কৃষির উন্নতিতে বড় বাধা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ড জমি

September 24, 2023 0 Comments
ছোট ছোট আইলে খণ্ডিত জমি। জমির আয়তন এতই ছোট যে সেখানে ট্রাক্টর ও কম্বাইন হারভেস্টরের মতো বড় কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের জো নেই। পদে পদে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয় সেচে, হয় না সারের সুষম প্রয়োগ। বছরের পর বছর ধরে এভাবেই চলছে দেশের কৃষি উৎপাদন। পারিবারিক ভাগ-বাঁটোয়ারায় ছোট থেকে আরো ছোট হচ্ছে কৃষি খামারের আকার। ফলে বাড়ছে কৃষকের খরচ, কমছে শস্যের নিবিড়তা ও উৎপাদনশীলতা। বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাঁচপীর প্রতাপপুর গ্রামের কৃষক আব্দুস বাসেদ। ১০ শতক জমিতে আমন ধান চাষ করার সময় কৃষিযন্ত্র ব্যবহার করতে পারেননি তিনি। অন্যের জমি মাড়িয়ে আসতে হবে বলে ধান কাটার সময়েও যন্ত্রের সাহায্য নিতে পারবেন না। সেচের ক্ষেত্রেও একই সমস্যায় রয়েছেন এ কৃষক। অন্যের জমির আইল কেটে সেচের পানি নিয়ে আসতে হয় তাকে। এ সমস্যার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দুটির বেশি শস্য আবাদে আগ্রহ পান না তিনি। শুধু আব্দুস বাসেদ নন, কৃষি খামারের ক্ষুদ্রাকৃতির কারণে যন্ত্রের ব্যবহার করতে পারেন না দেশের সিংহভাগ কৃষক। ফলে ধান রোপণ থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরে শ্রমিকের ওপর নির্ভর করতে হয় তাদের। এতে বেড়ে যায় কৃষকের উৎপাদন খরচ। বাংলাদেশের কৃষি নিয়ে গত বছর একটি গবেষণা পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফপ্রি)। সেই গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৮ সালে যেসব কৃষক বোরো আবাদ করেছেন জমির পরিমাণের দিক থেকে তাদের প্রায় ৮৩ শতাংশই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক। ওই বছর শূন্য দশমিক ৫ একরের নিচে জমি আবাদ করেছেন ৩৬ শতাংশ কৃষক, যাদের প্রান্তিক কৃষক বলা হয়। শূন্য দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৪৯ একরের কম আকারের জমি আবাদ করেছেন মোট কৃষকের ৪৭ শতাংশ, যাদের বলা হচ্ছে ক্ষুদ্র কৃষক। মাত্র ৫ শতাংশ কৃষক ২ দশমিক ৫ একর বা তার বেশি পরিমাণ জমিতে আবাদ করেছেন ওই বছর। ক্ষুদ্র খামার হওয়ার কারণে দেশের সিংহভাগ কৃষকই জমিতে কৃষিযন্ত্র ব্যবহার করতে পারেন না। এর ফলে শস্য খাতে উৎপাদনশীলতা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে না, তেমনি শস্যের নিবিড়তা বৃদ্ধিতেও এক ধরনের স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। বাড়তি উৎপাদন খরচ ও উন্নত প্রযুক্তির সম্প্রসারণে বাধার কারণে মুনাফা হচ্ছে না কৃষকের। শস্য আবাদে মোট খরচের এক-তৃতীয়াংশের বেশি খরচ হয় মজুরিতে। সেই মজুরি কয়েক বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে কৃষকের উৎপাদন খরচ। মুনাফাহীনতায় অধিক শস্য আবাদে আবার আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষক। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, কৃষকের আগ্রহ কমে যাওয়া ও যথাযথ পরিচর্যার অভাবে কমে যাচ্ছে হেক্টরপ্রতি উৎপাদনশীলতা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, হেক্টরপ্রতি উৎপাদনশীলতা কমার কারণেই বিভিন্ন শস্যের মোট উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি অনেকটাই গতিহীন। বেশকিছু শস্যে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক পর্যায়ে চলে এসেছে। অর্থাৎ উৎপাদন বৃদ্ধি না পেয়ে উল্টো কমে গেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতি হেক্টর জমিতে চাল উৎপাদন ছিল ৩ দশমিক ১২ টন। দেশের এ প্রধান শস্যে উৎপাদনশীলতা খুব বেশি বৃদ্ধি না পাওয়ায় উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরকে ভিত্তিবছর বিবেচনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ধানে উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ৩ দশমিক ২৮ টন হলেও প্রবৃদ্ধি এখন নেতিবাচক পর্যায়ে রয়েছে গমে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শস্যটির উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ছিল মাইনাস ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া একই সময়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল আলু, তেল ও ডালজাতীয় শস্য, কাঁঠাল, মিষ্টি আলু ও পেয়ারায়। দেশে এখনো হেক্টরপ্রতি ডাল উৎপাদন মাত্র ১ দশমিক ২৭ টন, তেলবীজ উৎপাদন ১ দশমিক ৩৪ টন। এসব শস্যের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি না পাওয়ার কারণে উৎপাদনের গতিও বাড়ছে না। ফলে চাহিদা বেশি থাকায় আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে এসব পণ্যে। যুক্তরাজ্যের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (সোয়াস) ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনার ওপর পিএইচডি করেছেন ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘অ্যাকিউমুলেশন, ল্যান্ড ট্রানজেকশনস অ্যান্ড দ্য অ্যাগ্রারিয়ান ট্রানজিশন ইন বাংলাদেশ’। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও উন্নয়ন অন্বেষণের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বণিক বার্তাকে বলেন, গত কয়েক দশকের ব্যবধানে দেশের কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিহীনতার ক্ষেত্রে প্রধান বাধাই হলো জমির খণ্ড-বিখণ্ডতা। সাধারণত জমির মালিকানা পরিবর্তিত হয় বাজার ব্যবস্থাপনা ও জমির উৎপাদনশীলতার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বাংলাদেশে উত্তরাধিকার সূত্রে জমির মালিকানা পরিবর্তনের কারণে মানুষজন জমিকে সঞ্চয় হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর চেয়ে জমির ভাড়া প্রদানের মাধ্যমে আয়ে বেশি মনোযোগ থাকে জমির মালিকদের। এতে জমির প্রতিযোগিতা হারিয়ে যাচ্ছে। পারিবারিক কারণে জমির খণ্ডতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জমি ছোট হওয়ার কারণে ইকোনমিক স্কেল হচ্ছে না। জমি ছোট হচ্ছে, উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে কৃষকের খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন প্রয়োজন। সেটি করতে হলে জমি সংস্কার ও কাঠামোগত সংস্থার প্রয়োজন। সেটির জন্য অবশ্যই রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। দেশের আবাদি জমির সিংহভাগেই বোরো ধান আবাদ হয়। বোরো আবাদে কৃষকের হেক্টরপ্রতি লোকসান এখন প্রায় ৬ হাজার টাকা। এ লোকসানের অন্যতম কারণ শ্রমিক ব্যয়। পারিবারিক ও ভাড়া করা শ্রমিকের পেছনে ব্যয় হচ্ছে মোট খরচের প্রায় ৪৬ শতাংশ। এর মধ্যে ভাড়া শ্রমিকের জন্য ব্যয় ৩৬ শতাংশ, সেচে ২২ শতাংশ, সারে ১৬ শতাংশ, কীটনাশকে ৪ ও ইকুইপমেন্টে খরচ হচ্ছে প্রায় ৯ শতাংশ। কিন্তু ধান কাটা থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে যান্ত্রিকীকরণ করতে পারলে কৃষকের বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব। কেননা কম্বাইন হারভেস্টারের মাধ্যমে জমির ধান কাটা থেকে মাড়াই ও বস্তবন্দি করে বাড়িতে নিয়ে আসা পর্যন্ত কৃষকের খরচের ও সময়ের বড় ধরনের সাশ্রয় করে। এ যন্ত্রের মাধ্যমে খরচ ৬০-৬৫ শতাংশ এবং সময় প্রায় ৭৫ শতাংশ বাঁচতে পারে। আবার প্রথাগতভাবে ধান কাটা ও মাড়াই করলে সেই ধানের ১২-১৫ শতাংশ নষ্ট হয়। যন্ত্রের মাধ্যমে সেই কাজ করলে ক্ষতির পরিমাণ ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব। তাই কৃষকের উৎপাদন খরচ কমিয়ে মুনাফা বৃদ্ধি ও শস্য খাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে হলে যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই। এ বিষয়ে এসিআই এগ্রিবিজনেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ড. ফা হ আনসারী বণিক বার্তাকে বলেন, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ এখন শুধুই উৎপাদনকেন্দ্রিক আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার এখন বহুমুখী বিষয়কে কেন্দ্র করে এগিয়ে নিতে হবে। বিশেষ করে যন্ত্রের মাধ্যমে কীভাবে তরুণ কর্মসংস্থানকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। শস্যের নিবিড়তা বাড়ানোর মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি পেতে পারে। পাশাপাশি শস্যের মধ্যে ইন্টারক্রপিং গ্যাপ কমিয়ে এনে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারে। এটা প্রমাণিত যে বর্তমান সময়ে কৃষিতে শ্রমিকের সংকট রয়েছে। ফলে শ্রমিক সংকট মোকাবেলায় যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। যন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকের পণ্য সঠিক পরিমাণে ঘরে তুলতে পারলে তার মুনাফায় কোনো ধরনের ব্যত্যয় হবে না। এতে কৃষক যদি বাড়তি আয় করতে পারে তাহলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে তার একটি বহুমুখী প্রভাব আমরা দেখতে পাব। ১৯৩৮ সালের ফ্লাউড কমিশন রিপোর্ট, বেঙ্গল ফেমিন ইনকোয়ারি রিপোর্ট ১৯৪৪, রুরাল বেঙ্গল সার্ভে ও আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জমির আকার সময়ের ব্যবধানে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়েছে। ফ্লাউড কমিশনের ১৯৩৮ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পূর্ব বাংলায় জমির আকার বা আয়তন ২ একরের নিচে এমন পরিবার ছিল তখন ৪৬ শতাংশ। জমির আকার ২-৫ একর এমন পরিবার ছিল ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ। জমির আকার ৫-১০ একর এমন পরিবারের সংখ্যা ছিল ১৭ শতাংশ। জমির আকার ১০ একরের ওপরে এমন পরিবার ছিল ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। এরপর রুরাল বেঙ্গল সার্ভে ১৯৪৬ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জমির আকার বা আয়তন ২ একরের নিচে এমন পরিবার ছিল ৬৭ দশমিক ৩ শতাংশ। জমির আকার ২-৫ একর এমন পরিবার ছিল ২১ দশমিক ২ শতাংশ। জমির আকার ৫-১০ একর এমন পরিবার ছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ১০ একরের ওপরে জমির মালিক এমন পরিবার ছিল ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ও কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সাবেক সভাপতি ড. শামসুল আলম এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, উত্তরাধিকার আইনের কারণেই জমির খণ্ড-বিখণ্ডতা বাড়ছে, যা আধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তিনির্ভর চাষাবাদে বাধা সৃষ্টি করছে। একজনের জমি মাড়িয়ে বা আইলের ওপর দিয়ে কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রাদি জমিতে নিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন। ফলে ছোট জমিতে বিনিয়োগহীনতার কারণে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এ অবস্থায় আমাদের ক্রমান্বয়ে বৃহৎ খামারে যেতেই হবে। বৃহৎ জমি নিয়ে যেকোনো কৃষিভিত্তিক খামার করতে চাইলে আইনি বাধা ও অর্থায়ন ঘাটতি দূর করতে হবে। পাশাপাশি প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রিত ও বাণিজ্যিক কৃষিকে এগিয়ে নিতে সব ধরনের নীতিসহায়তা বিদ্যমান রাখতে হবে।

Leave A Comment

To Top