অসম্ভবই সম্ভব হচ্ছে কৃষিতে

September 24, 2023 0 Comments

উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে দেশের ৮৫ শতাংশ কৃষিজমি। অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপজ্জনকভাবে নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতও। একই সঙ্গে জমি, উপকরণ ও প্রযুক্তিগত দিক থেকেও রয়েছে নানা ধরনের সংকট। এসব প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গে করেই এগিয়ে চলেছে দেশের শস্য উৎপাদন খাত। এরই মধ্যে সাত কোটি টনের মাইলফলক অতিক্রম করেছে দেশের বার্ষিক শস্য উৎপাদনের পরিমাণ। ২০৩০ সালের মধ্যে খাতটির উৎপাদনশীলতাকে দ্বিগুণে উন্নীত করতে চাইছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন হলে নিঃসন্দেহে তা হয়ে উঠবে কৃষি খাতের জন্য অনেক বড় একটি অর্জন।

তবে এ অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আরো গতিশীল করে তোলার জন্য শস্য খাতের প্রতিবন্ধকতাকে দূর করার ওপর জোর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, খাদ্যে টেকসই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সংগতি রেখে শস্য উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু শস্য খাতের নানা প্রতিবন্ধকতা ও দুর্বলতা থেকে গেলে খাদ্যে দীর্ঘমেয়াদি স্বয়ংসম্পূর্ণতার লক্ষ্য অর্জনের বিষয়টি ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে।

কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন হয়েছে ৭ কোটি ১৫ লাখ টন। এর মধ্যে প্রধান দানাদার খাদ্যশস্যগুলোর (চাল, ভুট্টা ও গম) উৎপাদন চার কোটি টন ছাড়িয়েছে। আলু উৎপাদন হয়েছে ৯৭ লাখ টন। তেলবীজ উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ টন।

উৎপাদনের এ ধারাকে আরো বেগবান করতে শস্যের উৎপাদনশীলতাকে ২০৩০ সালের মধ্যে ২০১৫ সালের তুলনায় দ্বিগুণ করার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। ২০১৫ সালে দেশে চাল ও গমের হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদনশীলতা ছিল তিন টনের বেশি। ২০৩০ সালের মধ্যে তা ছয় টনের বেশি উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের। ভুট্টার উৎপাদনশীলতা ছিল প্রায় সাত টন, যা প্রায় ১৪ টনে উন্নীত করতে চাইছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০১৫ সালে আলুর হেক্টরপ্রতি উৎপাদনশীলতা ছিল ২০ দশমিক ৭৬ টন। ২০৩০ সালের মধ্যে এটিকে ৪১ টনে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে। এছাড়া একই সময়ের মধ্যে ডাল শস্যের উৎপাদনশীলতা ১ দশমিক ১৪ থেকে ২ দশমিক ২৮ টন ও তেলবীজের হেক্টরপ্রতি উৎপাদনশীলতা ১ দশমিক ১৮ টন থেকে ২ দশমিক ৩৬ টনে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

পরিসংখ্যান বিবেচনায় বলা চলে, এখন পর্যন্ত এ বর্ধিত উৎপাদনশীলতার লক্ষ্য অর্জনের পথেই রয়েছে দেশের কৃষি খাত। ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত চাল ও গমের হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদনশীলতা অর্জন করা গিয়েছে যথাক্রমে ৩ দশমিক ১২ টন ও ৬ দশমিক ৬ টন পর্যন্ত। ভুট্টার ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা অর্জন হয়েছে ৮ দশমিক ৭১ টন। এ সময়ে আলুর হেক্টরপ্রতি উৎপাদনশীলতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২১ টনে। পাশাপাশি ডাল শস্যের ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি উৎপাদনশীলতা বেড়ে হয়েছে ১ দশমিক ২৭ টন। তেলবীজের ক্ষেত্রে এ বর্ধিত উৎপাদনশীলতার পরিমাণ ১ দশমিক ৩৪ টন।

শস্য খাতের এ মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রায় সবক’টি শস্যের উৎপাদনশীলতাকে দ্বিগুণ করার লক্ষ্য অর্জন করা গেলে তা হবে অসম্ভবকে সম্ভব করার নামান্তর। এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা গেলে দেশে শস্য উৎপাদনের বহুমুখীকরণ কার্যক্রমও অনেক বেশি গতিশীল হয়ে উঠবে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে যদি উৎপাদন খরচ বাড়েও তার পরও বাড়তি শস্য উৎপাদনের মাধ্যমে মুনাফার ধারা ধরে রাখতে সক্ষম হবেন কৃষকরা।

এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের কৃষি খাতের কার্যক্রম এখন শুধু উৎপাদন বাড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। কৃষি খাতই এখন দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রধান হাতিয়ার। পাশাপাশি দেশের আর্থসামাজিক বিভিন্ন সূচকের উন্নয়নের অন্যতম অনুষঙ্গ কৃষি খাত।

শস্য খাতে যেসব কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হলে যেকোনো অসম্ভবকেই সম্ভব করা যাবে জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী আরো বলেন, আমার এ বিশ্বাসের মূল কারণ সরকার থেকে কৃষকদের নীতিসহায়তা দেয়ার পাশাপাশি বিজ্ঞানী, সম্প্রসারণকর্মী ও বেসরকারি খাতও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। কৃষিকে লাভজনক পর্যায়ে উন্নীত করতে বাণিজ্যিক কৃষিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। উপকরণ সহায়তা, অপ্রচলিত শস্যকে জনপ্রিয় করা ও কৃষিপণ্যকে রফতানিমুখী করতে নীতিসহায়তাও বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি সব ধরনের প্রযুক্তিও দ্রুততার সঙ্গে কৃষকের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে।

তবে এ লক্ষ্যপূরণের পথে বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে দেশের কৃষি খাতের বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো। জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৭০ সাল নাগাদ দেশে ধানের উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ার বড় ধরনের আশঙ্কা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে কৃষকদের এখন খরা, লবণাক্ততা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি বা জলাবদ্ধতার মতো প্রতিকূলতাগুলোকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি, যা শস্য খাতের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বড় বাধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি মৌসুমেও ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও দীর্ঘমেয়াদি বন্যার মতো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে কৃষকদের। শুধু এ দুই দুর্যোগের কারণেই কৃষি খাতের সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকায়। এ কারণে সংশ্লিষ্টরাও বর্তমানে বিভিন্ন শস্যের ঘাতসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের ওপর জোর দিচ্ছেন বেশি।

শস্য উৎপাদন খাতের আরেকটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলো জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস। বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) গবেষণা বলছে, দেশে আবাদযোগ্য জমির প্রায় ৮৫ শতাংশেরই উর্বরতা শক্তি হ্রাস পেয়েছে। এ অবস্থায় জমিতে রাসায়নিক সারের বদলে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে নীতিমালা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি রাসায়নিক সারের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সারের মূল্যে ভারসাম্য আনারও।

অতিমাত্রায় সেচনির্ভর ফসল উৎপাদনে ঝুঁকে পড়া, সেচের পানির অদক্ষ ব্যবহার ও ভূ-উপরিস্থ পানি সংরক্ষণে জোর না দেয়ার কারণে বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ জেলায়ই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গিয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় আবার সেচব্যয়ও বাড়ছে কৃষকদের। দেশে বর্তমানে প্রতি কেজি বোরো আবাদে পানির প্রয়োজন পড়ছে প্রায় তিন হাজার লিটার। এজন্য সেচের চাপ কমাতে আউশ আবাদে কৃষকদের উৎসাহিত করছে সরকার। উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম হওয়ার পাশাপাশি সেচের ওপর কম নির্ভরতা, সরকারের ভর্তুকি সহায়তা কার্যক্রম ও পরিবেশগত দিক বিবেচনায় কৃষকরাও এখন আউশ আবাদের দিকে ঝুঁকছেন বেশি। তবে এক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। আউশ ও আমন আবাদের ক্ষেত্রে বোরোর মতো উচ্চফলনশীল জাতের সংখ্যা বেশ কম। নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে এ সংকট দূর করা গেলে সামনের দিনগুলোয় ধানের হেক্টরপ্রতি উৎপাদনশীলতা ছয় টনে উন্নীত করার লক্ষ্য অর্জনের বিষয়টি অনেক সহজ হবে। পাশাপাশি অন্যান্য শস্য আবাদের ক্ষেত্রেও জমির ব্যবহার বাড়ানো সম্ভব হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, সারা দেশে ধানের আবাদ ও উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। ভূপ্রাকৃতিক গঠন, কৃষক ও ভোক্তাদের চাহিদাকে বিবেচনায় রেখে শতাধিক জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রতি হেক্টরে আট টন পর্যন্ত ফলন দিতে পারে এমন জাতও উদ্ভাবন করা হয়েছে। আউশ ও আমনের নতুন এসব জাত কৃষকের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে। সামনের দিনগুলোয় ধানের জমি অন্যান্য শস্যে স্থানান্তর হবে। ফলে উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার মাধ্যমে চালের প্রয়োজনীয় উৎপাদন ধরে রাখার পাশাপাশি অন্যান্য শস্যের আবাদ বাড়ানোও সম্ভব হবে।

কম উৎপাদনশীলতার কারণে কৃষকদের মধ্যে এখন চারটি প্রধান ডাল শস্য আবাদে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে কম। ফলে এসব পণ্যের যেটুকু উৎপাদন হচ্ছে, তা দিয়ে স্থানীয় চাহিদার এক-তৃতীয়াংশও পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ চাহিদা প্রতিনিয়ত বেড়ে চললেও গত দুই অর্থবছরে দেশে ডাল শস্যের আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ২ লাখ ১৩ হাজার হেক্টর। কম উৎপাদনশীলতার কারণে কৃষক সেভাবে লাভবান হতে না পারলেও পণ্যগুলো আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে বাংলাদেশের। গত ১০ অর্থবছরে দেশে ডাল শস্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। এ অবস্থায় ডালের হেক্টরপ্রতি উৎপাদনশীলতা সোয়া এক টন থেকে আড়াই টনে উন্নীত করা গেলে কৃষকের পণ্যগুলো আবাদে উৎসাহিত করার পাশাপাশি আমদানিনির্ভরতা কমানোও সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অন্যদিকে দেশে বার্ষিক ৬০ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে গম উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১৩ লাখ টন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পণ্যটির উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনের বিষয়টি এখন গতি হারিয়েছে। তবে ঘাতসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করা গেলে এ উৎপাদন সহজেই বাড়ানো সম্ভব হবে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনায় বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের কৃষিতে সম্ভাবনার সবটুকুই রয়েছে। সামনের দিনগুলোয় অর্থনৈতিক কাঠামোর অন্যতম শক্তিশালী ভিত্তিই হবে কৃষি। তবে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হলে শস্যগুলোর মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ জরুরি। তা না হলে কৃষকের কাছে সেটি পৌঁছানো কঠিন হবে। যে শস্য কম লাভজনক, সেটি কৃষকের কাছে পৌঁছানো কষ্টকর হবে। এটির পাশাপাশি কৃষকের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে সব ধরনের প্রযুক্তি পৌঁছাতে হবে। প্রণোদনা ও অর্থায়ন কাঠামোয় পরিবর্তন এনেই সেটি করতে হবে। উৎপাদনের পাশাপাশি নজর দিতে হবে বিপণনেও। এখনই কৃষিপণ্যের বিপণনে ডিজিটাল মাধ্যমের প্রবর্তন করতে হবে। কৃষকের খরচ কমিয়ে এনে মুনাফা বৃদ্ধির দিকে নজর বাড়াতে হলে এ খাতে উন্নত বিশ্বের মতো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়া দ্রুত পৌঁছাতে হবে। তাহলে দেশের কৃষি খাত একটি টেকসই রূপান্তর পাবে।

Leave A Comment

To Top