেকে। বিভাগ অনুসারে কৃষি খাত থেকে আয় সবচেয়ে কম হয় ঢাকা ও সিলেট বিভাগে। এ দুটি বিভাগের বাসিন্দাদের আয়ে কৃষি খাতের অবদান যথাক্রমে ২৮ দশমিক ৮ ও ৩০ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কেএএস মুরশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, গ্রামীণ আয় ও কর্মসংস্থানের এ ধরনের পরিবর্তন দুটো বিষয়ের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। একটি হলো কৃষিতে বহুমুখীকরণ হয়েছে কিন্তু শস্য খাতে এখনো কাঙ্ক্ষিত বহুমুখীকরণ হয়নি। দ্বিতীয়টি হলো শস্য খাতে এখনো বোরো ধানকেন্দ্রিক বিনিয়োগ হচ্ছে, যেটি কিনা খুব বেশি মুনাফা দিতে পারছে না। কৃষি খাতে রূপান্তর প্রক্রিয়া দ্রুত আনতে না পারলে এ খাতের ক্রমহ্রাসমান প্রবৃদ্ধির চিত্র আরো খারাপের দিকে যেতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, প্রথাগত কৃষি থেকে আধুনিক কৃষিতে যেতে হবে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি সক্ষম করে তুলতে হবে শস্য খাতকে। এজন্য বাড়তি বিনিয়োগ ও আর্থিক প্যাকেজ সঠিকভাবে দিতে হবে। পাশাপাশি মূল্য সংযোজন ও তারুণ্যনির্ভর কৃষিতে গুরুত্বারোপ করতে হবে। শস্য খাতে এখন মোটামুটিভাবে একটি কাঠামোগত পরিবর্তন খুব প্রয়োজন। এছাড়া সার্বিক কৃষি খাতেও মানহীনতা রয়েছে কর্মসংস্থানের। কৃষিতে বর্তমানে মোট কর্মসংস্থান প্রায় আড়াই কোটি। এর ৩৫ দশমিক ৯০ শতাংশই কাজ করছে পারিবারিক সহায়তাকারী হিসেবে। আত্মকর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৩৩ দশমিক ৫২ শতাংশের। কৃষি শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এ বিষয়ে এসিআই এগ্রি বিজনেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. ফা হ আনসারী বলেন, শস্য খাতের সমসাময়িক প্রতিবন্ধকতাগুলোকে অনুধাবন করতে হবে এবং সে অনুসারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। শস্য বহুমুখীকরণ ও উৎপাদনশীলতায় আমরা এখন অনেকটাই পিছিয়ে। প্রযুক্তি ও যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়া বিকল্প টেকসই কোনো উপায় নেই। এছাড়া প্রতিকূল পরিবেশের উপযোগী প্রযুক্তি ও উৎপাদন কৌশল, হাইব্রিড শস্যের প্রসার, পানিসাশ্রয়ী সেচ পদ্ধতি, সার ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি প্রযোজন। এতে কর্মসংস্থান যেমন বাড়বে, তেমনি কৃষকের আয়ও বৃদ্ধি পাবে। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি রোধে ও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় নতুন জাত, ভূমি ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। জমির উর্বরতাশক্তি ধরে রাখা এবং ফসলের বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে অবশ্যই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।
About Me
Journalism Specialization: Through last 15 years of Journalism, I have vast experiences in Business and Economy, Food and Agriculture, Finance and Planning System of Government, Environment and Climate Change, Economical Bilateral Relationship, Trade, Investment, Health and Nutrition System, Private Sectors. Woman and Gender Issues, NGOs and Development Partners.