চালের মূল্যস্ফীতি জাতীয় গড়ের দ্বিগুণেরও বেশি

September 21, 2023 0 Comments
দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চাল। এখনো দেশের দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের মোট আয়ের সিংহভাগ ব্যয় হয় চালের পেছনে। আবার স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনধারণের প্রধান অবলম্বন খাদ্যশস্যটিরই দাম বাড়ে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, এ সময় জাতীয় গড় মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশের মধ্যেই ওঠানামা করেছে। যদিও এ সময় দানাদার খাদ্যশস্য, বিশেষ করে চালের মূল্যস্ফীতির হার প্রায় সাড়ে ১২ থেকে শুরু হয়ে ১৫ শতাংশও ছাড়িয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষের চাল ভোগের পরিমাণ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের চেয়ে অনেক বেশি। সে হিসেবে চালের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় দরিদ্ররাই। যদিও বাজারের বড় প্রভাবকদের মধ্যে প্রায়ই নানা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পণ্যটির মূল্য অস্থিতিশীল করে তোলার প্রবণতা দেখা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে জাতীয় মূল্যস্ফীতির চেয়ে চালের মূল্যস্ফীতি ছিল দ্বিগুণেরও বেশি। কখনো কখনো তা তিন গুণের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গড় মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চে উঠেছিল জুনে। ওই সময় গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। যদিও এ সময় চালের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। পরের মাস জুলাইয়ে গড় মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশে নামলেও চালের মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৮২ শতাংশে। এছাড়া এপ্রিল ও মে মাসে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৫৬ ও ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। যদিও এ দুই মাসে চালের মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৪৫ ও ১২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। অন্যদিকে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৫৪ ও ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। চালের মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৬২ ও ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে চালনির্ভরতা আয়ভিত্তিক অন্যান্য শ্রেণীর চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে উঠে এসেছে, দেশে খানাপিছু গড় মাসিক আয় ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশই যায় খাদ্য কেনায়। দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে মাসিক মোট আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় হয় খাদ্যের পেছনে। আবার এ জনগোষ্ঠীর চাল ভোগের পরিমাণও অন্যদের চেয়ে বেশি। দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চালের মাথাপিছু দৈনিক ভোগ ৪৭০ গ্রাম, যেখানে অন্যদের ক্ষেত্রে তা ৩৬৬ গ্রাম। প্রধান খাদ্যশস্যটির মূল্যস্ফীতির বোঝাও আবার তাদের জন্যই সবচেয়ে ভারী হয়ে দেখা দেয় বলে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। চালের মূল্যস্ফীতিকে দরিদ্র ও নাজুক জনগোষ্ঠীর প্রকৃত আয় কমে যাওয়ারই নামান্তর বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বিভিন্ন পরিসংখ্যান পর্যালোচনার ভিত্তিতে তারা বলছেন, চাল ও দানাদার খাদ্যশস্যের দাম বাড়লে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়। খাদ্য ব্যয় বাড়লে তা নির্বাহের পর অবশিষ্ট টাকা দিয়ে অন্যান্য খরচ মেটাতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। বিপন্ন হয় পুষ্টিনিরাপত্তা, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অন্যান্য প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিতের বিষয়টিও। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ‘বাংলাদেশ ফুড মার্কেট পারফরম্যান্স: ইনস্ট্যাবিলিটি, ইন্টিগ্রেশন অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনস’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, খাদ্যমূল্যস্ফীতি বাড়লে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারগুলো। ৭০ শতাংশের বেশি হতদরিদ্র পরিবার তখন চালের ভোগ কমিয়ে দেয়। শুধু দরিদ্রদের বেলায় এ হার ৬৬ শতাংশ। দরিদ্র ও অতিদরিদ্রের বাইরে মধ্যবিত্তরাও খাদ্যমূল্যস্ফীতি দিয়ে প্রভাবিত হয়। এ শ্রেণীর প্রায় ২৪ শতাংশ পরিবার ভোগ কমিয়ে দেয়। কারণ পরিবারের অন্যান্য ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হয় তাদের। আবার খাদ্যচাহিদা মেটাতে গিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয়ে পিছিয়ে পড়ে তারা। দরিদ্র বা অতিদরিদ্র শ্রেণীর পরিবারগুলো তাদের উপার্জনের ৫০-৭০ শতাংশ ব্যয় করে খাদ্য বাবদ। এর আবার সিংহভাগ ব্যয় হয় চাল কেনায়। ফলে চালের দাম বাড়লে বাধ্য হয়ে এ শ্রেণীর মানুষ ভোগ কমিয়ে দেয়। এর প্রভাব পড়ে দৈনন্দিন পুষ্টিচাহিদায়। এতে একদিকে পুষ্টিহীনতায় ভোগা পরিবারের সংখ্যা বাড়ে, অন্যদিকে দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা সম্ভব হয় না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, মূল্যস্ফীতি একটি দেশের সাধারণ পর্যবেক্ষণ হলেও দরিদ্র ও স্বল্প আয়, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বা নির্ধারিত আয়ের মানুষের ওপর এর প্রভাব অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। কোনো কোনো নিম্ন ও দরিদ্র মানুষের মোট আয়ের ৩০-৫০ শতাংশই ব্যয় হয় চাল কেনায়। চালের দাম বাড়লে এর অভিঘাত সবচেয়ে বেশি পড়ে কম আয়ের মানুষের ওপর। চালের মূল্যস্ফীতি দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দিচ্ছে। আর কভিডকালে এ মূল্যস্ফীতির নানামাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এসব মানুষের ওপর চালের মূল্যস্ফীতির অভিঘাতটা জাতীয় মূল্যস্ফীতির চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হবে। সরকারের দুর্বল মজুদ ব্যবস্থাপনা ও খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থায় অপর্যাপ্ততার কারণে বাজারসংশ্লিষ্টরা সুযোগ নিয়েছে। আমদানি ও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমে চালের মজুদ ও সরবরাহ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি করতে হবে। সেটি করতে না পারলে সামনে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। মানুষের দুর্গতিও আরো বাড়বে। তবে বোরো মৌসুম শুরু হলে চালের মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে নামতে পারে। তার আগ পর্যন্ত দরিদ্র মানুষের জন্য স্বল্পমেয়াদে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার ও খোলাবাজারে খাদ্যপণ্য বিক্রিসহ রেশন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এছাড়া মধ্যমেয়াদে খাদ্য আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ বাড়িয়ে দাম কমানোর উদ্যোগও নেয়া যেতে পারে। বিবিএসের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজধানীতে প্রতি কেজি নাজিরশাইল ও মিনিকেটের গড় দাম ছিল ৬৮ টাকা ১৫ পয়সা, যা চলতি অর্থবছরের আগস্টে ৬৯ টাকা ৫০ পয়সা, সেপ্টেম্বরে ৬৯ টাকা ৭৩ ও অক্টোবরে ৬৯ টাকা ৭৭ পয়সায় উন্নীত হয়েছে। গত অর্থবছরে বোরো ধানের চালের গড় দাম ছিল ৫২ টাকা ২ পয়সা। সেখান থেকে বেড়ে আগস্টে তা ৫২ টাকা ৮৬ পয়সা, সেপ্টেম্বরে ৫২ টাকা ৯৭ ও অক্টোবরে ৫৫ টাকা ৯৯ পয়সায় উন্নীত হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, চালের দাম বেশি হওয়ার অভিঘাত কম আয়ের মানুষের কাছে নানামুখী হতে পারে, এটি নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তাদের ওপর অভিঘাতের ভারটা একটু বেশিই হবে। তাই চালের দাম আরো একটু কম হলে ভালো হতো বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। সেজন্য সরকার পরিকল্পনামাফিক কাজ করছে। বিশেষ করে অন্যায় হস্তক্ষেপ করে কেউ যেন চালের দাম বাড়তে না পারে, সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। উৎপাদনের মাধ্যমে সরবরাহ বাড়াতে কৃষি মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করছে। তাদের কার্যক্রমের সফলতাও দৃশ্যমান। দরিদ্র মানুষের সুযোগ-সুবিধাও বাড়ানো হচ্ছে। আবার আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ বাড়াতে শুল্ক সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এখানে বাজার ব্যবস্থাপনা ও কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করেই আমরা পদক্ষেপগুলো নিচ্ছি।

Leave A Comment

To Top