দুই বছরে চালের দাম বেড়েছে ৪৭%

September 21, 2023 0 Comments

সবশেষ আমন মৌসুমে দেশে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারের গুদামে বর্তমানে ১৭ লাখ টনের বেশি চাল মজুদ রয়েছে, যা অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় সরকারের চালের মজুদের রেকর্ড। এর পরও বাজারে চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে আসছে না। সাধারণ মানের মোটা চালের দামও এখন অনেক মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। একটি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের জানুয়ারির খুচরা পর্যায়ের গড় দামের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক কৃষি বিভাগ ইউএসডিএ প্রকাশিত গ্রেইন অ্যান্ড ফিড আপডেট শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে খুচরা বাজারে সাধারণ মানের (মোটা চাল) প্রতি কেজি চালের গড় দাম ছিল ৩২ টাকার কিছু বেশি। সেই চালের দাম এ বছর হয়েছে ৪৭ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাত্ দুই বছরের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। অথচ ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে সাধারণ মানের চালের প্রতি কেজিতে গড় দাম ছিল ৩৬ টাকা। সেটি বেড়ে ২০১৮ সালে ৪৭ টাকার বেশি ছাড়িয়ে যায়। কয়েক দফা ওঠানামার পর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সর্বনিম্ন পর্যায়ে আসে। এরপর আবারো বাড়তে থাকে চালের দাম। সেই বছর নভেম্বরেই ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি কেজি চালের গড় দাম ৪৮ টাকা ছাড়িয়ে যায়। গত বছরের মে ও সেপ্টেম্বরে সাধারণ মানের চালের দাম ৪৯ টাকায় উন্নীত হয়, যা জানুয়ারিতে ৪৭ টাকা ৫০ পয়সায় নেমে আসে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর সবচেয়ে বেশি অভিঘাত পড়ে। চালের মূল্যস্ফীতি দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দেয়। আর কভিডকালে এ মূল্যস্ফীতি দ্বিমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সরকারের দুর্বল মজুদ ব্যবস্থাপনা ও খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থায় অপর্যাপ্ততার কারণে বাজারের নিয়ন্ত্রকসংশ্লিষ্টরা সুযোগ নিচ্ছেন। আমদানি ও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমে চালের মজুদ ও সরবরাহ পরিস্থিতি দ্রুত উন্নতি করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাজারে চালের সরবরাহে সংকট তৈরি না হলেও দাম অস্থিতিশীল। মূলত বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগীদের অনিয়ন্ত্রিত উত্থান, কার্যকর ও দক্ষ সরবরাহ চেইন না থাকা, চালের মজুদ ধারাবাহিকভাবে উচ্চপর্যায়ে না রাখা ও মনিটরিংয়ের অভাবে চালের বাজারে দাম অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৪৪-৪৮ টাকা। অন্যদিকে ভালো মানের চাল বিক্রি হয়েছে ৬০-৬৮ টাকায়। সরকারের শুল্ক সুবিধার মাধ্যমে চাল আমদানি করা, সরকারের মজুদ বেশি থাকা সত্ত্বেও চালের দাম খুব বেশি না কমার পেছনে মিলার ও ব্যবসায়ীদের একচ্ছত্র প্রভাবকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে ইউএনডিপির অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের মজুদ বেড়েছে। সরবরাহ বাড়াতে শুল্ক কমানো হয়েছে। এসব নানা উদ্যোগ নিয়েও বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। দেশের বড় ৫০টি অটো রাইস মিলের হাতেই থাকে বেশির ভাগ ধান-চালের মজুদ। তারা প্রচলিত আইন না ভেঙেই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। ফলে মজুদ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে। স্বাভাবিক আইনে অটো রাইস মিলগুলো চলার মতো ধান দেশে আছে কিনা সেটি ভাবতে হবে। ফলে কয়টা অটো রাইস মিলকে অনুমোদন দেয়া হবে এবং এসব মিলের উত্পাদন সক্ষমতা কতটুকু হবে, সে বিষয়ে সীমা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। তা না হলে কোনো ধরনের আইনের ব্যত্যয় না ঘটিয়েই চালের সব নিয়ন্ত্রণ এদের হাতে চলে যাবে।

চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত বছরের ১২ আগস্ট চাল আমদানির শুল্ক কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চালের আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। এ সুবিধা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। যদিও চাল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক বিরাজ করা হয়েছিল দেশীয় কৃষকদের সুবিধার জন্য। তবে চালের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণে ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্ব্বর বেসরকারিভাবে চালের আমদানি শুল্ক কমানোর অনুমতি দেয়া হয়। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শুল্কহার ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এরপর দেশে চালের আমদানি বেড়েছে ব্যাপক হারে। ২০২০-২১ অর্থবছরে চালের আমদানি হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ ৫৯ হাজার টন। এছাড়া চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চালের আমদানি হয়েছে ৯ লাখ ২৪ হাজার টন।

এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে চালের দাম নির্ধারণ ও বিপণন প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগী বিশেষ করে মিলাররা ভীষণ শক্তিশালী ও পারদর্শী। কেননা বাজার তৈরি ও নিয়ন্ত্রণে কৃষকের কোনো ধরনের সাংগঠনিক সক্ষমতা নেই। সরকারের কর্তৃপক্ষ হিসেবে খাদ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই পর্যাপ্ত দক্ষতা ও হাতিয়ার। তাই সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। চালের সরবরাহ চেইনে আরো দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। পাশাপাশি কৃষকের মজুদ ক্ষমতা বাড়ানো ও তথ্য সরবরাহের ওপরও জোর দেয়ার কথা বলেন।

বিভিন্ন মাধ্যম সঠিক নীতির অভাবে চাল কেনার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হতে দেখা যায় জানিয়ে তিনি বলেন, বাজার থেকে ধান না কেনার কারণে ধানের বাজারের একচ্ছত্র আধিপত্য মিলারদের কাছেই তুলে দেয়া হয়। ধানের এত বড় বাজার এককভাবে ব্যবসায়ী ও মিলারদের কাছে রাখা মোটেও যৌক্তিক নয়।

সরবরাহ চেইনের সমস্যাগুলো দূর করার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এসব দূর হলে মধ্যস্বত্বভোগীরা অযৌক্তিক আচরণ করতে পারবে না। এজন্য সরকারের মজুদ সক্ষমতা বাড়ানো, কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার প্রচলন করতে হবে। পাশাপাশি চিকন ও মোটা দানার চালের জন্য সরকারের আলাদা ন্যূনতম সহায়তা মূল্য (এমএসপি) ঘোষণা করা প্রয়োজন। খাদ্য অধিদপ্তর যেন মোট উত্পাদনের প্রায় ১০ শতাংশ সংগ্রহ করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে সেটি খেয়াল রাখতে হবে। আবার মিলাররা তাদের মুনাফা দেখানোর ক্ষেত্রে অনেক সময় উপজাত দ্রব্য ভালো দামে বিক্রি করলেও সেটির হিসাব না দেখিয়ে বলে থাকেন তাদের মুনাফা হচ্ছে না। এর মাধ্যমে তারা সরকারের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেন।

এর আগে গত মঙ্গলবার রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অবৈধ মজুদদারি রোধে করণীয় ও বাজার তদারকি-সংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ার করেছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। বাজারে পর্যাপ্ত চাল থাকা ও সরকারের কাছে মজুদ থাকা সত্ত্বেও চালের দাম বাড়ানো যৌক্তিক নয় বলে জানিয়েছেন তিনি। মিলারদের সতর্ক করে তিনি বলেন, গত বছর আম্পানে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তখন চালের দাম বাড়েনি। অথচ ভালো ফলন ও আমনের ভরা মৌসুমে দাম বাড়ছে। চালের দাম যেন না বাড়ে তা নিশ্চিত করতে আপনাদের ভূমিকা দেখতে চাই। শুধু মুনাফার উদ্দেশ্যে ব্যবসা না করে ভোক্তাদের স্বস্তি দিন। যারা ভাবছেন চাল ধরে রেখে বেশি মুনাফা করবেন তা হতে দেয়া হবে না। প্রয়োজন হলে চাল আমদানি করা হবে। আমাদের ফাইল রেডি আছে। মিল মালিকরা কী পরিমাণ ধান কিনছেন, স্টক করছেন ও ক্রাশিং করছেন তার হিসাব করছি আমরা। সে অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Leave A Comment

To Top