অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতায় যমুনাপারের মানুষ

September 24, 2023 0 Comments
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার আমলাপাড়ায় যমুনাপারের বাসিন্দা মর্জিনা বেগম। একসময় নদীর ওপারে বসতভিটা ও কিছু আবাদি জমি ছিল তাদের। কিন্তু নদীভাঙনে সব হারিয়েছেন। সেই থেকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছেন এ নারী। মর্জিনা বলেন, চাষের জমি নদীগর্ভে চলে যাওয়ার পর মাছ ধরেই চলত জীবিকা। নাব্যতা সংকটে এখন নদীও শুকিয়ে যাচ্ছে, মিলছে না মাছের দেখা। তাই পিছু ছাড়ছে না দারিদ্র্যও। শুধু মর্জিনা নন, তার মতোই অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার মধ্যে আছে যমুনা তীরের অসংখ্য মানুষ। সারা দেশে গড় দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশের নিচে থাকলেও এ অঞ্চলে তা এখনো প্রায় ৩৭ শতাংশ। মূলত নদীর ভাঙন ও নাব্যতা হ্রাসের ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসায় দারিদ্র্য থেকে বের হতে পারছে না তারা। পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে যমুনা নদী। একসময় এ যমুনাই ছিল পাঙাশ, রুই, কাতল, মৃগেলসহ ছোট-বড় সব ধরনের মাছের বড় উৎস। চার দশক আগেও বৃহত্তর পাবনা জেলার নদী ও মোহনাগুলো থেকেই ধরা পড়ত ১৪ হাজার টন মাছ। এখন কমতে কমতে তা মাত্র সাড়ে তিন হাজার টনে নেমে এসেছে। নদীতে মাছ কমে যাওয়ায় আর্থিক সংকটে আছে সেখানকার জেলে সম্প্রদায়। যমুনায় মাছ কমে যাওয়ার মূল কারণ নাব্যতা সংকট। বর্ষাকালে নদীর দুই কূল উপচে বন্যা হলেও শীত মৌসুমে যমুনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পরিণত হয় ধু ধু বালুর চরে। সেখানে হয় না কোনো ফসলও। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রতি বছর যমুনা নদীতে ১২০ কোটি টন পলি ও বালি পড়ছে। এসব বালি পানির স্রোতে বঙ্গোপসাগরে চলে যেতে পারছে না। ফলে তৈরি হচ্ছে চর। যমুনা নদীর সিরাজগঞ্জ চ্যানেলে সাধারণত ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে নাব্যতা সংকট দেখা দেয়। কিন্তু চলতি বছর সেই সংকট আগেভাগেই দেখা দিয়েছে। নদীর এ পরিস্থিতি উত্তরাঞ্চলে পণ্য পরিবহনও বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে দেখা দিয়েছে গতিহীনতা। পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের নদীর পানিপ্রবাহের সিংহভাগই আসছে ট্রান্সবাউন্ডারির মাধ্যমে। উজানে বাঁধ দেয়া এবং দেশের নদীগুলোকে বৈজ্ঞানিক ও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবস্থাপনা করতে না পারার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানিপ্রবাহ। কয়েক দশক আগেও যমুনা নদীর প্রবাহ ছিল ১০ কিলোমিটারের ঊর্ধ্বে। অথচ এখন সেটি কোথাও কোথাও এক কিলোমিটারে ঠেকেছে। এ দুরবস্থা কেন হলো সেটি খতিয়ে দেখতে কোনো দীর্ঘমেয়াদি ও বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা নেই। নদীতে পলি পড়লেও সেগুলো ড্রেজিং করে সরানো যাচ্ছে না। ফলে নাব্যতা সংকট কঠিন থেকে ভয়াবহ হচ্ছে। বাড়ছে নদীভাঙন। রক্ষা করা যাচ্ছে না নদীর দুই পারের মানুষের জমি। জমিহারা ও গৃহহারা এসব মানুষ চরম দুরবস্থায় পড়েছে। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা তাদের একটি চক্রের মতো করেই ঘিরে ফেলছে। তাই দুই পারের মানুষকে রক্ষা করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে অবশ্যই নাব্যতা সংকট রোধ ও দক্ষতার সঙ্গে যমুনা নদী ব্যবস্থাপনা করা প্রয়োজন। নদীর নাব্যতা কমে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় প্রতি বছরই বন্যার কবলে পড়তে হয় যমুনার দুই পারের বাসিন্দাদের। বন্যা কিংবা নদীভাঙনের শিকার হওয়া পরিবারগুলোকে বছরে প্রায় ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি খরচ করতে হয় নতুন জায়গায় বসতবাড়ি স্থাপন ও কৃষির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে। যমুনা নদীতে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কথা উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, যমুনা নদীর নুনখাওয়া পয়েন্টে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। যমুনার দুই পারের মানুষ মূলত কৃষি ও মত্স্য খাতের ওপর নির্ভরশীল। ফলে কৃষি ও মত্স্য খাতের কোনো ধরনের বিপর্যয় হলে দুই পারের মানুষের জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, নাব্যতা সংকট ও পানিপ্রবাহ না থাকায় কৃষিজমিতে সেচ দিতে বেশ সমস্যায় পড়তে হচ্ছে এ অঞ্চলের কৃষকদের। এপ্রিল-মে মাসে পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে কৃষকের বিপত্তি বেড়ে যাচ্ছে। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়া উপজেলার কিছু অংশে সেচের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এপ্রিল-মে মাসে কোথাও কোথাও ৩০-৪০ ফুট পানি নেমে যায়। এতে সেচের খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক সময় সেচের অভাব দেখা দিচ্ছে। এ বিষয়ে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এনামুল হক শামীম বণিক বার্তাকে বলেন, নদী রক্ষায় সরকার শত বছরের পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। ডেল্টা প্ল্যানের আওতায় সব নদীকেই তার হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা হবে। যমুনা নদীকে রক্ষার পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। এ অঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ভারতের আসাম থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে। ওই নদী যমুনা নাম ধারণ করে গোয়ালন্দের কাছে পদ্মা নদীতে মিশেছে। এ অংশের দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার। যদিও যমুনা নদীর শাখা ও উপনদীর দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার। এ নদীর বিভিন্ন স্থানে প্রায় তিন-ছয় কিলোমিটার পর্যন্ত প্রশস্ততায় পানি প্রবাহিত হয়ে থাকে। একসময় সেই প্রশস্ততা ১০ কিলোমিটারের বেশি ছিল। এখন কোথাও কোথাও তা নেমে এসেছে এক কিলোমিটারের নিচে। পানিপ্রবাহের গতি না থাকায় যমুনায় জেগে উঠেছে অসংখ্য বালুচর।

Leave A Comment

To Top