নদীভাঙনে বছরে বাস্তুচ্যুত ২৫ হাজার মানুষ

September 16, 2023 0 Comments
দেশে ১৯৭৩ থেকে ২০২১  সাল পর্যন্ত প্রধান দুটি নদীর ভাঙনে বিলীন হয়েছে এক লাখ ৫৭ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমি। এর মধ্যে যমুনায় বিলীন হয়েছে ৯৩ হাজার ৯৬৫ হেক্টর আর পদ্মায় ৬৩ হাজার ৫৫৮ হেক্টর। গড়ে প্রতিবছর তিন হাজার ২০০ হেক্টরের বেশি জমি বিলীন হচ্ছে। নদীভাঙনে বছরে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ।
বিলীন হচ্ছে কৃষিজমি, বসতবাড়ি, রাস্তা, বাঁধ ও অবকাঠামো।পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান অব বাংলাদেশ (২০২৩-২০৫০)’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। মিসরে চলমান জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৭) এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন ও ক্ষতির প্রভাব মাত্রা বিষয়ে এ প্রতিবেদনের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দাবি এবং এসংক্রান্ত আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাবে।
পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহিত। এর মধ্যে প্রধান নদী হলো ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা। নদীর পার গঠনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সবচেয়ে বেশি ভাঙনপ্রবণ যমুনা নদী। প্রতিবছর নদীপথে সাগর অভিমুখে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টন পলি ভেসে আসে।
এসব পলি যথাযথভাবে ড্রেজিং করা সম্ভব হলে গ্রীষ্মকালেও নাব্যতা বজায় থাকত। নদী সংরক্ষণে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস)। ২০০৪ সাল থেকে যমুনা, গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকার সম্ভাব্য ভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। উপগ্রহের ছবি, জিআইএস প্রযুক্তি এবং নদীভাঙনের ইতিহাস গবেষণা করে তারা এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে।
প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করেই ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে।প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ১৯৭৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত যমুনার ভাঙনের শিকার হয়েছে দেশের ৯৩ হাজার ৯৬৫ হেক্টর জমি। অন্যদিকে এই নদীতে নতুন চর জেগেছে ১৪ হাজার ৫৪৫ হেক্টর। পদ্মা নদীকে দুই ভাগে ভাগ করে নদীভাঙন নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রবেশমুখ থেকে আরিচা পর্যন্ত নদীকে গঙ্গা এবং আরিচা থেকে সাগর পর্যন্ত নদীকে পদ্মা বলা হয়েছে। এই সময়ে পদ্মা নদীর গর্ভে বিলীন হয়েছে ৩৩ হাজার ৫৮৫ হেক্টর এবং গঠিত হয়েছে পাঁচ হাজার ৪৮৫ হেক্টর। গঙ্গা নদীতে বিলীন হয়েছে ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি। অন্যদিকে চর জেগেছে ২৯ হাজার ১০০ হেক্টর। ফলে নদী একদিকে ভাঙছে, অন্যদিকে গড়ছে। গড়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে গঙ্গা নদী। সব মিলিয়ে গত ৪৯ বছরে দেশে নদী ভেঙেছে এক লাখ ৫৭ হাজার ৮৫০ হেক্টর, অন্যদিকে নতুন চর জেগেছে ৪৯ হাজার ১৩০ হেক্টর। এ বিষয়ে সিইজিআইএসের নির্বাহী পরিচালক ও নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, নদীতে পানি ও বালুর মধ্যে একটি ভারসাম্যাবস্থা থাকতে হয়। সেটি কোনো কারণে বাধাগ্রস্ত হলে নদীভাঙন হবে। গত কয়েক বছরে নদীতে বালু জমার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণত ওপর থেকে যে বালু আসে সেটির প্রায় বেশির ভাগই সাগরমুখে যেতে হবে। কিন্তু আসা বালুর ৫০ শতাংশের বেশি সেখানে যেতে পারছে না। এতে নদীভাঙনের তীব্রতা বাড়ছে। গত কয়েক বছরে নদীকেন্দ্রিক বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু নদীর কয়েকটি স্থানকেই বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এই কার্যক্রমে নদীর কয়েকটি স্থানকে বিবেচনায় নিলে হবে না। পুরো নদীব্যবস্থাকে বিবেচনায় নিতে হবে। সিইজিআইএসের তথ্য বলছে, গত কয়েক দশকের ব্যবধানে দেশে নদীভাঙন কিছুটা কমে আসছে। ১৯৯০ সালের দিকে দেশে নদীভাঙনে বিলীন হয় প্রায় ১০ হাজার হেক্টর, যা এখন দুই-তিন হাজার হেক্টরে নেমে এসেছে। গত চার-পাঁচ বছর ধরেই এই ভাঙন কমছে। মূলত যমুনা নদীর পার ঘিরে বাঁধ তৈরির কারণে এই সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। ২০২১ সালে দেশের প্রায় তিন হাজার হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হয়। চলতি বছরে উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১২ জেলার এক হাজার ৮০০ হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছে সিইজিআইএস। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ১৮ হাজার মানুষ। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, রাজবাড়ী ও মাদারীপুর সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দুর্যোগবিষয়ক পরিসংখ্যান (বিডিআরএস) বলছে, ‘২০২১ : ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ন্যাচারাল ডিজাস্টার পারসপেকটিভ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী দেশে নদী ও উপকূলের ভাঙনে ক্ষতির শিকার হওয়া পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া নদী ও উপকূলের ভাঙনে ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা।

Leave A Comment

To Top