বিঘাপ্রতি সার ব্যবহারে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়

September 21, 2023 0 Comments
বিশ্বে চাল উৎপাদনকারী শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে ধান আবাদে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সারের ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে প্রতি হেক্টর জমিতে গড়ে প্রায় ৩১৮ কেজি সার ব্যবহার করা হয়। এই হিসাবে প্রতি বিঘায় সারের ব্যবহার প্রায় ৪৩ কেজি।জমিতে সার ব্যবহারে শীর্ষে রয়েছে চীন।
দেশটির হেক্টরপ্রতি সারের ব্যবহার ৩৯৩.২ কেজি। বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে এই তথ্য উঠে এসেছে। তবে বাংলাদেশে এক জমিতে বছরে গড়ে দুটি ফসল হয়। চীনে হয় বছরে তিনটি শস্য।
তাই উৎপাদনের পরিমাণ ও বছরে ফসলের সংখ্যা বিবেচনায় নিলে বিশ্বে হেক্টর বা বিঘাপ্রতি সবচেয়ে বেশি সার ব্যবহার করছে বাংলাদেশ। কৃষি বিশেষজ্ঞরা একে মাত্রাতিরিক্ত বলছেন।
 
          দেশের আবাদি জমিতে সারের ব্যবহার কেমন হচ্ছে, তার তুলনা করতে চাল উৎপাদনে শীর্ষ চারটি দেশ যথাক্রমে চীন, ভারত, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়াকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। তুলনা করা হয়েছে এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গেও।
তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশে এখনো প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সার ব্যবহার করা হয়। এতে কৃষকের যেমন বাড়তি খরচ হচ্ছে, তেমনি জমির উর্বরাশক্তি নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।সার ব্যবহার নির্দেশিকা মূলত দেশের অঞ্চলভেদে প্রতিটি ফসলের জন্য আলাদাভাবে দেওয়া হয়েছে। দেশের সার্বিক গড় তথ্য না থাকায়, গবেষণার তথ্য নেওয়া হয়েছে।
এতে দেখা যাচ্ছে, বোরো আবাদে গড়ে প্রতি হেক্টরে ১২০-১৫০ কেজি সারের ব্যবহার যৌক্তিক।বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ইন্দোনেশিয়ায় প্রতি হেক্টর জমিতে সারের ব্যবহার ২৩৬.৪ কেজি, ভারতে ১৭৫ কেজি, ফিলিপাইনে ১৬৯ কেজি, পাকিস্তানে ১৫৬ কেজি, থাইল্যান্ডে ১৪৮.৯ কেজি, শ্রীলঙ্কায় ১৩৮.৩ কেজি, নেপালে ৮৬.৯ কেজি এবং মিয়ানমারে ৪৯.৩ কেজি।তবে কৃষি সম্প্রসারণ বিশেষজ্ঞ এবং কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে সারের ব্যবহার প্রকৃতপক্ষে আরো বেশি হতে পারে। এখন প্রতিবছর গড়ে ৫৫-৫৬ লাখ টন রাসায়নিক সারের ব্যবহার হচ্ছে। বাংলাদেশে এক জমিতে বছরে গড়ে দুটি শস্যের আবাদ হচ্ছে। চীনে হয় বছরে তিনটি শস্য। তাই চীনে সবচেয়ে বেশি সার ব্যবহার করার হলেও দেশটির শস্যের নিবিড়তা (বছরে তিনবার) এবং সারের ব্যবহার বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশেই প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আবার বিশেষজ্ঞরা এ-ও বলছেন, সার প্রয়োগের প্রচলিত পদ্ধতিতে নষ্ট হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ সার। ছিটিয়ে ইউরিয়া প্রয়োগের ফলে সেখান থেকে মিথেনসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়, যা ওজোনস্তরের ক্ষতি করে। মূলত কৃষকের সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ এবং সরকারি পদক্ষেপের অভাবে এটা হচ্ছে বলে মনে করছেন তাঁরা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি) মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবীর কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশে প্রধান দুটি শস্য আমন ও বোরো ধান। বোরো আবাদে অঞ্চলভেদে প্রতি বিঘায় শুধু ইউরিয়া সারের ব্যবহার প্রায় ২৭ থেকে ৪০ কেজি এবং আমনে ২২ থেকে ২৪ কেজি ব্যবহার করা হয়। ফলে বছরে এ দুটি শস্য আবাদে শুধু ইউরিয়া সারের ব্যবহার হচ্ছে গড়ে প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ কেজি। হেক্টরপ্রতি যা ৪০০ কেজির বেশি। তিনি বলেন, জমিতে সঠিক ও দক্ষতার সঙ্গে সারের ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ যেমন কমবে, তেমনি জমির উর্বরাশক্তি ধরে রাখা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) গবেষণার তথ্য বলছে, জমির উর্বরাশক্তি ধরে রাখতে নাইট্রোজেন ও জৈব উপাদানের পাশাপাশি ফসফরাস, পাটশিয়াম, সালফার, জিংক, বোরন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম থাকতে হবে প্রয়োজনীয় মাত্রায়; কিন্তু দেশের আবাদযোগ্য জমির প্রায় ৮৫ শতাংশ ভূমির উর্বরাশক্তি কমে গেছে। চাষযোগ্য জমিতে নেই প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন। এ ছাড়া জৈব পদার্থের অভাব রয়েছে, এমন জমির পরিমাণও ৩৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বাড়তি চাহিদার কারণে কৃষকরা জমি থেকে বেশি উৎপাদনে মনোযোগী হচ্ছেন; কিন্তু জমিকে যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান দিতে হবে, তা তাঁরা ভাবছেন না। সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শও তাঁরা সব সময় পান না। এর ওপর অতিরিক্ত মাত্রায় ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে। গবেষণা প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তার গুণাগুণ ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম  বলেন, জমিতে কতটুকু সার দিতে হবে, এমন প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা প্রত্যক কৃষককে এখন পর্যন্ত সম্প্রসারণ কর্মীরা দিতে পারেননি। ফলে এখনো কৃষক মনে করছেন, বেশি সার দিলে উৎপাদন বেশি হবে। সরকারের কার্যকর নীতি ও সম্প্রসারণ কর্মীরা সক্রিয় না হলে এই প্রবণতা বন্ধ হবে না। জাহাঙ্গীর আলম আরো বলেন, সারের ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করাও সম্ভব। আবার সারে ভর্তুকির টাকা কমানো গেলে বিদ্যমান ভর্তুকির টাকা কৃষির অন্য খাতে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। কৃষি সহায়তার ৮০ শতাংশই সারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, কৃষকের ফসল উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার পাশাপাশি উৎপাদন বাড়ানোয় প্রণোদনা হিসেবে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়। গত ১২ বছরে কৃষি উপকরণ বিশেষ করে সার, ডিজেল, বিদ্যুৎ ইত্যাদি খাতে আর্থিক সহযোগিতা বাড়ানো হয়েছে। তবে বিতরণকৃত এসব সহায়তার ৮০ শতাংশের বেশি গেছে সারে। বর্তমান বৈশ্বিক সংকট পরিস্থিতিতে সারের ভর্তুকি কমানোর জন্য দাম বাড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কৃষকদের মধ্যে ইউরিয়া বেশি ব্যবহার করার প্রবণতা রয়েছে। ডিএপি সারে ১৮ শতাংশ নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া সারের উপাদান রয়েছে। সে জন্য ডিএপির ব্যবহার বাড়িয়ে ইউরিয়া সারের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। তিনি জানান, সারা দেশে সারের সঠিক ব্যবহার ও দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োগে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।  

Leave A Comment

To Top