মহিষের সংখ্যা এক যুগেও বাড়েনি

September 16, 2023 0 Comments
দেশে গত এক যুগে গরু ও ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪২ লাখ। সে তুলনায় মহিষের উৎপাদন পিছিয়ে। এক যুগে মহিষের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখে আটকে আছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (ডিএলএস) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। সেকেলে পদ্ধতিতে লালন-পালন করায় মহিষের উৎপাদন বাড়ছে না বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
  ডিএলএসের তথ্য মতে, গরু উৎপাদনে সংকট কাটিয়ে দেশ এখন স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে। গরুর তুলনায় ছাগলের উৎপাদন বাড়ছে। সব মিলিয়ে দেশে এখন গরু ও ছাগলের সংখ্যা পাঁচ কোটি ১৪ লাখ ৭৪ হাজার। সে তুলনায় মহিষের উৎপাদন ধীর।
ডিএলএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরে গরু ছিল দুই কোটি ৩১ লাখ ২১ হাজার ও ছাগল ছিল দুই কোটি ৪১ লাখ ৪৯ হাজার। ২০২১-২২ অর্থবছরে গরুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ৪৭ লাখ ও ছাগল দুই কোটি ৬৭ লাখ ৭৪ হাজার। ২০১০-১১ অর্থবছরে মহিষ ছিল ১৪ লাখ ৪৩ হাজার, যা গত অর্থবছরে ১৫ লাখ আট হাজারে উন্নীত হয়েছে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় ও নদীবিধৌত অঞ্চলে মহিষ পালন করা হয়। বিশ্বে, বিশেষত ভারত ও পাকিস্তানে মহিষ খামারে পালন করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো মহিষ সনাতন পদ্ধতিতে পালন করা হয়। এতে উৎপাদন সে হারে বাড়ছে না।
গরুর তুলনায় মহিষ পালন বেশি লাভজনক।
কারণ গরুর তুলনায় মহিষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। মহিষের মাংস আর দুধও বেশি পুষ্টিকর। মহিষের দুধে স্নেহজাতীয় পদার্থের পরিমাণ প্রায় ৮ শতাংশ। অন্যদিকে গরুর দুধে এর পরিমাণ ১ থেকে ৩ শতাংশ। মহিষের মাংসে চর্বিও তুলনামূলক অনেক কম।মহিষের পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। চীনের বেইজিং জিনোম ইনস্টিটিউটের (বিজেআই) সহায়তায় দেশের বেসরকারি কম্পানি লাল তীর লাইভস্টক লিমিটেড এই সফলতা পেয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মহিষের জাত উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে কাজ করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে লাল তীর সিড লাইভস্টকের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু কালের কণ্ঠকে বলেন, পাশের দেশ ভারতের মোট দুধ উৎপাদনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই আসে মহিষের দুধ থেকে। সেখানে বাংলাদেশের মহিষের অবদান ৩ শতাংশের নিচে। মহিষের উৎপাদন বাড়াতে জাতের উন্নয়ন ও অবাধে মহিষের মাংস আমদানি বন্ধ করা প্রয়োজন। আমদানিতে শুল্কারোপের পাশাপাশি অশুল্ক বাধা প্রয়োগ করতে হবে। তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের বাথানগুলো সুরক্ষায় আরো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জীবনরহস্য উন্মোচনের ফলাফলকে কাজে লাগিয়ে মহিষের উন্নত জাত উদ্ভাবন করার কার্যক্রম চলছে, যার মাধ্যমে দেশের তরল দুধ ও মাংসের চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। জানা গেছে, এক যুগ আগেও দেশের গবাদি পশুর চাহিদার বড় একটি অংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হতো। ভারত ও মিয়ানমার থেকে আমদানি করা গরু দিয়ে কোরবানির বড় অংশের চাহিদা মেটানো হতো। ওই দেশ দুটি থেকে ২০ থেকে ২৫ লাখ গরু আমদানি করত বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশে গরু রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। চাহিদা মেটাতে দেশে গবাদি পশুর লালন-পালন ব্যাপক বেড়ে যায়। ভারত থেকে গবাদি পশু আসা বন্ধ হওয়ার পর দেশে প্রতিবছর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে গবাদি পশুর খামার বাড়ছে। বসতবাড়িতে উৎপাদন ছাড়াও ছোট-বড় মিলিয়ে খামারের সংখ্যা বর্তমানে সাড়ে ১২ লাখ ছাড়িয়েছে। মহিষের উৎপাদনও ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। দেশের এই উৎপাদন বৃদ্ধি ও কর্মতৎপরতার বৈশ্বিক স্বীকৃতি পাচ্ছে বাংলাদেশ। ছাগলের দুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয়। ছাগলের সংখ্যা ও মাংস উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। গরু-ছাগল-মহিষ-ভেড়া মিলিয়ে গবাদি পশু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১২তম। পশুপালন খাতে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকট উন্নত জাতের অভাব, খাদ্য ও গোচারণভূমির সংকট, রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের দুর্বল ব্যবস্থাপনা; রয়েছে প্রজনন ব্যবস্থাপনা ও বিপণন দুর্বলতা। এসবের কারণে অগ্রগতি দ্রুত হচ্ছে না। তাই খামারিদের প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি বিপণন কৌশল ও বাজারের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানো, পশুখাদ্যের দাম কমানোয় গুরুত্ব দিতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে পশু পালন না করে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অর্থায়ন বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশে এখন গরু আমদানি শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। গরু উৎপাদনের এই স্বনির্ভরতার পেছনে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, বিশেষ করে গরু মোটাতাজাকরণ, কৃত্রিম প্রজনন ও মানসম্পন্ন ব্রিডের সম্প্রসারণ, খামারিদের সহায়তা প্রদানে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ ও বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, ‘পশুপালনে অগ্রগতি হলেও পশুর মাংসের দাম কমাতে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছি। পশু লালন-পালন ও ব্যবস্থাপনা খরচ বেশি হওয়ার কারণে মাংসের দাম কমাতে পারছি না। তাই স্বল্প খরচে উৎপাদন কৌশল সম্প্রসারণ করার মাধ্যমে ভোক্তার কাছে স্বল্প মূল্যে মাংস ও দুধ পৌঁছাতে হবে। তাহলে দেশের এই উৎপাদন টেকসই হবে।’ কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পশুপালনে বহুমুখী উদ্যোগ প্রয়োজন। খামারিদের খরচ কমিয়ে মুনাফা বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে। কম খাবারে গরু উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ভালো মানের ব্রিড ও সিমেনের ব্যবহার বাড়াতে হবে। গরু মোটাতাজাকরণ কার্যক্রম আরো বৈজ্ঞানিকভাবে পরিচালনা করতে হবে।

Leave A Comment

To Top