মাছ উৎপাদনে দেশসেরা ময়মনসিংহ ও যশোর

September 24, 2023 0 Comments

আশির দশকে শিক্ষাজীবন শেষ করে মত্স্য উৎপাদন ও বিপণনে যুক্ত হন ময়মনসিংহের তিন তরুণ। চাকরিতে না ঢুকে মত্স্য খামারের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান করতে গিয়ে শুরুতে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হলেও একপর্যায়ে সাফল্যের দেখা পান তারা। তাদের সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্থানীয় অনেক তরুণই এগিয়ে আসেন মত্স্য চাষের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানে। একপর্যায়ে এ চর্চা ছড়িয়ে পড়ে গোটা জেলায়, যার ধারাবাহিকতায় দেশে এখন মত্স্য উৎপাদনে শীর্ষ জেলা হয়ে উঠেছে ময়মনসিংহ।

বর্তমানে বৈশ্বিক মত্স্য উৎপাদনে (অ্যাকুয়াকালচার) শীর্ষ পাঁচ দেশের অন্যতম বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে ময়মনসিংহ জেলার অবদান সবচেয়ে বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জেলাটিতে মাছ উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার টন। এর পরের অবস্থানে রয়েছে যশোর। জেলাটিতে এ সময় মাছ উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার টন। তৃতীয় শীর্ষ জেলা কুমিল্লায় এ সময় মোট মত্স্য উৎপাদনের পরিমাণ ২ লাখ ১৪ হাজার টন।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে মোট চাষকৃত মাছের উৎপাদন ছিল ৩৬ লাখ ২২ হাজার টন। এর মধ্যে এ তিন জেলায়ই উৎপাদন হয়েছে ৮ লাখ ৪৭ হাজার টন। সে হিসেবে দেশে চাষকৃত মাছের প্রায় ২৪ শতাংশই সরবরাহ হচ্ছে জেলা তিনটি থেকে।

জানা গিয়েছে, ময়মনসিংহের তিন তরুণ শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯৮৩ সালে জেলার ত্রিশাল, ভালুকা ও মুক্তাগাছা এলাকায় মাছের চাষ শুরু করেন। নদী থেকে রেণু নিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে পোনা উৎপাদনের মাধ্যমেই মত্স্য খামার গড়ে তোলেন আল-ফালাহ মত্স্য খামারের পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন, ব্রহ্মপুত্র মত্স্য হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী নুরুল হক ও রিলায়েন্স অ্যাকুয়া ফার্মের মালিক হূতিশ পণ্ডিত। তাদের দেখাদেখি শম্ভুগঞ্জ ও ফুলপুর, গৌরীপুর, ভালুকায়ও বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা স্বল্প পরিসরে মত্স্য চাষকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। একপর্যায়ে জেলার সব উপজেলায় লাখ লাখ তরুণ এভাবে মত্স্য খামারের দিকে ঝুঁকে পড়েন। পাশাপাশি বড় কয়েকটি করপোরেট গ্রুপও এখন জেলাটিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বৃহৎ পরিসরে মাছের উৎপাদন শুরু করেছে।

এছাড়া মত্স্য গবেষণাগত দিক থেকেও বড় দুটি প্রতিষ্ঠান জেলাটিতে মত্স্য উৎপাদনে বড় ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত্স্য অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা তাদের গবেষণার প্রাথমিক ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন এ এলাকার বিভিন্ন উপজেলাকে। আঞ্চলিক সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল দ্রুত রপ্ত করতে পারছেন স্থানীয় খামারিরা। ফলে এখানে মত্স্য চাষের সম্প্রসারণও হয়েছে অনেকটা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে।

এ বিষয়ে মত্স্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ময়মনসিংহে মাছের উৎপাদন বাড়াতে তিন তরুণ এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও মত্স্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তবে উৎপাদন ও বিপণনে এখনো বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সেগুলো দূর করতে হবে। এছাড়া মাছের খাদ্যের দাম কমিয়ে আনতে উদ্যোগ প্রয়োজন। মাছ চাষে প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের বিলটাও কমিয়ে আনতে হবে। কৃষির শস্য উপখাতের মতো সুযোগ-সুবিধা দেয়া গেলে মত্স্য উপখাতও প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে। এছাড়া মত্স্য খামারিদের জমির লিজের অর্থায়ন নিয়েও আরো কাজ করতে হবে।

মত্স্য চাষে যশোর জেলার শুরুটা অবশ্য চল্লিশের দশকে। সে সময়ে প্রতাপাদিত্য নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি চাঁচড়ার বর্মণ পাড়া এলাকায় পাবদা মাছের চাষ শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ষাটের দশকে মহসিন আলী মাস্টার নামের একজন উদ্যোক্তা পাবদা ছাড়াও অন্যান্য মাছ চাষের জন্য রেণু উৎপাদন শুরু করেন। তার দেখাদেখি পরবর্তী সময়ে এগিয়ে আসেন নতুন উদ্যোক্তারা। ফলে বর্তমানে দেশের প্রধান রেণু সরবরাহকারী অঞ্চলে পরিণত হয়েছে চাঁচড়া। যশোর উঠে এসেছে মত্স্য উৎপাদনে দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ জেলা হিসেবে।

বর্তমানে যশোর জেলায় ২২ প্রজাতির মাছের চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে রুই। উপজেলা পর্যায়ে মত্স্য খামার স্থাপনে এগিয়ে আসছেন বেসরকারি অনেক উদ্যোক্তা। জেলাটিতে মাছ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে আফিল অ্যাকুয়া ফিশ। দুই হাজার বিঘা জমির ওপর মাছ চাষ করছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিদিন মাছ ও মাছের পোনা উৎপাদন হচ্ছে ১০ টন। মত্স্য চাষের মাধ্যমে এখানে যেমন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি তা এখানকার জলাবদ্ধতার সমস্যা দূর করায়ও ভূমিকা রাখছে।

এ বিষয়ে আফিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ আফিল উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ২০০৮ সালে শার্শা উপজেলার মান্দারতলা এলাকায় জলাবদ্ধতা নিয়ে ভাবতে শুরু করি। এরপর মত্স্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেই গড়ে তুলি অ্যাকুয়া ফিশ ফার্ম। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে আফিল অ্যাকুয়া ফিশে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছ উৎপাদন করা হচ্ছে। যেখানে মাছের গুণগত মান সঠিক রাখা হয়েছে। এতে একদিকে যেমন এলাকার মানুষ জলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে, তেমনি নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি করা গিয়েছে। আমরা ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে মাছের উৎপাদনে যাব।

বর্তমানে যশোরের উৎপাদিত মাছ প্রতিবেশী ভারতে রফতানি করা হচ্ছে বলে জানালেন বেনাপোল স্থলবন্দরের ফিশারিজ কোয়ারেন্টিন অফিসার মাহবুবুর রহমান। তিনি জানান, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এখান থেকে ভারতে মাছ রফতানি হয়েছে ৩২ লাখ ৬৭ হাজার ৪৪ কেজি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ লাখ ৮৩ হাজার ৬৩০ কেজিতে। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ উন্নীত হয় ৫২ লাখ ৪৫ হাজার ৮ কেজিতে, যার রফতানি মূল্য ১ কোটি ৩১ লাখ ১২ হাজার ৫২০ ডলার।

এ বিষয়ে যশোর জেলা মত্স্য কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান জানান, যশোর জেলায় ৭০ হাজার ২৯২ হেক্টর জমিতে মাছের উৎপাদন হচ্ছে। জেলাটি বর্তমানে দেশে মত্স্য উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। বছরে এখানে উৎপাদিত মাছ বেচাকেনা হচ্ছে প্রায় হাজার কোটি টাকার। এখানকার মাছ রফতানির পাশাপাশি সারা দেশেই বিক্রি হচ্ছে। জেলায় মাছ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের জন্য আমরা সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সুবিধার সম্প্রসারণ করছি।

বাজারজাত ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন এবং উন্নত জাতের পোনা সরবরাহ করা গেলে দেশের খামারগুলোয় মাছের উৎপাদন বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় গুণগত ও মানসম্পন্ন ব্রুড মাছ আমদানি করে বেসরকারি খাতে সরবরাহ করলে মাছের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন আরো বাড়ানো সম্ভব। এছাড়া ফিশ ফিডের দামও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। উৎপাদন টেকসই করতে হলে পরিবেশগত ভারসাম্য আনাটাও জরুরি। এছাড়া মাছ উৎপাদন শিল্পে মূল্য সংযোজন কীভাবে বাড়ানো যায়, সেদিকেও নজর দিতে হবে।

Leave A Comment

To Top