বড় বিনিয়োগেও সেচ সম্প্রসারণে গতিহীনতা

September 24, 2023 0 Comments

সেচকাজে যান্ত্রিকীকরণের শুরুটা দেশ ভাগের পর পরই। পাম্পের সাহায্যে হাওড়-বাঁওড়, খাল-বিল কিংবা নদীর পানি ফসলি জমিতে ব্যবহার তখন থেকেই শুরু করেন এ অঞ্চলের কৃষক। স্বাধীনতার পর নলকূপ আর গভীর নলকূপে আরো গতি পায় বাংলাদেশের সেচ কার্যক্রম। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছরে পা রাখতে চললেও দেশের বিপুলসংখ্যক সেচযোগ্য জমি রয়ে গেছে সেচ সুবিধার বাইরে। বছর বছর মোটা অংকের বিনিয়োগ করেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সেচের পরিধি বাড়াতে পারছে না সরকার। এতে ছেদ পড়ছে উৎপাদনশীলতায়। নিম্নগামী প্রবৃদ্ধি হচ্ছে শস্য খাতে।

বাংলাদেশে আবাদের জন্য সেচযোগ্য জমি আছে ৭৭ দশমিক ৬ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে সর্বশেষ অর্থবছর পর্যন্ত সেচের আওতায় এসেছে ৫৬ লাখ হেক্টর। ২৭ শতাংশ বা প্রায় ২১ লাখ হেক্টর জমি এখনো রয়ে গেছে সেচ সুবিধার বাইরে। সেচের পানির দক্ষ ব্যবহারও করতে পারছেন না বাংলাদেশের কৃষক। সেচকাজে ব্যবহার হওয়া ৬০ শতাংশ পানিই অপচয় হচ্ছে। ফলে বিপুল পরিমাণ জমি সেচ সুবিধার বাইরে থাকার পাশাপাশি সেচকাজে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে।

প্রতি বছর খাতটিতে মোটা অংকের অর্থ বিনিয়োগ করছে সরকার। তবে এর খুব একটা প্রভাব পড়ছে না মাঠ পর্যায়ে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর ৩১৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছর ২৮৩ কোটি ৩৬ লাখ, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ২১৫ কোটি ৫৪ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৪৩৯ কোটি ৩০ লাখ ও ২০১৯-২০ অর্থবছর ৪৮৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা—সব মিলিয়ে গত পাঁচ বছরে সেচ সম্প্রসারণে সরকারি বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকার বেশি। এর বিপরীতে সেচ সুবিধার আওতায় এসেছে মোটে এক লাখ হেক্টর জমি। ৫৪ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৫ লাখ ৯৮ হাজার হেক্টর। এসব জমি আবাদে ব্যবহূত হয়েছে ১৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪১৩টি সেচযন্ত্র। শ্যালো টিউবওয়েল ছিল ১৩ লাখ ৫৭ হাজার ৫৩২টি, শ্যালোর বাইরে সেচে ব্যবহার হচ্ছে প্রায় ৩৭ হাজার ৬৩৪টি গভীর নলকূপ ও ১ লাখ ৮৭ হাজার ১৮৮টি লো লিফট পাম্প।

বিনিয়োগের বিপরীতে বাড়ছে না সেচ সুবিধায় আসা জমি। এর প্রভাব পড়ছে শস্য উৎপাদনে। কয়েক বছর ধরেই শস্য খাতে দেখা দিয়েছে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত প্রবণ এলাকা, চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমের চরাঞ্চলে সেচ সুবিধা এখনো পর্যাপ্ত সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়নি। বেশকিছু বিভাগে ব্যাপক হারে আবাদি জমি সেচের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। কিছু এলাকায় পানির স্তর নেমে যাওয়ায় গভীর নলকূপ ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। দেশের সেচ কার্যক্রমে এ গতিহীন ভাব বজায় থাকলে সামনের দিনে কৃষির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, কী কারণে এসব অঞ্চলে সেচ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না, সেটি নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। আবার সেচ সম্প্রসারণ করলে পরিবেশগত ও আর্থিকভাবে কতটুকু লাভবান হওয়া সম্ভব, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। তবে সেচযোগ্য জমিতে যদি সেচ সুবিধা পৌঁছানো সম্ভব না হয়, তাহলে সেটি কৃষির জন্য বড় ক্ষতি হবে। এর মাধ্যমে আমরা শস্য বা কৃষি খাতের উৎপাদন যেমন হারাচ্ছি, তেমনি কৃষকের আর্থিক সুবিধা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। হয়তো এর মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের একটি বড় অংশকে আর্থিক সুবিধা দেয়া সম্ভব হবে। তাই সেচ সুবিধা সম্প্রসারণে একটি বড় ধরনের ধাক্কা প্রয়োজন। প্রয়োজনে আগের পদ্ধতি থেকে বের হয়ে এসে ভর্তুকি সুবিধা আরো বাড়াতে হবে।

দেশের সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারণে এককভাবে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। ১৯৬৭-৬৮ সালে বিএডিসি গভীর নলকূপ স্থাপন করে সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু করে এবং ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে অগভীর নলকূপ স্থাপন শুরু করে। ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের হাইড্রোলিক স্ট্রাকচার নির্মাণের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি ও ভূ-উপরিভাগের পানির সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ানো প্রকল্প হাতে নিয়েছে। রাবার ড্যাম (চলমান), হাইড্রোলিক এলিভেটর ড্যাম (চলমান), সৌর শক্তিচালিত সেচপাম্প স্থাপন, সেচযন্ত্রে স্মার্ট বেজড প্রিপেইড মিটার স্থাপন ও ডাগওয়েলসহ টেকসই সেচ অবকাঠামো নির্মাণ করছে। আধুনিক ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ড্রিপ ইরিগেশন ও স্প্রিঙ্কলার ইরিগেশনের মতো লাগসই প্রযুক্তি ও ভ্রাম্যমাণ সেচপাম্প চালু করতে কার্যক্রম চালু করেছে।

বিএডিসির সেচ কার্যক্রমের সার্বিক অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার পাশাপাশি উন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দ বিষয়ে কৃষি সচিব মো. মেসবাহুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বিএডিসির সঙ্গে আলাপের পরামর্শ দেন তিনি।

পরে বিএডিসির ক্ষুদ্রসেচ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. জিয়াউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, কয়েক বছর ধরে সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারণের পাশাপাশি সেচ ব্যবস্থাপনায় জোর দেয়া হয়েছে। ফলে সেচের আওতা এখন আর জ্যামিতিক হারে নয়, গাণিতিক হারে বাড়ছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর ভারসাম্য রক্ষা করেই একটি টেকসই সেচ ব্যবস্থাপনায় জোর দেয়া হচ্ছে। আবার কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলে সেচের কার্যক্রম কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। এসব অঞ্চলে ঢালাওভাবে কার্যক্রম নিয়ে সেচের আওতা বাড়ানো সম্ভব হবে না। অঞ্চলগুলোর প্রয়োজন বিবেচনায় নিয়েই সেচের কার্যক্রম সম্প্রসারণে আলাদা কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। চরাঞ্চলের ভাসমান সেচযন্ত্র দিয়ে নতুনভাবে জমিকে সেচের আওতায় আনা হচ্ছে। ডাগওয়েল বা ফিতা পাইপের মাধ্যমে দূরের জমিগুলোতে পানি নেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সেচের পানির অপচয় কমানো ও ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা, সংরক্ষণ ও নিষ্কাশনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বেশি পরিমাণে খাল-নালা খনন ও পুনঃখনন করা হচ্ছে। ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহার করে সেচকৃত জমির পরিমাণ ৬০ লাখ হেক্টরে উন্নীত করতে মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।

Leave A Comment

To Top