সবুজ অর্থনীতির নতুন দুয়ার যমুনা ইকোনমিক করিডোর

September 24, 2023 0 Comments
যমুনা নদীকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক করিডোর ও নৌপথের বাণিজ্য সম্ভাবনা, বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং নাব্যতা সংকটের প্রভাব নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিকের শেষ পর্ব যমুনাকে ঘিরে অর্থনৈতিক চাঞ্চল্য সৃজনের কথা রয়েছে শত বছরের বদ্বীপ পরিকল্পনায়। এ পরিকল্পনাকে কাজে লাগিয়ে যদি যমুনা ইকোনমিক করিডোর গড়ে তোলা যায়, তাহলে এ অঞ্চলের ভাঙনকবলিত ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জন্য তা নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এ অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নের জন্য ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি প্রয়োজন হবে বলে সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাপী শিল্পায়ন ও নগরায়ণ প্রসারিত হয়েছে নদীকে কেন্দ্র করেই। দেশেও এক সময় বৃহদায়তনের নৌ-পরিবহন খাতের গুরুত্বপূর্ণ এক রুট গড়ে উঠেছিল যমুনা-ব্রহ্মপুত্রকে ঘিরেই। অথচ সঠিক পরিকল্পনা এবং বিজ্ঞানভিত্তিক ও দক্ষ নদী ব্যবস্থাপনার অভাবে দেশের এ গুরুত্বপূর্ণ নদীকে ঘিরে জেগে ওঠা অর্থনৈতিক সম্ভাবনার অপমৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই। এখনো নদীর ভাঙনে জমি বিলীন হওয়া ছাড়াও গৃহহীন হচ্ছে মানুষ। জেগে উঠছে চরাঞ্চল। দারিদ্র্যও পিছু ছাড়ছে না স্থানীয়দের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উত্তরাঞ্চলের পণ্য পরিবহন ছাড়াও আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য বৃদ্ধিতে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদীপথ হতে পারে সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। জমি পুনরুদ্ধার, সেচের উন্নয়ন, সবুজ অর্থনৈতিক জোন, নদীভিত্তিক পণ্য পরিবহনের উপযুক্ত হতে পারে যমুনা অর্থনৈতিক করিডোর। পাশাপাশি নদীটিকে ঘিরে এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে বাণিজ্য ও শিল্পায়নেরও সম্ভাবনা রয়েছে অনেক। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এ অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে তুলতে হলে নৌপথটিকে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহনের উপযোগী করতে প্রয়োজন হবে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা। নদীভাঙন রোধ, ড্রেজিং ও এ-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজন হবে ৩১ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও অর্থনৈতিক জোন উন্নয়নে ৫০ হাজার কোটি এবং পরিচালন ও ব্যবস্থাপনায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। এর বাইরেও অন্যান্য খাতে বেশ অর্থ প্রয়োজন। সব মিলিয়ে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বিনিয়োগ প্রয়োজন প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার। এ বিষয়ে সমীক্ষা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, এ বিনিয়োগের মাধ্যমে যমুনাপাড়ে সবুজ অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলা সম্ভব হবে, যা বাস্তবায়ন হলে দেশের রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি দ্রুতগতিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। তবে এক্ষেত্রে বিনিয়োগ পরিকল্পনাটি সমন্বিত হতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ অঞ্চলের পণ্য পরিবহনে যমুনা নদীকে গুরুত্ব দিতে হবে। নদীগুলোয় নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। বন্যার ঝুঁকি কমাতে হলে নদীতে পানিপ্রবাহের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ রাখতে হবে। পানিপ্রবাহের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সংলগ্ন নদীগুলোর পানিপ্রবাহকেও স্থিতিশীল রাখা প্রয়োজন। নদীর পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি যথাযথ পলি ব্যবস্থাপনার দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। এছাড়া শিল্পায়ন ও বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য বেসরকারি খাতকে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাও দিতে হবে। এ বিষয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বণিক বার্তাকে বলেন, ভাঙনপ্রবণ অঞ্চলে বা যমুনার মতো নদীর পাড়ে শিল্পায়ন বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গড়ে তোলা কঠিন। যে কারণে আরিচা থেকে রাজশাহী পর্যন্ত পদ্মার তীরে শিল্পায়ন গড়ে ওঠেনি। কিন্তু যমুনার তীর ঐতিহাসিকভাবেই নৌবাণিজ্য পরিচালনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক জোন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। সে সম্ভাবনাময় করিডোরটি আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। কিন্তু এখনো যমুনার দুই পাড়ে সবুজ অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব। এ অঞ্চলের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে রফতানিমুখী শিল্পায়ন গড়ে উঠতে পারে। এতে আঞ্চলিক বৈষম্য কমে আসার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করাও সম্ভব হবে। সে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে অবশ্যই সরকারকে পরিকল্পিত বিনিয়োগ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয়, বিজ্ঞানসম্মততা ও দক্ষতার সঙ্গে পরিকল্পনা গ্রহণ করে তার বাস্তবায়ন করতে হবে। জানা গেছে, বছরে প্রায় ১২০ কোটি টন পলি উপকূলভাগের নদ-নদীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হওয়ার ফলে ৫ থেকে ১০ বর্গকিলোমিটার নতুন চর জাগে। আবার নদীভাঙনের কারণে বিপুল পরিমাণ জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ফলে প্রচলিত চ্যানেলগুলোও এক সময় হারিয়ে যায়। নদীপথগুলোকে কার্যকর করতে হলে এসব চ্যানেল পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে নদীপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করার ওপরও জোর দিয়েছেন তারা। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ও বদ্বীপ পরিকল্পনার রূপকার ড. শামসুল আলম জানালেন, বদ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে যমুনা অর্থনৈতিক করিডোরের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সব ধরনের বিনিয়োগ পরিকল্পনা ও উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, অর্থনীতির জন্য যমুনা অর্থনৈতিক করিডোর হলো দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যদিও নদীটির ভাঙনপ্রবণতা ও ঝুঁকিও অনেক বেশি। তাই সঠিক পরিকল্পনা ও অর্থায়নের মাধ্যমে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে এ অঞ্চলের বড় ধরনের পরিবর্তন করা সম্ভব হবে। যমুনা অর্থনৈতিক করিডোরকে বাস্তবে রূপ দিতে পারলে প্রচুর জমি উদ্ধার করা সম্ভব। কারণ ১৪-১৬ কিলোমিটারের প্রশস্ততার নদীকে ন্যূনতম ১০-১২ কিলোমিটারের মধ্যে নিয়ে এসে জমি উদ্ধার করা গেলে সেখানে নগর, বন্দর ও শিল্পায়ন গড়ে তোলা সম্ভব হবে। অর্থায়নের সংস্থান করতে এরই মধ্যে বৈশ্বিক ঋণদানকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে সব ধরনের ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। তারা বড় ধরনের অর্থায়নে রাজি হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবেই যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদীতে নৌপথ চালু ছিল। সেই নদীপথটিকে জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে বিশেষ করে আসাম পর্যন্ত নৌ-যোগাযোগ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ফলে এখানকার মানুষের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা, সবুজ অর্থনীতি গড়ে তোলা ও পর্যটন বিকাশের জন্য সব ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ১০-১৫ বছরের মধ্যেই সে পরিবর্তন দেখা যাবে। জানা গেছে, সম্প্রতি একনেকে ৫৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে যমুনার ডান তীরের ভাঙন থেকে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার সিংড়াবাড়ী, পাটাগ্রাম ও বাঐখোলা এলাকা সংরক্ষণের জন্য গৃহীত একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন, যাতে নদীর প্রবাহ ঠিক থাকে। তাই বড় নদীগুলোয় ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও মেইনটেন্যান্স ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সারা বছর পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে হবে। নদীগুলোয় ডুবোচর থাকলে সেগুলোর কথা মাথায় রেখে ড্রেজিং করতে হবে। তাছাড়া বর্ষাকালে যাতে নদীগুলোর পানি ধরে রেখে শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহার করা যায়, তার ব্যবস্থাও নিতে হবে। এসব দিক বিবেচনা করেই নদী ড্রেজিংয়ের জন্য স্থায়ী পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেন তিনি। সে নির্দেশনা অনুযায়ী পানিসম্পদ ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে কাজ করছে বলে জানা গিয়েছে। এ বিষয়ে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এনামুল হক শামীম বণিক বার্তাকে বলেন, আগে বিচ্ছিন্নভাবে নদীর উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় কাজ করা হতো। কিন্তু সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, বিশেষ করে শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যানের আওতায় সমগ্র নদীকে নিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যমুনা পাড়ের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সব ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি যমুনা নদীর এক পাড়ের ১২০ কিলোমিটার উন্নয়ন ও পুনর্গঠনে প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এছাড়া কয়েক বছর ধরেই বেশকিছু উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। সামনের দিনে যমুনা অর্থনৈতিক করিডোরকে দেশের অর্থনীতির অন্যতম অঞ্চল হিসেবে বাস্তবায়ন করতে সব ধরনের সমন্বিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এ বিষয়ে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের অর্থনীতি ও এ অঞ্চলের মানুষের প্রাণ যেন যমুনা নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠে, সে ব্যবস্থাপনা করতে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অদূরভবিষ্যতে যমুনা নৌপথে বড় বড় জাহাজ চলবে। এজন্য সমন্বিত বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ, ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা করা ও ড্রেজিং ব্যবস্থাপনায় উন্নত পদ্ধতি আনা হয়েছে।

Leave A Comment

To Top