চার দশকে দেশের ক্ষতি ১ লাখ কোটি টাকা

September 21, 2023 0 Comments

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গোটা বিশ্বেই এখন নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বেড়েছে। বাংলাদেশকেও গত চার দশকে অসংখ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলা করতে হয়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী এ ৪০ বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে দেশের মোট ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ, বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকায়।

বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বাড়ছে। গলছে মেরু অঞ্চলের বরফ। বিপত্সীমা ছাড়াচ্ছে সাগর ও নদীর পানি। তলিয়ে যাচ্ছে নিচু অঞ্চল। বাড়ছে ভারি বৃষ্টিপাত, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপও। বসতভিটা ছেড়ে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর অর্থনীতিতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত এরই মধ্যে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশের অর্থনীতিসহ বিভিন্ন খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিরূপণে একটি গবেষণা চালিয়েছে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (সিইজিআইএস)। এর ভিত্তিতে একটি জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (এনএপি) প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

এতে উঠে এসেছে, দেশে প্রতি বছর শুধু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির পরিমাণই দাঁড়ায় মোট জিডিপির দশমিক ৫ থেকে ১ শতাংশে। ২০৫০ সাল নাগাদ এ ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে জিডিপির ২ শতাংশে।

এনএপি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ বছরে দেশে সুপার সাইক্লোন বেড়েছে ৬ শতাংশ। প্রতি বছর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে দশমিক শূন্য ১৫ সেন্টিগ্রেড হারে। বার্ষিক বৃষ্টিপাত বেড়েছে ৮ দশমিক ৪ মিলিমিটার। গত কয়েক দশকে দেশে ভয়াবহ ও মারাত্মক বন্যা হয়েছে পাঁচটি। এছাড়া দেশের পাহাড়ী এলাকা ও উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোয় ঢল ও বজ্রপাতের প্রকোপ বেড়েছে। এছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে বার্ষিক ৩০৬ মিলিমিটার করে।

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির দিক থেকে সবচেয়ে সামনের সারিতে থাকা দেশগুলোর অন্যতম হলো বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত প্রশমন এবং এর সঙ্গে অভিযোজনের জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ প্রয়োজন। যথোপযুক্ত পরিকল্পনা ও বিনিয়োগ না থাকলে দেশকে সুরক্ষা দেয়া কঠিন হবে। এরই মধ্যে দেশে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি বাড়তে শুরু করেছে। যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে সামনের দিনগুলোয় তা আরো মারাত্মক আকার নিতে পারে।

সিইজিআইএসের প্রণীত এনএপিটি বাস্তবায়নে  আগামী ২৭ বছরে অন্তত ৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলার প্রয়োজন হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। তবে চূড়ান্ত পর্যায়ে তা হাজার কোটি ডলারও ছাড়াতে পারে। এ বিষয়ে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ খান বলেছেন, অভিযোজন পরিকল্পনা সারাদেশকে ১১টি জোনে ভাগ করে ১৩টি জলবায়ু ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, ঘুর্ণিঝড়, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও নদীভাঙনসহ অন্যান্য দুর্যোগ। ঝুঁকিগুলো নিয়ন্ত্রণে এনএপিতে ছয়টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সংকট মোকাবেলায় ১৩টি থিমেটিক এরিয়া চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে পানি ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে কৃষি, মত্স্য ও বাস্তুসংস্থানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব এরিয়া থেকে ১০৯টি সম্ভাব্য পদক্ষেপকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে ৫০টিকে অগ্রাধিকারযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে আবার ১৫টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, সামনের দিনগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের পূর্বের ক্ষতির তুলনায় সামনের দিনে আরো বেশি ক্ষতির শিকার হবে বাংলাদেশ। সমুদ্রের পানির উচ্চতা ৫০ সেন্টিমিটার বাড়লেই উপকূলের ১০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যাবে। লবণাক্ততা ছড়াতে পারে ৭ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত। ৯৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়লে তলিয়ে যাবে উপকূলের ১৭ শতাংশ এলাকা। লবণাক্ততা ছড়াতে পারে ১৬ হাজার ৩০০ কিলোমিটারে উন্নীত হবে।

এ বিষয়ে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যারয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং এনএপি বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান ড. আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উষ্ণায়ন ২ ডিগ্রির মধ্যে রাখার কথা বলা হলেও ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেইঞ্জ (আইপিসিসি) বলছে, তা ৩ থেকে সাড়ে ৩ ডিগ্রিতে চলে যাবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে খাদ্য সংকট দেখা দিবে। আবহাওয়া ও জলবায়ুর যে পরিবর্তন হচ্ছে তাতে উপকূলের প্রায় তিন কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের কৃৃষিকাজও নানাভাবে ব্যাহত হবে। আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা বেড়েছে। এছাড়া সমুদ্রের পানিও বাড়ছে। পানিতে নোনাভাব বেশি হচ্ছে। এতে বিশুদ্ধ পানির অভাব দেখা দিচ্ছে। এখনই বৃষ্টির অভাবে শ্রীমঙ্গলে চায়ের উৎপাদন কমে গেছে। লালমনিরহাটে আমন ধান লাগানো যায়নি। থেমে থেমে বৃষ্টি হয় বলে আগামীতে ম্যালেরিয়া বাড়বে। এজন্য এনএপি বাস্তবায়নে এখনই মাস্টারপ্ল্যান দরকার। বরিশাল, গোপালগঞ্জ, ঝালকাঠি, মাদারিপুর, ফরিদপুর ও শরিয়তপুর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। পোড়ানো ইটের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব ব্লক ইটের ব্যবহার বৃদ্ধিতে পরিকল্পনা প্রয়োজন। গত বছর রংপুরে ৪৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এ পরিমাণ বৃষ্টিপাত ঢাকায় হলে পুরো শহর তলিয়ে যাবে। এজন্য আলাদা জলবায়ু আইন দরকার।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় ৪ হাজার বর্গকিলোমিটার ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা আকস্মিক বন্যার শিকার হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার উপকূলীয় অঞ্চল। লোনা পানির অনুপ্রবেশ বাংলাদেশের একটি মারাত্মক সমস্যা। ১৯৭৩ সনে ১৫ লাখ হেক্টর জমি মৃদু লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়, যা ১৯৯৭ সনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ হেক্টেরে। বর্তমানে এর পরিমাণ প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর। উজান থেকে পানিপ্রবাহ বাধা ও কম বৃষ্টিপাতের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশের মোট উপকূলীয় এলাকা প্রায় ২৫ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততায় আক্রান্ত। এর ফলে প্রতি বছর গড়ে ৩৫ লাখ টন শস্য বঞ্চিত হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীরই ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, জলবায়ুর ঝুঁকিগুলোকে মাথায় রেখেই সামনের দিনগুলোয় আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনা সাজাতে হবে। এছাড়া মনুষ্যসৃষ্ট ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হবে। বিশেষ করে মাটির টপ সয়েল রক্ষা করতে হবে। এজন্য ইটের পরিবর্তে ব্লক ইট ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করবে পরিকল্পনা বিভাগ। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এটি দূর করতে সমন্বিতভাবে কাজ করা হবে।

Leave A Comment

To Top