কৃষিপণ্যের দামে অস্থিতিশীলতায় শীর্ষে পেঁয়াজ

September 24, 2023 0 Comments

দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে প্রায় ২৪ লাখ টন। পণ্যটির উৎপাদন মূলত একটি মৌসুমভিত্তিক হওয়ায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পেঁয়াজে পুরো চাহিদা মেটে না। প্রতি বছর ৮-১০ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। আর এতেই প্রায় প্রতি বছর অস্থিতিশীলতা দেখা দেয় কৃষিপণ্যটির দামে।

মূলত আমদানির উৎস দেশগুলোয় মূল্যবৃদ্ধি বা শুল্কারোপের ফলে দেশে বছরের শেষ তিন মাসে মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পায় পেঁয়াজের দাম। গত এক দশকের ব্যবধানে পণ্যটির দামের ওঠানামা করেছে প্রায় ১৯ শতাংশ হারে। আর ২০১৮ সালেই স্থানভেদে পণ্যটির দামের পার্থক্য ছিল প্রায় ৭০ শতাংশ।

প্রতি বছরই দামের অস্থিতিশীলতা দেখা দেয় এমন আরেকটি কৃষিপণ্য হলো মরিচ। বিশেষ করে বন্যার সময় মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায় মরিচের দাম। এক দশকের ব্যবধানে এ পণ্যটির দামের ওঠানামা হয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। ২০১৮ সালেই স্থানভেদে মরিচের দামে পার্থক্য ছিল ৬০ শতাংশ। দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলমান বন্যার প্রভাবে বর্তমান বাজারেও অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে মরিচের দামে। স্বাভাবিক সময়ে পণ্যটির দাম ১০০ টাকার নিচে থাকলেও বন্যায় সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেয়ায় এখন  মরিচের দাম প্রতি কেজি ৩০০ টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু মরিচ বা পেঁয়াজ নয়, কৃষিজ পণ্যের দামের ওঠানামার তালিকায় রয়েছে আলু, কলা, আম ও ডালজাতীয় পণ্যও।

সম্প্রতি ১১টি কৃষিপণ্যের দামের অস্থিতিশীলতা নিয়ে একটি গবেষণা চালিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সেখানে ২০০৮-১৮ সময়ে এসব পণ্যের দামের পার্থক্য কেমন ছিল এবং ২০১৮ সালে এসব পণ্যের স্থানভেদে দামের পার্থক্য ও ওঠানামা কেমন ছিল তা দেখানো হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, ২০১৮ সালে স্থানভেদে ৫২ শতাংশ ওঠানামা করেছে আলুর দাম। ২০০৮ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে পণ্যটির দামের ওঠানামার হার ছিল প্রায় ১৭ শতাংশ। অন্যদিকে গত ১০ বছরের ব্যবধানে কলার দাম ওঠানামা করেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। স্থানভেদে পণ্যটির দামের ওঠানামার হার ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। এছাড়া তেলজাতীয় শস্যের দামে ওঠানামার হার গত ১০ বছরে ১২ শতাংশের মধ্যেই ছিল। ২০১৮ সালে স্থানভেদে পণ্যটির দামের পার্থক্য ছিল ১৩ শতাংশ। গত ১০ বছরে ডালজাতীয় শস্যের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ ওঠানামা করেছে। ২০১৮ সালে স্থানভেদে পণ্যটির দামের পার্থক্য ছিল ১৭ শতাংশ। ফলের মধ্যে এক দশকে আমের দামের পার্থক্য ছিল ১৭ শতাংশ এবং স্থানভেদে ২০১৮ সালে দামের পার্থক্য ছিল ২২ শতাংশ। বেগুনের দামের পার্থক্য ছিল গত ১০ বছরে প্রায় ২৩ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রে যে অঞ্চলে পণ্যটির উৎপাদন হচ্ছে সেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সরবরাহে বাধা বাজারে পণ্যটির দাম অস্থিতিশীল করে তোলে। যেমন বেগুন ও মরিচের উৎপাদনকারী অঞ্চলে সরবরাহ বাধা তৈরি হলেই সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ও বড় শহরে পণ্যটির দাম দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

অন্যদিকে মৌসুমি পণ্যের ক্ষেত্রে উৎপাদন কোন পর্যায়ে আছে এবং বাজারে সরবরাহ পরিস্থিতি কী পর্যায়ে রয়েছে  এবং আমদানি পরিস্থিতি কেমন, সেটার ওপর নির্ভর করে দামের ওঠানামা।  মূলত পেঁয়াজ ও ডালজাতীয় পণ্যের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে। এসব পণ্যের ক্ষেত্রে তথ্যের অবাধ প্রবাহ না থাকলে এবং ভোক্তাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হলেই হঠাৎ দাম বৃদ্ধি পায়। আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কারোপ ও আমদানিতে কোনো ধরনের বাধা থাকলেও দাম ওঠানামা করে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, অধিদপ্তর থেকে প্রতিনিয়তই কৃষিপণ্যের দাম ওঠানামা পর্যালোচনা করে নীতিনির্ধারণ করতে সংশ্লিষ্টদের সুপারিশ করা হচ্ছে। দামের ওঠানামা বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে দেশের মজুদ, আমদানি ও উৎপাদন পরিস্থিতির বিষয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়। আবার বাজার ব্যবস্থাপনায় কোনো স্টেকহোল্ডার অস্বাভাবিক আচরণ বা কারসাজি করছে কিনা, সেটিও দেখা হচ্ছে। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে যৌক্তিকতা পাওয়া গেলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনেকের আচরণ অযৌক্তিক থাকে।  তখন আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হই। এছাড়া কয়েক বছর ধরেই কয়েকটি পণ্যের দাম একটি নির্দিষ্ট সময়েই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এগুলো সরবরাহ সংকটেই হয়ে থাকে। সরবরাহ সংকটে যেসব পণ্যের দামের অস্থিতিশীলতা রয়েছে, সেগুলো দেশেই উৎপাদন বাড়ানোর  দিকে নজর দিতে হবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ‘অ্যাসেসিং কম্পিটিশন ইন অনিয়ন মার্কেট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, পেঁয়াজের ক্ষেত্রে ভোক্তা যে দাম দেয় তা থেকে উৎপাদনকারীর আয় হয় মাত্র ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশ। অন্যদিকে কমিশন এজেন্ট ও আড়তদার পায় ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ, ফড়িয়া ও ব্যাপারি পায় ৭ দশমিক ১ শতাংশ, পাইকার ৮ দশমিক ১৯ এবং খুচরা বিক্রেতারা পায় ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। মোট চাহিদায় আমদানির একটা বড় প্রভাব রয়েছে। মোট আমদানির প্রায় ৭৫-৮০ শতাংশ আসে ভারত থেকে। চীন থেকে আসে ১৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এছাড়া খুব সামান্য একটা অংশ আসে অস্ট্রেলিয়া, মিয়ানমার, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর ও অন্যান্য দেশ থেকে। তাই দামের ওঠানামা কমাতে আমদানি বাজার বহুমুখী করার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গবেষক ও বিআইডিএসের রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে পেঁয়াজের দাম মূলত একটি নির্দিষ্ট সময়েই বাড়ে। ইনফ্লেশনারি এক্সপেকটেশন বা দাম বেড়ে যাবে এমন আতঙ্ক থেকেই মূলত পণ্যটির দাম বেড়ে যায়। আর সে আতঙ্ক তৈরি হয় দেশে উৎপাদন মৌসুম কোন পর্যায়ে আছে, ভারতে উৎপাদন পরিস্থিতি ও শুল্কারোপ কী পর্যায়ে আছে, বন্দরে খালাস ও সেবা পরিস্থিতি কেমন তা ভোক্তারা না জানার কারণে। তাছাড়া উৎসবভিত্তিক চাহিদা বৃদ্ধিও হঠাৎ পেঁয়াজের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ। দামের ওঠানামা কমাতে হলে উৎপাদন মৌসুমের পেঁয়াজকে পরবর্তী সময়ে বাজারে সরবরাহ উপযোগী করতে হবে। এজন্য উৎপাদক ও বিপণন পর্যায়ে মজুদ সক্ষমতা বাড়ানো এবং আমদানির বাজার বহুমুখী করতে হবে।

গত এক দশকে গম ও চালের দামের অস্থিতিশীলতা বা ওঠানামার পরিমাণ কিছুটা কম ছিল। এ সময়ে বোরো চালের দামে ওঠানামার হার ছিল প্রায় ৯ শতাংশ। তবে ২০১৮ সালে স্থানভেদে তা ১৬ শতাংশে উন্নীত হয়। এই সময়ে আমন ধানের দামের ওঠানামা ছিল ১১ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে ১৬ শতাংশে উন্নীত হয়। অন্যদিকে গমের দাম এক দশকের ব্যবধানে পার্থক্য ছিল মাত্র ৬ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে স্থানভেদে উন্নীত হয় ১৭ শতাংশে। ফলে চাল ও গমের দামের পার্থক্য সব সময়ই ২০ শতাংশের নিচেই ছিল।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুল মুঈদ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, মূলত দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কারণেই এসব পণ্যের দামের স্থিতিশীলতা দেখা দেয়। তবে অন্য কয়েকটি কৃষিপণ্যের দাম বেশ ওঠানামা করার বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। মূলত মৌসুমের শেষ অথবা শুরুতে কিছু পণ্যের সরবরাহস্বল্পতা কিংবা বাজার মজুদ পরিস্থিতি কমে যাওয়ার কারণে বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম বেশ দ্রুত ওঠানামা করে। এর মধ্যে তেল, ডাল ও মসলাজাতীয় পণ্যই বেশি রয়েছে। আবাদ সম্প্রসারণে অর্থায়ন সুবিধাসহ প্রশিক্ষণ ও বিপণন সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া কৃষক পর্যায়ে মজুদ বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছি।

Leave A Comment

To Top