Category Archives: Blog

  • খাদ্য অধিদপ্তর গত বছর বোরো মৌসুমে উৎপাদিত চাল সংগ্রহ করেছিল ১৪ লাখ টনের কিছু কম। এর মধ্যে আট লাখ টনের কাছাকাছি এখনো মজুদ অবস্থাতেই রয়ে গিয়েছে। খোদ খাদ্য অধিদপ্তর নিজেই এখন দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা এসব চাল মানহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে। এজন্য গত বছর সংগৃহীত বোরো চাল দ্রুত ছাড়করণের নির্দেশনা দিয়েছে অধিদপ্তর। সারা দেশে চলতি বছরের বোরো মৌসুমের আবাদ কার্যক্রম এরই মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। যদিও খাদ্য অধিদপ্তরের গত বছর সংগৃহীত বোরো চালের মজুদ এখনো অর্ধেকও ফুরায়নি। বোরো মৌসুমের চাল দীর্ঘদিন সংগ্রহে রাখা যায় না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি দুশ্চিন্তায় ফেলেছে খাদ্য অধিদপ্তরকেও। অধিদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, গত বোরো মৌসুমে চাল সংগৃহীত হয়েছিল প্রায় ১৩ লাখ ৮১ হাজার ৫৫২ টন। এর মধ্যে মিলারদের কাছ থেকে কেনা হয়েছিল ১১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৬৩ টন। সর্বশেষ ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশের এলএসডি ও সিএসডিগুলোয় এখনো গত বছর সংগ্রহ করা ৭ লাখ ৭০ হাজার ৮৬৯ টন বোরো চাল মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে সেদ্ধ চাল ৭ লাখ ৫৮ হাজার ৫৭১ টন ও আতপ চাল ১২ হাজার ২৯৮ টন। বোরো চালের সবচেয়ে বেশি মজুদ রয়েছে রাজশাহীতে—১ লাখ ৮৮ হাজার ১৫৩ টন। এরপর সবচেয়ে বেশি রয়েছে রংপুর বিভাগে। ওই বিভাগের গুদামগুলোয় এখনো ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬৬৭ টন বোরো চালের মজুদ রয়ে গিয়েছে। খুলনা বিভাগে মজুুদ রয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬ টন। এছাড়া ঢাকা বিভাগে ৮৭ হাজার ৩৩১ টন, ময়মনসিংহে ৭৭ হাজার ৩৯৬, চট্টগ্রামে ৮৬ হাজার ৩৬২, সিলেটে ২ হাজার ৭৪৯ ও বরিশালে ২০ হাজার ৯৪৫ টন বোরো চালের মজুদ রয়ে গিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের আবহাওয়ায় আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা বেশি। এ ধরনের আবহাওয়া কীটপতঙ্গ জন্মানোর জন্য আদর্শ। দেশের গুদামগুলো বর্তমানে বেশ পুরনো হয়ে পড়েছে। এ কারণে এসব গুদামে পোকামাকড়ের উপদ্রবও বেশি। পুরনো এসব খাদ্যগুদামে খাদ্যশস্য সংরক্ষণের উপযুক্ত পরিবেশের অভাবও রয়েছে। আবার বোরো চালের সংরক্ষণ সক্ষমতা বেশ কম। ফলে দ্রুত বিতরণ করতে না পারলে এসব বোরো চাল দ্রুত মানহীন হয়ে পড়তে পারে। এ অবস্থায় জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায়ের খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের দ্রুত চাল ছাড় করার বিষয়ে চিঠি দিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। এ বিষয়ে সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের গুদামের মান খুব বেশি ভালো না। আবহাওয়ার কারণে চালে দ্রুত পোকার আক্রমণ হয়। আবার আমাদের মজুদ ব্যবস্থাপনাও খুব বেশি উন্নত নয়। ফলে চার-ছয় মাসের বেশি মজুদ রাখা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। আবার চালের সংগ্রহের সময়ও চালের মান যাচাই-বাছাই করে নেয়া দরকার। সংগ্রহের সময়ে এমনিতেই বিভিন্ন চাপে মানহীন চাল নেয়ার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে সে চাল বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় না। নিশ্চিত মানহীনতার বিষয় যদি এসে যায় তাহলে বাজারে এ চাল দেয়া যৌক্তিক হবে না। তাই বোরো চালের এ মজুদ খালি করার উদ্যোগ আরো আগেই নেয়া প্রয়োজন ছিল। তাহলে বাজারে চালের দামও আরো নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত। আবার দ্রুত গুদাম থেকে চাল ছাড় করতে গিয়ে যাতে গুদামই খালি না হয়ে যায়, সেটিও নজরে রাখতে হবে। অন্যথায় বাজারে নেতিবাচক বার্তা যেতে পারে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের উদ্দেশে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আব্দুল্লাহ মামুন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন মজুদের ফলে বোরো চালের গুণগতমান হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য এসব চাল সংরক্ষণে যথাযথ পরিচর্যার জন্য সংশ্লিষ্টদের অধিকতর যত্নবান হওয়া দরকার। এ পরিস্থিতিতে গুদামগুলোয় সংরক্ষিত বোরো/২১ চাল ওয়ারেন্টি অনুযায়ী বিভিন্ন খাতে বিলি-বিতরণ করে নিঃশেষ করা প্রয়োজন। যেসব জেলা বা বিভাগের এলএসডি ও সিএসডিগুলোয় গত বছরের বোরো চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে, সেগুলো থেকে ঘাটতিতে থাকা জেলা বা বিভাগের এলএসডি-সিএসডিগুলোয় পাঠানো নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য অভ্যন্তরীণ সড়ক পরিবহন ঠিকাদার (আইআরটিসি), অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন ঠিকাদার (আইবিসিসি), বিভাগীয় সড়ক পরিবহন ঠিকাদারের (ডিআরটিসি) মাধ্যমে যথাসময়ে সূচি জারি করে গত বছরের বোরো চাল পাঠানো নিশ্চিত করতে হবে। এ নির্দেশনা অমান্য করে কোনো এলএসডি ও সিএসডি থেকে গত বছরের বোরো চালের পরিবর্তে সদ্য সংগৃহীত আমন চাল যাতে কোনো অবস্থাতেই বিলি-বিতরণ করা না হয়, সে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মনিটরিং করবেন। জানা গেছে, দেশের বেশির ভাগ গুদামেরই অবকাঠামো বেশ পুরনো। আবার দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক ব্যবস্থারও ঘাটতি রয়েছে। ফলে এসব খাদ্যগুদামে কীটের আক্রমণের শঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। আবার সংরক্ষণের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় আগেও বিভিন্ন সময়ে গুদামজাত খাবারের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে এখন খাদ্যশস্য মজুদের জন্য সনাতনী পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু হয়েছে। সেজন্য আধুনিক সাইলো তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব সাইলোয় খাদ্যশস্য মজুদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ থাকে। আবার কীটপতঙ্গ প্রতিরোধে স্থাপনা নির্মাণকালে ব্যবহার করা হচ্ছে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন পদ্ধতি। তাছাড়া বাতাসের আর্দ্রতা ও উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণের জন্য উপযুক্ত কারিগরি সক্ষমতার ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বণিক বার্তাকে বলেন, প্রথাগত গুদাম ও চাল সংরক্ষণ ব্যবস্থার কারণে চালের মান ধরে রাখাটা একটু কঠিন। তবে চেষ্টা চলছে আধুনিক মানের গুদাম তৈরি করার। বেশকিছু আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির গুদাম নির্মাণাধীন রয়েছে। আবার আমন মৌসুমের জন্য চাল সংগ্রহ করতে হবে। এজন্য গত বছরের বোরো মৌসুমের সংগৃহীত চাল দ্রুত খালি করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে বোরোর মজুদ খালি হলেও আমন মৌসুমের চাল দিয়ে সেটি দ্রুতই পূরণ করা সম্ভব হবে। ফলে মোট মজুদে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

  • দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে শস্যের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বেশি। উৎপাদন বাড়ানোর প্রত্যাশা থাকে কৃষকেরও। কিন্তু এ প্রত্যাশাও কোনো ধরনের আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে পারছে না অধিকাংশ কৃষকের মধ্যে। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎপাদন হ্রাসের আশঙ্কাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। আবার উৎপাদন বাড়লেও এর ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাবে কিনা বা বাড়তি ফসল ঘরে তোলা যাবে কিনা, সে বিষয়গুলো নিয়েও দুশ্চিন্তায় থাকেন অনেক কৃষক। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, আত্মবিশ্বাসের সংকট ও দুশ্চিন্তা নিয়েই শস্য উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন দেশের কৃষক। কভিডকালে এ সংকট তাদের মধ্যে আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। ‘বাংলাদেশ: শকস, এগ্রিকালচারাল লাইভলিহুড অ্যান্ড ফুড সিকিউরিটি মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এফএওর এ পর্যবেক্ষণ উঠে আসে। গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে সারা দেশের প্রায় ৩ হাজার ৭১৬ কৃষক ও সংশ্লিষ্ট খানার তথ্যের ভিত্তিতে। গত বছরের এপ্রিল ও মে মাসে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়। শস্য উৎপাদন ও এর মুনাফা নিয়ে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান দেশের কৃষকের আত্মবিশ্বাসে বড় ধরনের চিড় ধরিয়েছে। এফএওর তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৩ শতাংশ কৃষক মনে করছেন, চলতি বছর তাদের শস্য উৎপাদনে কোনো পরিবর্তন আসবে না। নানা মাত্রায় উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি কৃষক। ৩২ শতাংশ কৃষকের আশঙ্কা, তাদের উৎপাদন ৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। ২ শতাংশ কৃষক আশঙ্কা করছেন, তাদের শস্য উৎপাদন কমতে পারে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ। ফলে সব মিলিয়ে শস্য উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ৩৬ শতাংশ কৃষক। আবার কোনো ধরনের উৎপাদন প্রত্যাশা করেন না এমন কৃষকের সংখ্যা কম নয়। দেশের ৫ শতাংশ কৃষক মনে করেন, তারা এবার উৎপাদনবঞ্চিত হতে পারেন। সব মিলিয়ে দেশের ৭৪ শতাংশ কৃষক মনে করছেন, তাদের উৎপাদন এবার কোনোভাবেই বাড়বে না। উৎপাদন নিয়ে কৃষকের এ মনোভাবের সঙ্গে জাতীয়ভাবে শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির সংগতি খুঁজে পাচ্ছে এফএও। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে শস্য বেড়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে শস্য ও শাকসবজি খাতের প্রবৃদ্ধি দশমিক ৫৮ শতাংশ। জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গেও শস্য উৎপাদন খাতের বড় ধরনের অসামঞ্জস্য রয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষায়ও উঠে এসেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ভিত্তিমূল্যে শস্য ও শাকসবজি খাতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২ দশমিক ২২ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ছিল ২ দশমিক ৫ শতাংশ। এ সময়ের মধ্যে এর আশপাশেই ঘুরপাক খেয়েছে শস্য ও শাকসবজির উৎপাদন প্রবৃদ্ধি, যা কভিডকালে আরো নিচে নেমে এসেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের এ উৎপাদন প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে দশমিক ৫৮ শতাংশ। কৃষির এ উপখাতে প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে আসার পেছনে প্রধানত কৃষককে যথাসময়ে ও সঠিক মানের বীজ না দিতে পারা, শস্যের ন্যায্যমূল্য দিতে না পারা, দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ভালো হলেও কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতের বদলে আমদানি অবারিত করে রাখা, কৃষি উপকরণ সুবিধার অভাব ইত্যাদি বিষয়কে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, কৃষককে ন্যায্যমূল্য না দেয়ার পাশাপাশি বিপণন ও বাণিজ্যনীতিকে কৃষকের পুরোপুরি অনুকূলে আনা হচ্ছে না। তবে কৃষিতে এমন নানাবিধ সংকট সত্ত্বেও অবারিত সম্ভাবনা রয়েছে। ক্ষুদ্রায়তনের জমি, উন্নত বীজ ও প্রযুক্তির অভাব মোকাবেলা করেই কৃষককে এগিয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি কৃষকের জ্ঞানের স্বল্পতা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিও মোকাবেলা করতে হবে। এজন্য গবেষণা ও সম্প্রসারণে জোর দিতে হবে। সেজন্য উন্নয়ন পরিকল্পনায় কৃষককে আরো বেশি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। এছাড়া শস্য খাতের প্রথাগত প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও পোস্ট-হারভেস্ট লস বা ফসলোত্তর ক্ষতি, উন্নত কৃষি উপকরণ, বিশেষ করে যন্ত্রাংশের অভাব, দুর্বল বিপণন ও গুদামজাতের ব্যবস্থা এবং অপচয় কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নিলে কৃষকের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বিভিন্ন ফসলের স্বল্পমেয়াদি জাতসহ ঘাতসহিষ্ণু, বিশেষ করে খরা, বন্যা এমনকি লবণাক্ততাসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া কৃষিবিষয়ক সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে সমন্বয় করা প্রয়োজন, যাতে কৃষকরা দ্রুত এসব সংস্থার কাছ থেকে সেবা নিতে পারেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এমএ সাত্তার মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের কৃষকের মধ্যে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা প্রবলভাবে তৈরি হয়েছে। সরকারের নানা ধরনের চেষ্টা রয়েছে কৃষকদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। তবে সেখানে কৃষককে কোনোভাবেই ভারাক্রান্ত করে রাখা যাবে না। কৃষকের আত্মবিশ্বাসের মাত্রাটা আসলে নির্ভর করবে কখন কী পরিস্থিতি এবং কীভাবে কৃষকের সাক্ষাত্কার নেয়া হচ্ছে। তবে হ্যাঁ এটা সত্য, যাদের আয় কেবল শস্য আবাদের ওপর নির্ভরশীল তারাই সবচেয়ে বেশি সংকটে থাকেন। এছাড়া ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা এর পরই ঝুঁকিতে থাকেন। ফলে এ দুই শ্রেণীর কৃষকদের আত্মবিশ্বাস এমনিতেই কম। কৃষক কী চান সেটি বুঝতে হবে নীতিনির্ধারকদের। সে অনুসারে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এফএওর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে শস্য উৎপাদন ৫-২০ শতাংশ বাড়তে পারে এমন প্রত্যাশা করছেন ২৩ শতাংশ কৃষক। ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়ার প্রত্যাশা করছেন ২ শতাংশ কৃষক। ১ শতাংশ কৃষক মনে করছেন, উৎপাদন বাড়তে পারে ৫০ শতাংশের বেশি। এছাড়া চলতি বছরে গত বছরের তুলনায় উৎপাদন বেশি মাত্রায় হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে বেশি। অন্যদিকে উৎপাদন আগের বছরের মতোই থাকার সম্ভাবনা বেশি দেখতে পাচ্ছেন চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগের কৃষকরা। পরিবেশগত ঝুঁকি ও অন্যান্য ক্ষতির কারণে একেবারেই উৎপাদন না হওয়ার আশঙ্কা সিলেট ও ঢাকা বিভাগের কৃষকদের বেশি। অন্যদিকে উৎপাদন ৫০ শতাংশের বেশি বাড়ার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন ময়মনসিংহ বিভাগের কৃষকরা। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, কৃষকের আত্মবিশ্বাসটা ধরে রেখে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানোই আমাদের প্রধান কাজ। সেটি সঠিকভাবে করতে পারার কারণেই খাদ্যশস্যসহ সব ধরনের কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ছে। কৃষকের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য আমরা তাদের কাছে সঠিক সময়ে সঠিক তথ্যের পাশাপাশি নানা ধরনের প্রযুক্তি ও সরকারের সুবিধাগুলো পৌঁছে দিচ্ছি। প্রদর্শনীর মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তির বিষয়ে কৃষকের আস্থা আনছি। সেটি দেখেই তারা নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে লাভবান হচ্ছেন। কৃষকের জন্য সহায়ক সব ধরনের প্রযুক্তি দ্রুততার সঙ্গে তাদের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে। কৃষিকে লাভজনক পর্যায়ে উন্নীত করতে বাণিজ্যিক কৃষিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে রফতানি বাড়ানোর জন্য আমাদের নানা ধরনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। উপকরণ সহায়তা, অপ্রচলিত শস্যকে জনপ্রিয় করা এবং কৃষিপণ্যকে রফতানিমুখী করতে নীতিসহায়তা বাড়ানো হচ্ছে।

  • সিলেট বিভাগের সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার-এ চার জেলায় ১৮ শতাংশ কৃষকই ভূমিহীন। এছাড়া এ চার জেলার ৩৬ শতাংশই প্রান্তিক কৃষক। এসব জেলায় মোট জমির মাত্র ৬১ শতাংশ চাষযোগ্য। এ অঞ্চলে মোট পতিত জমি প্রায় দুই লাখ হেক্টর। আবার চাষযোগ্য জমির ৪৯ শতাংশে এক ফসলি আবাদ হয়। গতকাল সকালে সিলেট সার্কিট হাউজে সিলেট অঞ্চলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এমপির মতবিনিময়কালে এসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়। সিলেট অঞ্চল ও বিভাগের কৃষির সম্ভাবনা ও সমস্যা নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) উপপরিচালক কাজী মজিবুর রহমান। ডিএই এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জমি পতিত থাকার অন্যতম কারণ হলো অনুপস্থিত কৃষক বা মালিক। প্রবাসী কৃষকরা আবাদে আগ্রহী হচ্ছেন না। এছাড়া বোরো মৌসুমে সেচের অপর্যাপ্ততা, পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আয়রনের উপস্থিতি, আগাম ও আকস্মিক বন্যা, পাহাড়ি ঢল-অতিবৃষ্টি, টেকসই ফসল রক্ষাবাঁধের অভাব, আগাম-স্বল্পমেয়াদি জাতের অভাবে আবাদ কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। মূল প্রবন্ধে কাজী মজিবুর রহমান বলেন, সিলেট অঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলায় মোট জমির পরিমাণ ১২ লাখ ৫০ হাজার ৫৩২ হেক্টর। চাষযোগ্য বা ফসলি জমি রয়েছে ৭ লাখ ৬৩ হাজার ২৫৪ হেক্টর। ফলে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ মাত্র ৬১ শতাংশ। যেসব জমি চাষ করা সম্ভব, সেখানে মাত্র একটি ফসলই বেশি আবাদ করা হয়। চাষযোগ্য জমির এক ফসলি জমিই প্রায় ৪৯ শতাংশ। ফসলের নিবিড়তা ১৬০ শতাংশ, যা দেশের অন্য বিভাগের তুলনায় সবচেয়ে কম। সিলেট অঞ্চলে ১৮ শতাংশ কৃষক ভূমিহীন ও ৩৬ শতাংশ প্রান্তিক কৃষক। অন্যদিকে পতিত জমি ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩৯৯ হেক্টর। এ বিশাল পতিত জমিতে ফসল উৎপাদনই এখন চ্যালেঞ্জ। গতকালের অনুষ্ঠানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বেনজীর আলম, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন, সিলেট অঞ্চলের ডিএইর অতিরিক্ত পরিচালক দিলীপ কুমার অধিকারী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

  • দেশে কয়েক বছর ধরেই ৪৭ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধান উত্পন্ন হয়। এ ধানের উৎপাদন খরচের একটি বড় অংশজুড়ে থাকে কীটনাশক ও বালাইনাশক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কৃষিবিষয়ক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, প্রতি হেক্টর জমিতে বোরো ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে এ বাবদ ব্যয় হয় ৩ হাজার ৭২ টাকা। প্রতি টন ধান উৎপাদনে এ ব্যয় ৫৪৬ টাকা। অর্থাৎ বছরে কেবল কীটনাশক ও বালাইনাশকের পেছনেই বোরো ধান চাষীর ব্যয়ের পরিমাণ ছাড়িয়ে যায় দেড় হাজার কোটি টাকা। ধান উৎপাদনে বালাই ব্যবস্থাপনায় বিশেষ করে আগাছা দমনেই মোট উপকরণ ব্যয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ খরচ হচ্ছে বলে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) আয়োজিত এক কর্মশালায় জানানো হয়। গতকাল ভ্যালিডেশন অ্যান্ড আপস্কেলিং অব রাইস ট্রান্সপ্লান্টিং অ্যান্ড হারভেস্টিং টেকনোলজি ইন দ্য সিলেক্টেড সাইটস অব বাংলাদেশ (ভিআরটিএইচবি) শীর্ষক এ কর্মশালায় আগাছা দমন সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কীভাবে ক্ষতির মাত্রা কমানোর পাশাপাশি এ খাতে ব্যয় কমানো যায় সে বিষয়েও নানা তথ্য উঠে আসে। কৃষকের এ খরচ কমাতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বেশকিছু পরিবেশবান্ধব যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে। যার মাধ্যমে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমানো সম্ভব। পাশাপাশি এ ব্যবস্থা পরিবেশের ক্ষতি করে না ও তুলনামূলক সুলভ বলে তা কৃষকের উৎপাদন ব্যয় কমাতেও সহায়তা করবে বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি। কর্মশালায় ব্রি মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, আগাছা দমনে কায়িক শ্রম, সময় ও ব্যয় কমাতে শক্তিচালিত নিড়ানি যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে ব্রি। এ যন্ত্রের মাধ্যমে একসঙ্গে একাধিক সারির আগাছা দমন করা সম্ভব। এটি জনপ্রিয় করা গেলে ধানের আগাছা দমনে রাসায়নিক আগাছানাশকের ব্যবহার কমবে। এছাড়া ব্রি উদ্ভাবিত রাইস ট্রান্সপ্লান্টার কাম সার প্রয়োগ যন্ত্রের মাধ্যমে একই সঙ্গে ধানের চারা রোপণ ও সব ধরনের সার একসঙ্গে প্রয়োগ করা যায়। ফলে কৃষকের অর্থ ও সময় সাশ্রয় হয় এবং ফসলের উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। এ যন্ত্রের উপযোগিতা প্রমাণে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। যার আওতায় প্রকল্প এলাকার শস্য, শস্য বিন্যাস, মাটি ও কৃষকের চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে সঠিক মডেলের কম্বাইন হারভেস্টার নির্বাচন ও বিজনেস মডেল তৈরি করা হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কীটনাশক ও বালাইনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ছে, তেমনি কৃষকের স্বাস্থ্যহানি ঘটছে। বিভিন্ন ধরনের বালাইনাশকের প্রভাবে মানুষ, গবাদি পশু, মত্স্য সম্পদসহ সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ছে। কীটনাশক মাটি ও ভূগর্ভস্থ পানিকে দূষিত করে জনস্বাস্থ্যকে বিপজ্জনক করে। এ বিষাক্ত পানি ব্যবহারে মানুষের স্নায়বিক রোগ বা ক্যান্সারও সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া এসবের ব্যবহারের কারণে অনেক উপকারী পোকাও ধ্বংস হয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশে সাধারণত ধান ক্ষেতে বাদামি গাছফড়িং বা কারেন্ট পোকার আক্রমণ সবচেয়ে বেশি দেখা দেয়। ধান রোপণের আগেই কিছু ব্যবস্থা নিলে বিশেষ কিছু পোকার আক্রমণ রোধ করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট দূরত্বে চারা রোপণ, আইলের মাঝে বিলি কেটে দেয়া, ইউরিয়া সারের যথাযথ প্রয়োগ, আগাম ও প্রতিরোধক্ষমতা সক্ষম জাতের চারা রোপণ ইত্যাদি। প্রাকৃতিক নিয়মেই জমিতে ক্ষতিকর পোকার পাশাপাশি বন্ধু পোকাও থাকে, যারা ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে। কিন্তু কোনো বিচার-বিবেচনা না করে কেবল পোকা দমনে ওষুধ ব্যবহার করা হলে ভালো পোকাও মারা পড়ে, যা জমির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে ধান ক্ষেতে হাঁস ছেড়ে দেয়া একটি সহজ সমাধান হতে পারে। তাছাড়া নিম, বন কলমি, নিশিন্দা, হলুদ প্রভৃতি গাছের নির্যাস ও মেহগনি বীজের কার্নেলের নির্যাস ব্যবহার করেও বাদামি গাছফড়িং দমন করা সম্ভব। যার মাধ্যমে পরিবেশের ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না। এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর অর্গানিক এগ্রিকালচার মুভমেন্টের (আইএফওএম) সদস্য ও বাংলাদেশ জৈব কৃষি নেটওয়ার্কের (বিওএএন) সাধারণ সম্পাদক ড. মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, কীটনাশক ও বালাইনাশকের ভারসাম্যহীন ব্যবহারের কারণে অর্থের অপচয় হচ্ছে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, পাশাপাশি কৃষকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। আবার নদী-নালা কিংবা জলাধারে এখন সেভাবে ছোট মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী আগাছানাশকের ক্ষতিকর স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে নানা তথ্য উঠে এসেছে। এমনকি ক্যান্সারের মতো রোগের কারণও হচ্ছে আগাছানাশক। কৃষিতে বালাইনাশকের প্রয়োজন হলে বায়ো পেস্টিসাইডসের ব্যবহার বাড়াতে হবে। সারা বিশ্বে যে জৈব কৃষির প্রচলন হচ্ছে, সেটি কার্যকরভাবে দেশে চালু করতে হবে। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমে আসবে, পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকিও কমবে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে দেশের শস্য ক্ষেতে বিভিন্ন জাতের পোকার মধ্যে মাত্র ৩৮ শতাংশ ফসলের জন্য ক্ষতিকর। ফসলের জন্য সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ফসলের উপকার করছে বাকিসব কীটপতঙ্গ বা পোকা। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ সরাসরি ফসলের জন্য উপকারী। আর ৩২ শতাংশ পোকা ক্ষতিকর পোকা খেয়ে বা পরজীবী ও পরভোজী হিসেবে ফসলের উপকার করে থাকে। কিন্তু পোকা দমনে কীটনাশকের ব্যবহার বাড়ার ফলে উপকারী পোকা ধ্বংস হচ্ছে। তাই উপকারী পোকা রক্ষা করা ছাড়াও অবাধে কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে কৃষক প্রশিক্ষণ ছাড়াও বিকল্প পদ্ধতি ও প্রযুক্তি কৃষকের মাঝে সম্প্রসারণ করতে হবে। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা প্রকল্প ছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিষমুক্ত ও কীটনাশকমুক্ত শাক-সবজি ও ফল আবাদের পদ্ধতি কৃষকের মাঝে পৌঁছে দিতে হবে। ফেরোমেন ফাঁদ, জৈব বালাইনাশক ও নতুন প্রযুক্তিগুলো জনপ্রিয় করতে হবে।

  • জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার। দূষিত হচ্ছে ভূউপরিস্থ পানি। ক্ষতির মাত্রা বিবেচনায় বেশকিছু কীটনাশকের আমদানি ও ব্যবহার এরই মধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি আবার নিষিদ্ধ হয়েছে প্রায় দুই যুগ আগে। যদিও এখনো দেশের বিভিন্ন জেলার ভূউপরিস্থ পানিতে সেগুলোর উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সমীক্ষার তথ্য পর্যালোচনার ভিত্তিতে পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায়ও উঠে এসেছে, দেশের ১৯ জেলার ভূউপরিস্থ পানিতে অত্যন্ত বিপজ্জনক মাত্রায় কীটনাশকের ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে। দেশে মূলত ধান আবাদের ক্ষেত্রেই কীটনাশকের ব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশি। ব্যবহারের পর এ কীটনাশক গিয়ে জমা হচ্ছে নালা, পুকুর, খাল, বিল ও নদীর পানিতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব কীটনাশকের কার্যকারিতা থাকছে বছরের পর বছর। যে ১৯ জেলার ভূউপরিস্থ পানিতে এসব কীটনাশকের বিপজ্জনক মাত্রায় উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে, সেগুলো হলো—কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, সুনামগঞ্জ, সিলেট, ঢাকা (সাভার ও ধামরাই), শরীয়তপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, মাগুরা ও মেহেরপুর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের দুই শিক্ষক শফি মুহাম্মদ তারেক ও ফাহমিদা পারভিন এবং শিক্ষার্থী মো. মোর্শেদুল হক এ গবেষণাটি চালান। গবেষণাটি চালাতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলার পানিতে দূষণ ঘটানো বিপজ্জনক পদার্থের উপস্থিতি নিয়ে গত দুই দশকের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিবেদন-নিবন্ধ ও সমীক্ষার তথ্য পর্যালোচনা করেছেন তারা। একই সঙ্গে গত ১০ বছরে দেশের বিভিন্ন জেলার ভূউপরিস্থ পানির গুণগত মানের পরিবর্তনকেও বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে। গবেষণার ফলাফলে উঠে আসে, উল্লিখিত ১৯ জেলার ভূউপরিভাগের পানিতে জনস্বাস্থ্যের জন্য সহনশীল মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে দূষণ ঘটছে। দূষিত এ পানি সংশ্লিষ্ট এলাকার জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে বেড়েছে স্থানীয়দের মধ্যে ক্যান্সারের মতো অসংক্রামক মরণব্যাধির প্রাদুর্ভাব ছড়ানোর ঝুঁকিও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে কৃষিজীবী মানুষের মধ্যে মারাত্মক সব অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। ভারতের পাঞ্জাবেও কৃষকদের মধ্যে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব বাড়ার প্রধান কারণ হিসেবে কীটনাশকের অপরিমিত ব্যবহারকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানকার কৃষকদের মধ্যে বর্তমানে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব এতটাই বেড়েছে যে স্থানীয় রেল কর্তৃপক্ষকে পাঞ্জাবের ভাতিন্ডা থেকে শুরু হয়ে রাজস্থানের বিকানির পর্যন্ত ক্যান্সার রোগীদের জন্য বিশেষ একটি ট্রেন চালু করতে হয়েছে। এ ‘ক্যান্সার ট্রেনের’ যাত্রীদের সিংহভাগই বিকানিরের আচার্য তুলসি রিজিওনাল ক্যান্সার হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের রোগী। এ দৃশ্যের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশেও। এখনো অনেক স্থানে কৃষকদের মধ্যে বাছবিচারহীনভাবে ও অপরিমিত মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে। এমনকি ভূউপরিস্থ পানিতে আমদানি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ কীটনাশকের উপাদান মেশারও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এসব কিছুর ধারাবাহিকতায় এরই মধ্যে দেশের ক্যান্সার আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর প্রধান অংশ হয়ে উঠেছেন কৃষকরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কীটনাশক ও রাসায়নিকের প্রভাবে শুধু ক্যান্সার নয়, অসংক্রামক অন্যান্য রোগেরও প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। কীটনাশকের ফলে সৃষ্ট দীর্ঘমেয়াদি অনেক রোগ আবার শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ে। এ ঝুঁকি মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে একটিমাত্র পদক্ষেপ নিলে চলবে না। এর জন্য দূরদর্শী ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। একটা সম্মিলিত পদক্ষেপ ছাড়া কীটনাশকের অতিমাত্রায় ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। দেশে যে হারে খাদ্যের প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে ফসলের ক্ষতি রোধে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। হঠাৎ করে কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করে দিলে খাদ্য ঘাটতিও দেখা দিতে পারে। কিন্তু কীটনাশক কম ব্যবহার করে কীভাবে ফসলের উৎপাদন ঠিক রাখা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে যেটি প্রয়োজন সেটি হলো কীটনাশক ও রাসায়নিকের পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করা, ব্যবহার না জানলে তা প্রয়োগ থেকে বিরত থাকা এবং সরকারের তদারকি ও পর্যবেক্ষণ বাড়ানো। কীটনাশকের ফলে কী কী রোগের সৃষ্টি হচ্ছে, তা নিয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষায় গুরুত্ব দেয়া উচিত। অনেক রোগ এখন শনাক্তই করা যায় না। কারণ তার উৎস চিকিৎসকরাও জানেন না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের গবেষণাটিতেও উঠে এসেছে, অতিমাত্রায় স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশ দূষণকারী হওয়ায় দেশে ডাইক্লোরোডিফেনাইলট্রাইক্লোরোইথেন (ডিডিটি) ও হেপ্টাক্লোর নামের দুটি কীটনাশক নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৯৭ সালে। এর প্রায় দুই যুগ পরও দেশের বিভিন্ন জেলার ভূউপরিস্থ পানিতে কীটনাশক দুটির উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে কুমিল্লা জেলার জলাভূমিগুলোর পানিতে ডিডিটি পাওয়া গিয়েছে লিটারে ৮ দশমিক ২৯ মাইক্রোগ্রাম। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড অনুযায়ী, মানবদেহে এর সহনীয় মাত্রা লিটারে ১ মাইক্রোগ্রাম। ফেনী, রাজশাহী, সুনামগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়ও বিভিন্ন মাত্রায় এর উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে। অন্যদিকে হেপ্টাক্লোরের সহনীয় মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে লিটারে দশমিক শূন্য ৩ মাইক্রোগ্রাম। কিন্তু মাদারীপুরের ভূউপরিস্থ পানিতে হেপ্টাক্লোরের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে লিটারে ৫ দশমিক ২৪ মাইক্রোগ্রাম। নাটোর ও সুনামগঞ্জের ভূউপরিস্থ পানিতেও কীটনাশকটির উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে নিরাপদ মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রয়োগের ১৫ বছরের পরও পানিতে এসব কীটনাশকের কার্যকারিতা বা উপস্থিতি পাওয়া যায়। কিন্তু আমদানি ও প্রয়োগ নিষিদ্ধের দুই যুগ পরও পানিতে এগুলোর উপস্থিতি পাওয়ার বিষয়টি দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত আশঙ্কাজনক একটি তথ্য। গবেষণায় পাওয়া ফলাফল এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা এলসেভিয়ারের এনভায়রনমেন্টাল চ্যালেঞ্জেস জার্নালে ‘রিসেন্ট স্ট্যাটাস অব ওয়াটার কোয়ালিটি ইন বাংলাদেশ: আ সিস্টেম্যাটিক রিভিউ, মেটাল অ্যানালাইসিস অ্যান্ড হেলথ রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষক দলের প্রধান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শফি মুহাম্মদ তারেক এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, এ পর্যন্ত পানির গুণাগুণ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে গবেষণা হয়েছে। তবে সেসব গবেষণায় বিস্তারিত কোনো বিষয় উঠে আসেনি। এগুলোর আওতাও সীমাবদ্ধ ছিল নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যেই। এ গবেষণায় সব অঞ্চলের ভূউপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির গুণাগুণ উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা দেখতে পেয়েছি, ভূউপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হওয়ার গবেষণার আওতাধীন অঞ্চলের বেশির ভাগ নদী, খাল ও যেকোনো জলাশয় ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। কোনো কোনো অঞ্চলে সাদা চোখে দূষণ দেখা না গেলেও সেখানে এরই মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। একইভাবে গভীর নলকূপের পানিও নষ্ট হয়েছে। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। গবেষকদের ভাষ্যমতে, দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলের পানিতে অর্গানোফসফরাস, কার্বম্যাট, অর্গানোক্লোরিন ও ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন গ্রুপের বিভিন্ন কীটনাশক পাওয়া গেছে। এসব কীটনাশক মাছ চাষের পুকুর, কৃষি খামারের নিকটবর্তী জলাভূমিতে গত দুই দশক ধরেই বিভিন্ন মাত্রায় পাওয়া যাচ্ছে। এসব কীটনাশকে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিকের মিশ্রণ থাকায় তা প্রয়োগের যথাযথ নিয়ম রয়েছে। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, সতর্কতা ও সচেতনতা অবলম্বন না করে এগুলো মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বেঁচে যাওয়া অতিরিক্ত কীটনাশকও সঠিক নিয়মে নষ্ট করা হচ্ছে না। এসব কীটনাশক ব্যবহারের পরিবেশগত ক্ষতির দিক বিবেচনায় নিয়েও কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোয় ভূউপরিস্থ পানির গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে পাঁচ ধরনের অর্গানোফসফেট পাওয়া গিয়েছে। পোকা দমনে কার্যকর হওয়ায় ক্লোরোপাইরিফস নামে আরেকটি কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে। ডব্লিউএইচওর তথ্য অনুযায়ী, পানিতে লিটারে ৩ মাইক্রোগ্রামের বেশি ক্লোরোপাইরিফস থাকলেই তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উত্তরাঞ্চলের জেলা রংপুর এবং ঢাকার সাভার ও ধামরাইয়ের পানিতে এখন এ ক্লোরোপাইরিফসের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া মেহেরপুরেও তা মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডায়াজিনন, ম্যালাথিয়ন, প্যারাথিয়ন ও কুইনালফস ঢাকার ধামরাই ও সাভার এবং রংপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলাসহ দেশের অনেক অঞ্চলেই পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া মাগুরা, সিলেট, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, বগুড়া, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নাটোর ও বান্দরবানের বিভিন্ন উপজেলা, ইউনিয়ন এবং অঞ্চলে ডিডিটি, অর্গানোফসফরাস, কার্বম্যাট, অর্গানোক্লোরিন, অর্গানোফসফেট ও ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বনসহ বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ও রাসায়নিকের উপস্থিতি বিপজ্জনক মাত্রায় পাওয়া গিয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ক্রপ প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশন (বিসিপিএ) সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯৫৭ সালে কৃষি জমিতে বালাই ও কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে নানা সময়ে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ ও সহযোগিতায় এর ব্যবহার দিন দিন সম্প্রসারণ হয়েছে। কীটনাশক ও বালাইনাশকের ব্যবহার বাড়াতে দেশে বিভিন্ন ধরনের নীতিসহায়তা ও বিধিমালা এবং আইন প্রণয়নও হয়েছে। বর্তমানে দেশে দুই শতাধিক কোম্পানি এসব কীটনাশক ও বালাইনাশকের বিপণন ও উৎপাদন করে আসছে। এছাড়া পাঁচ হাজারের ওপরে কীটনাশকের নিবন্ধন নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে গত দেড় যুগে বাংলাদেশে কীটনাশক ও বালাইনাশকের ব্যবহার বেড়েছে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে। বর্তমানে বছরে গড়ে ৪০ হাজার টনের কাছাকাছি কীটনাশকের ব্যবহার হচ্ছে। এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর অর্গানিক এগ্রিকালচার মুভমেন্টের (আইএফওএম) সদস্য ও বাংলাদেশ জৈব কৃষি নেটওয়ার্কের (বিওএএন) সাধারণ সম্পাদক ড. মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, কীটনাশক ও বালাইনাশকের ভারসাম্যহীন ব্যবহারের কারণে দেশের নদী-নালা বা জলাধারে এখন সেভাবে ছোট ছোট মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী আগাছানাশকের ক্ষতিকর স্বাস্থ্যঝুঁকির তথ্য উঠে এসেছে। এমনকি ক্যান্সারের মতো রোগেরও কারণ হচ্ছে আগাছানাশক। কৃষিতে বালাইনাশকের প্রয়োজন হলে বায়োপেস্টিসাইডসের ব্যবহার বাড়াতে হবে। দেশে জৈব কৃষির কার্যকর প্রচলন ঘটানোও জরুরি। উপকারী পোকা রক্ষা করা ছাড়াও অবাধে কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া ছাড়াও বিকল্প পদ্ধতি ও প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ঘটানো প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিষ ও কীটনাশকমুক্ত শাক-সবজি-ফল আবাদের পদ্ধতি কৃষকের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। এছাড়া ফেরোমেন ফাঁদ, জৈব বালাইনাশক ও নতুন প্রযুক্তিগুলো জনপ্রিয় করতেও উদ্যোগ নেয়া জরুরি।

  • দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চাল। এখনো দেশের দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের মোট আয়ের সিংহভাগ ব্যয় হয় চালের পেছনে। আবার স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনধারণের প্রধান অবলম্বন খাদ্যশস্যটিরই দাম বাড়ে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, এ সময় জাতীয় গড় মূল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশের মধ্যেই ওঠানামা করেছে। যদিও এ সময় দানাদার খাদ্যশস্য, বিশেষ করে চালের মূল্যস্ফীতির হার প্রায় সাড়ে ১২ থেকে শুরু হয়ে ১৫ শতাংশও ছাড়িয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষের চাল ভোগের পরিমাণ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের চেয়ে অনেক বেশি। সে হিসেবে চালের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় দরিদ্ররাই। যদিও বাজারের বড় প্রভাবকদের মধ্যে প্রায়ই নানা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পণ্যটির মূল্য অস্থিতিশীল করে তোলার প্রবণতা দেখা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে জাতীয় মূল্যস্ফীতির চেয়ে চালের মূল্যস্ফীতি ছিল দ্বিগুণেরও বেশি। কখনো কখনো তা তিন গুণের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গড় মূল্যস্ফীতির হার সর্বোচ্চে উঠেছিল জুনে। ওই সময় গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। যদিও এ সময় চালের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৫ দশমিক ১৮ শতাংশ। পরের মাস জুলাইয়ে গড় মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশে নামলেও চালের মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৮২ শতাংশে। এছাড়া এপ্রিল ও মে মাসে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৫৬ ও ৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। যদিও এ দুই মাসে চালের মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৪৫ ও ১২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। অন্যদিকে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৫৪ ও ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। চালের মূল্যস্ফীতির হার ছিল যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৬২ ও ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে চালনির্ভরতা আয়ভিত্তিক অন্যান্য শ্রেণীর চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে উঠে এসেছে, দেশে খানাপিছু গড় মাসিক আয় ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশই যায় খাদ্য কেনায়। দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে মাসিক মোট আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় হয় খাদ্যের পেছনে। আবার এ জনগোষ্ঠীর চাল ভোগের পরিমাণও অন্যদের চেয়ে বেশি। দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চালের মাথাপিছু দৈনিক ভোগ ৪৭০ গ্রাম, যেখানে অন্যদের ক্ষেত্রে তা ৩৬৬ গ্রাম। প্রধান খাদ্যশস্যটির মূল্যস্ফীতির বোঝাও আবার তাদের জন্যই সবচেয়ে ভারী হয়ে দেখা দেয় বলে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। চালের মূল্যস্ফীতিকে দরিদ্র ও নাজুক জনগোষ্ঠীর প্রকৃত আয় কমে যাওয়ারই নামান্তর বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বিভিন্ন পরিসংখ্যান পর্যালোচনার ভিত্তিতে তারা বলছেন, চাল ও দানাদার খাদ্যশস্যের দাম বাড়লে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়। খাদ্য ব্যয় বাড়লে তা নির্বাহের পর অবশিষ্ট টাকা দিয়ে অন্যান্য খরচ মেটাতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। বিপন্ন হয় পুষ্টিনিরাপত্তা, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অন্যান্য প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিতের বিষয়টিও। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ‘বাংলাদেশ ফুড মার্কেট পারফরম্যান্স: ইনস্ট্যাবিলিটি, ইন্টিগ্রেশন অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনস’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, খাদ্যমূল্যস্ফীতি বাড়লে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারগুলো। ৭০ শতাংশের বেশি হতদরিদ্র পরিবার তখন চালের ভোগ কমিয়ে দেয়। শুধু দরিদ্রদের বেলায় এ হার ৬৬ শতাংশ। দরিদ্র ও অতিদরিদ্রের বাইরে মধ্যবিত্তরাও খাদ্যমূল্যস্ফীতি দিয়ে প্রভাবিত হয়। এ শ্রেণীর প্রায় ২৪ শতাংশ পরিবার ভোগ কমিয়ে দেয়। কারণ পরিবারের অন্যান্য ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হয় তাদের। আবার খাদ্যচাহিদা মেটাতে গিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয়ে পিছিয়ে পড়ে তারা। দরিদ্র বা অতিদরিদ্র শ্রেণীর পরিবারগুলো তাদের উপার্জনের ৫০-৭০ শতাংশ ব্যয় করে খাদ্য বাবদ। এর আবার সিংহভাগ ব্যয় হয় চাল কেনায়। ফলে চালের দাম বাড়লে বাধ্য হয়ে এ শ্রেণীর মানুষ ভোগ কমিয়ে দেয়। এর প্রভাব পড়ে দৈনন্দিন পুষ্টিচাহিদায়। এতে একদিকে পুষ্টিহীনতায় ভোগা পরিবারের সংখ্যা বাড়ে, অন্যদিকে দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনা সম্ভব হয় না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, মূল্যস্ফীতি একটি দেশের সাধারণ পর্যবেক্ষণ হলেও দরিদ্র ও স্বল্প আয়, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বা নির্ধারিত আয়ের মানুষের ওপর এর প্রভাব অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। কোনো কোনো নিম্ন ও দরিদ্র মানুষের মোট আয়ের ৩০-৫০ শতাংশই ব্যয় হয় চাল কেনায়। চালের দাম বাড়লে এর অভিঘাত সবচেয়ে বেশি পড়ে কম আয়ের মানুষের ওপর। চালের মূল্যস্ফীতি দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দিচ্ছে। আর কভিডকালে এ মূল্যস্ফীতির নানামাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এসব মানুষের ওপর চালের মূল্যস্ফীতির অভিঘাতটা জাতীয় মূল্যস্ফীতির চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হবে। সরকারের দুর্বল মজুদ ব্যবস্থাপনা ও খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থায় অপর্যাপ্ততার কারণে বাজারসংশ্লিষ্টরা সুযোগ নিয়েছে। আমদানি ও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমে চালের মজুদ ও সরবরাহ পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি করতে হবে। সেটি করতে না পারলে সামনে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। মানুষের দুর্গতিও আরো বাড়বে। তবে বোরো মৌসুম শুরু হলে চালের মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে নামতে পারে। তার আগ পর্যন্ত দরিদ্র মানুষের জন্য স্বল্পমেয়াদে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার ও খোলাবাজারে খাদ্যপণ্য বিক্রিসহ রেশন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এছাড়া মধ্যমেয়াদে খাদ্য আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ বাড়িয়ে দাম কমানোর উদ্যোগও নেয়া যেতে পারে। বিবিএসের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজধানীতে প্রতি কেজি নাজিরশাইল ও মিনিকেটের গড় দাম ছিল ৬৮ টাকা ১৫ পয়সা, যা চলতি অর্থবছরের আগস্টে ৬৯ টাকা ৫০ পয়সা, সেপ্টেম্বরে ৬৯ টাকা ৭৩ ও অক্টোবরে ৬৯ টাকা ৭৭ পয়সায় উন্নীত হয়েছে। গত অর্থবছরে বোরো ধানের চালের গড় দাম ছিল ৫২ টাকা ২ পয়সা। সেখান থেকে বেড়ে আগস্টে তা ৫২ টাকা ৮৬ পয়সা, সেপ্টেম্বরে ৫২ টাকা ৯৭ ও অক্টোবরে ৫৫ টাকা ৯৯ পয়সায় উন্নীত হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, চালের দাম বেশি হওয়ার অভিঘাত কম আয়ের মানুষের কাছে নানামুখী হতে পারে, এটি নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তাদের ওপর অভিঘাতের ভারটা একটু বেশিই হবে। তাই চালের দাম আরো একটু কম হলে ভালো হতো বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। সেজন্য সরকার পরিকল্পনামাফিক কাজ করছে। বিশেষ করে অন্যায় হস্তক্ষেপ করে কেউ যেন চালের দাম বাড়তে না পারে, সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। উৎপাদনের মাধ্যমে সরবরাহ বাড়াতে কৃষি মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করছে। তাদের কার্যক্রমের সফলতাও দৃশ্যমান। দরিদ্র মানুষের সুযোগ-সুবিধাও বাড়ানো হচ্ছে। আবার আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ বাড়াতে শুল্ক সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এখানে বাজার ব্যবস্থাপনা ও কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করেই আমরা পদক্ষেপগুলো নিচ্ছি।

  • ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের প্রধান মহানগরের খানাগুলোতে পর্যাপ্ত খাবারের সংকট রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৩ শতাংশের বেশি মানুষ এখনো অনাহারে থাকে। অন্যদিকে এসব শহরে প্রায় ১৫ শতাংশের বেশি খানা প্রয়োজনের তুলনায় কম খান। আর পর্যাপ্ত খাবার না থাকায় চিন্তায় থাকে প্রায় ২২ শতাংশ পরিবার। যদিও দেশের সব মহানগরে এ হার ২১ শতাংশের কাছাকাছি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ‘নগর আর্থসামাজিক অবস্থা নিরূপণ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পর্যাপ্ত খাবার না থাকার জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশ পরিবার চিন্তিত ছিল। এ হার ঢাকা ও চট্টগ্রাম ব্যতীত অন্য শহরে ছিল ১৮ দশমিক ২১ শতাংশ। যেখানে সব মহানগরে এ হার ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ২০ দশমিক ৬৪ শতাংশ পরিবার পছন্দের খাবার খেতে পারেনি। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরের শহরে এ হার ২০ দশমিক ৬৫ শতাংশ। সব মহানগরে এ হার ২০ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের ১৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ খানার অপছন্দের খাবার খেতে হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরের মহানগরে এ হার ১১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। সব মহানগরে যা ১৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রামের ১৫ দশমিক ১৭ শতাংশ খানা প্রয়োজনের তুলনায় কম খেয়েছে। যেখানে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরের মহানগরে এ হার ১৫ দশমিক ১৭ শতাংশ। সব মহানগরে যার গড় হার ১৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। নগর আর্থসামাজিক অবস্থা নিরূপণে জরিপটি ২০১৯ সালের ৮ থেকে ২৬ ডিসেম্বর সময়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এ জরিপে ঢাকা-চট্টগ্রাম নগর এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম ব্যতীত অন্য নগরকে দুটি প্রতিবেদনাধীন এলাকা ধরে নিম্ন আয়ের অংশকে প্রাধিকার দিয়ে তিনটি স্তর করা হয়ছে। এসব স্তরের মধ্যে উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন আয়ের ভিত্তিতে নির্বাচিত মোট ৮৬টি প্রাথমিক নমুনা এলাকা (পিএসইউ) থেকে ২ হাজার ১৫০টি নগরাঞ্চলের খানা হতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোন খাবার ছিল না বা খাবার কেনার টাকা ছিল না এমন খানার পরিমাণ ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রায় ১১ দশমিক ৯১ শতাংশ। দেশের সব মহানগরে এ হার ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ। খাবার না থাকায় রাতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রায় ৯ দশমিক ২৩ শতাংশ খানা। সব মহানগরে এ হার ৮ দশমিক ১২ শতাংশ। জরিপকালে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মহানগরের পুরো দিন অনাহারে ছিল ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ খানা। অন্যদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরের মহানগরে এ হার মাত্র ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। সারা দেশের মহানগরের ২ দশমিক ৮০ শতাংশ পরিবার অনাহারে ছিল। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৯৩ দশমিক ১২ শতাংশ খানা সামান্য ক্ষুধার্ত ও ক্ষুধার্ত নয়। যেখানে সারা দেশের মহানগরে এ হার ৯৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। অন্যদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ খানা মোটামুটি ক্ষুধার্ত থাকলেও সারা দেশের মহানগরে এ হার ৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের তীব্র ক্ষুধার্ত থাকে শূন্য দশমিক ৩৪ শতাংশ খানা, যা অন্যান্য মহানগরে শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ। মোটামুটি অথবা তীব্র ক্ষুধার্ত থাকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ পরিবার। সারা দেশের মহানগরে এ হার ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। খাদ্য বাবদ ব্যয়ের বিষয়টিও বিবিএসের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রতি খানায় বাড়িতে তৈরি খাবারের জন্য ব্যয় হয় ১ হাজার ৮৯১ টাকা। যেখানে সারা দেশের মহানগরে এ ব্যয় ১ হাজার ৮৯৩ টাকা। বাড়ির বাইরের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রতিটি খানার জন্য ব্যয় ১৪৩ টাকা। সারা দেশের মহানগরে এ ব্যয় ১৩৪ টাকা। ফলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রতিটি খানায় খাদ্য বাবদ ব্যয় হচ্ছে ২ হাজার ৩৪ টাকা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়া অন্যান্য মহানগরে এ ব্যয় ২ হাজার ১ টাকা। দেশের সব মহানগরে গড়ে খাদ্য বাবদ ব্যয় হচ্ছে ২ হাজার ২৭ টাকা। খাদ্যনিরাপত্তা ও ভোগের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিটি করপোরেশনের নমুনা এলাকার খানায় এ বিষয়ে উদ্বেগ খুব বেশি। জরিপকালে প্রায় ২২ শতাংশ খানা আগের মাসে তাদের পর্যাপ্ত খাবার না থাকার বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। যদিও খুব কম সংখ্যক খানা উচ্চখাদ্য নিরাপত্তাহীন হিসেবে শ্রেণীভুক্ত হয়েছে। ৮ শতাংশ খানা লঘু খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। তবে নারীদের খাদ্য ভোগের অবস্থা সন্তোষজনকের কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। নমুনা এলাকার প্রায় এক-চতুর্থাংশ বা ২৪ শতাংশ খানার ক্ষেত্রে এ প্রবণতা পাওয়া গেছে। খাদ্য সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে স্বল্প আয়ের খানার মধ্যে একটি সাধারণ অনুসৃত কৌশল হলো ভোগকৃত খাবারের গুণগতমান এবং পরিমাণ হ্রাস করা। পুষ্টি পরিস্থিতির ওপর যা সরাসরি প্রভাব ফেলে থাকে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত খাদ্য ভোগ স্কোর অনুযায়ী গুরুতরভাবে নিম্ন খাদ্য ভোগের পর্যায়ে পড়ে অর্থাৎ স্কোর ৪২-এর নিচে রয়েছে এমন খানা এক-তৃতীয়াংশের বেশি (৩৪ শতাংশ)। বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী বিবেচনায়, স্বল্প-আয়ের খানাগুলো শুধু মাছ বাদে অন্য সব খাদ্যসামগ্রী সুপারিশকৃত ন্যূনতম ভেগের চেয়ে কম পরিমাণে ভোগ করে থাকে। সকল সিটি করপোরেশন এলাকার খানায় খাদ্য তালিকার মধ্যে ভাতের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, মাথাপিছু প্রতিদিন ২৭৫ গ্রাম। অন্যদিকে ঢাকা-চট্টগ্রামের তুলনায় অন্যান্য সিটি করপোরেশন এলাকার সামান্য পার্থক্য ছাড়া খানাগুলো মোট বাজেটের অর্ধেকই খাদ্যসামগ্রীর পেছনে ব্যয় করে থাকে। ঢাকা-চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার খানাগুলো পোলট্রির মতো প্রাণিজাত খাবার বেশি পরিমাণে ভোগ করে থাকে। যার কারণে তাদের মাথাপিছু মাসিক খাদ্যভোগ ব্যয় তুলনামূলক বেশি।

  • খাদ্য অধিদপ্তর গত বছর বোরো মৌসুমে উৎপাদিত চাল সংগ্রহ করেছিল ১৪ লাখ টনের কিছু কম। এর মধ্যে আট লাখ টনের কাছাকাছি এখনো মজুদ অবস্থাতেই রয়ে গিয়েছে। খোদ খাদ্য অধিদপ্তর নিজেই এখন দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা এসব চাল মানহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে। এজন্য গত বছর সংগৃহীত বোরো চাল দ্রুত ছাড়করণের নির্দেশনা দিয়েছে অধিদপ্তর। সারা দেশে চলতি বছরের বোরো মৌসুমের আবাদ কার্যক্রম এরই মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। যদিও খাদ্য অধিদপ্তরের গত বছর সংগৃহীত বোরো চালের মজুদ এখনো অর্ধেকও ফুরায়নি। বোরো মৌসুমের চাল দীর্ঘদিন সংগ্রহে রাখা যায় না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি দুশ্চিন্তায় ফেলেছে খাদ্য অধিদপ্তরকেও। অধিদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, গত বোরো মৌসুমে চাল সংগৃহীত হয়েছিল প্রায় ১৩ লাখ ৮১ হাজার ৫৫২ টন। এর মধ্যে মিলারদের কাছ থেকে কেনা হয়েছিল ১১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৬৩ টন। সর্বশেষ ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশের এলএসডি ও সিএসডিগুলোয় এখনো গত বছর সংগ্রহ করা ৭ লাখ ৭০ হাজার ৮৬৯ টন বোরো চাল মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে সেদ্ধ চাল ৭ লাখ ৫৮ হাজার ৫৭১ টন ও আতপ চাল ১২ হাজার ২৯৮ টন। বোরো চালের সবচেয়ে বেশি মজুদ রয়েছে রাজশাহীতে—১ লাখ ৮৮ হাজার ১৫৩ টন। এরপর সবচেয়ে বেশি রয়েছে রংপুর বিভাগে। ওই বিভাগের গুদামগুলোয় এখনো ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬৬৭ টন বোরো চালের মজুদ রয়ে গিয়েছে। খুলনা বিভাগে মজুুদ রয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬ টন। এছাড়া ঢাকা বিভাগে ৮৭ হাজার ৩৩১ টন, ময়মনসিংহে ৭৭ হাজার ৩৯৬, চট্টগ্রামে ৮৬ হাজার ৩৬২, সিলেটে ২ হাজার ৭৪৯ ও বরিশালে ২০ হাজার ৯৪৫ টন বোরো চালের মজুদ রয়ে গিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের আবহাওয়ায় আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা বেশি। এ ধরনের আবহাওয়া কীটপতঙ্গ জন্মানোর জন্য আদর্শ। দেশের গুদামগুলো বর্তমানে বেশ পুরনো হয়ে পড়েছে। এ কারণে এসব গুদামে পোকামাকড়ের উপদ্রবও বেশি। পুরনো এসব খাদ্যগুদামে খাদ্যশস্য সংরক্ষণের উপযুক্ত পরিবেশের অভাবও রয়েছে। আবার বোরো চালের সংরক্ষণ সক্ষমতা বেশ কম। ফলে দ্রুত বিতরণ করতে না পারলে এসব বোরো চাল দ্রুত মানহীন হয়ে পড়তে পারে। এ অবস্থায় জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায়ের খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের দ্রুত চাল ছাড় করার বিষয়ে চিঠি দিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। এ বিষয়ে সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের গুদামের মান খুব বেশি ভালো না। আবহাওয়ার কারণে চালে দ্রুত পোকার আক্রমণ হয়। আবার আমাদের মজুদ ব্যবস্থাপনাও খুব বেশি উন্নত নয়। ফলে চার-ছয় মাসের বেশি মজুদ রাখা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। আবার চালের সংগ্রহের সময়ও চালের মান যাচাই-বাছাই করে নেয়া দরকার। সংগ্রহের সময়ে এমনিতেই বিভিন্ন চাপে মানহীন চাল নেয়ার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে সে চাল বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় না। নিশ্চিত মানহীনতার বিষয় যদি এসে যায় তাহলে বাজারে এ চাল দেয়া যৌক্তিক হবে না। তাই বোরো চালের এ মজুদ খালি করার উদ্যোগ আরো আগেই নেয়া প্রয়োজন ছিল। তাহলে বাজারে চালের দামও আরো নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত। আবার দ্রুত গুদাম থেকে চাল ছাড় করতে গিয়ে যাতে গুদামই খালি না হয়ে যায়, সেটিও নজরে রাখতে হবে। অন্যথায় বাজারে নেতিবাচক বার্তা যেতে পারে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের উদ্দেশে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আব্দুল্লাহ মামুন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন মজুদের ফলে বোরো চালের গুণগতমান হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য এসব চাল সংরক্ষণে যথাযথ পরিচর্যার জন্য সংশ্লিষ্টদের অধিকতর যত্নবান হওয়া দরকার। এ পরিস্থিতিতে গুদামগুলোয় সংরক্ষিত বোরো/২১ চাল ওয়ারেন্টি অনুযায়ী বিভিন্ন খাতে বিলি-বিতরণ করে নিঃশেষ করা প্রয়োজন। যেসব জেলা বা বিভাগের এলএসডি ও সিএসডিগুলোয় গত বছরের বোরো চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে, সেগুলো থেকে ঘাটতিতে থাকা জেলা বা বিভাগের এলএসডি-সিএসডিগুলোয় পাঠানো নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য অভ্যন্তরীণ সড়ক পরিবহন ঠিকাদার (আইআরটিসি), অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন ঠিকাদার (আইবিসিসি), বিভাগীয় সড়ক পরিবহন ঠিকাদারের (ডিআরটিসি) মাধ্যমে যথাসময়ে সূচি জারি করে গত বছরের বোরো চাল পাঠানো নিশ্চিত করতে হবে। এ নির্দেশনা অমান্য করে কোনো এলএসডি ও সিএসডি থেকে গত বছরের বোরো চালের পরিবর্তে সদ্য সংগৃহীত আমন চাল যাতে কোনো অবস্থাতেই বিলি-বিতরণ করা না হয়, সে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মনিটরিং করবেন। জানা গেছে, দেশের বেশির ভাগ গুদামেরই অবকাঠামো বেশ পুরনো। আবার দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক ব্যবস্থারও ঘাটতি রয়েছে। ফলে এসব খাদ্যগুদামে কীটের আক্রমণের শঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। আবার সংরক্ষণের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় আগেও বিভিন্ন সময়ে গুদামজাত খাবারের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে এখন খাদ্যশস্য মজুদের জন্য সনাতনী পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক পদ্ধতির প্রয়োগ শুরু হয়েছে। সেজন্য আধুনিক সাইলো তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব সাইলোয় খাদ্যশস্য মজুদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ থাকে। আবার কীটপতঙ্গ প্রতিরোধে স্থাপনা নির্মাণকালে ব্যবহার করা হচ্ছে বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন পদ্ধতি। তাছাড়া বাতাসের আর্দ্রতা ও উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণের জন্য উপযুক্ত কারিগরি সক্ষমতার ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বণিক বার্তাকে বলেন, প্রথাগত গুদাম ও চাল সংরক্ষণ ব্যবস্থার কারণে চালের মান ধরে রাখাটা একটু কঠিন। তবে চেষ্টা চলছে আধুনিক মানের গুদাম তৈরি করার। বেশকিছু আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির গুদাম নির্মাণাধীন রয়েছে। আবার আমন মৌসুমের জন্য চাল সংগ্রহ করতে হবে। এজন্য গত বছরের বোরো মৌসুমের সংগৃহীত চাল দ্রুত খালি করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে বোরোর মজুদ খালি হলেও আমন মৌসুমের চাল দিয়ে সেটি দ্রুতই পূরণ করা সম্ভব হবে। ফলে মোট মজুদে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

  • লবণ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। কয়েক বছর ধরেই দেশে বছরে ১৬-১৯ লাখ টন লবণ উৎপাদন হয়। যার সিংহভাগই আসে সমুদ্র উপকূলের জমি থেকে। তবে বাংলাদেশে উৎপাদিত লবণে পাওয়া গেছে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায়, এ লবণের প্রতি কেজিতে গড়ে প্রায় ২ হাজার ৬৭৬টি মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে। সেখানে বলা হয়, দেশের মানুষ যে হারে লবণ গ্রহণ করে তাতে প্রতি বছর একজন মানুষ গড়ে প্রায় ১৩ হাজার ৮৮টি মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করে। ফলে এ বিপুল পরিমাণ লবণের মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ‘প্রোলিফারেশন অব মাইক্রোপ্লাস্টিক ইন কমার্শিয়াল সি সল্টস ফ্রম দি ওয়ার্ল্ড লংগেস সি বিচ অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে আসে। এ গবেষণায় দেশে বাণিজ্যিকভাবে বিপণন হয় এমন ১৩টি ব্র্যান্ডের লবণের বিভিন্ন পরিমাণ নিয়ে পরীক্ষাগারে যাচাই-বাছাই করা হয়। এর মধ্যে ১০টি হলো দেশের স্বনামধন্য কোম্পানির ও তিনটি স্থানীয় পর্যায়ের রিফাইনারির। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহ করা হয়। গবেষণা শেষে দেখা যায়, দেশের উৎপাদিত লবণে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি এত বেশি যে, বাছাইকৃত দেশগুলোর মধ্যে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ দেশ বাংলাদেশ। গড়ে প্রতি কেজি লবণে ২ হাজার ৬৭৬ মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেলেও বেশকিছু লবণে এর চেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া গেছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক মূলত প্লাস্টিকেরই ক্ষুদ্র অংশ, যেটি আকারে দুই থেকে পাঁচ মাইক্রোমিটার হয়ে থাকে। সাধারণত নিত্যব্যবহার্য প্লাস্টিক বর্জ্য তাপমাত্রা, অণুজীব ও অন্যান্য কারণে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতিসংঘ পরিবেশ সম্মেলনে সামুদ্রিক প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণে শীর্ষ ১০ জরুরি পরিবেশগত সমস্যাগুলোর একটি হিসেবে প্লাস্টিককে তালিকাভুক্ত করা হয়। ২০১৫ সালে দ্বিতীয় জাতিসংঘ পরিবেশ সম্মেলনে পরিবেশ দূষণ ও পরিবেশবিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বৃহত্তর বৈজ্ঞানিক সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিককে। বাংলাদেশে পরীক্ষার জন্য ব্যবহূত নমুনায় সর্বনিম্ন ৩৯০ ও সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৪০০ মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায়। দেশের ভালো ব্র্যান্ডের লবণেও উচ্চমাত্রায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, এ উচ্চ উপস্থিতির মূল কারণ সমুদ্রে অতিমাত্রায় প্লাস্টিকের দূষণ ও দেশে প্লাস্টিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। এছাড়া লবণ উৎপাদনকারী অঞ্চলে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহারও লবণে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি বাড়াচ্ছে। সমুদ্র উপকূলে পর্যটকদের ব্যবহূত প্লাস্টিক সামগ্রীও লবণের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ বিষয়ে গবেষণা দলের প্রধান ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শফি এম তারেক বণিক বার্তাকে বলেন, মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি এখন ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। লবণ থেকে শুরু করে মাছের পেটেও এর উপস্থিতি মিলছে। মানুষ যেখানেই প্লাস্টিকের দূষণ করুক না কেন, তা এক পর্যায়ে সাগরে গিয়ে পৌঁছায়। এটি পানির স্রোত ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অনেকদিন ধরে ভাঙে। ভাঙা অংশগুলো আবার সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে ভেঙে আরো ক্ষুদ্র হয়। তখন এগুলো ন্যানো, ম্যাক্রো ও মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। এ ভাঙা অংশ থেকে বিসফিনলে নামের রাসায়নিক দ্রব্য নির্গত হয়, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। স্বল্প সময়ের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক দেশের স্বাস্থ্য সমস্যার অন্যতম ক্ষতির কারণ হবে বলে মনে করেন পরিবেশবিজ্ঞানের এ অধ্যাপক। তাই দ্রুত প্লাস্টিক দূষণের হার শূন্যে নামিয়ে আনার ওপর জোর দেন তিনি। পাশাপাশি লবণ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর জন্য মাইক্রোপ্লাস্টিক অপসারণ করতে পারে এমন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়ানো ও নীতি কার্যক্রম প্রণয়ন করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি। গবেষণাটির তথ্য নিয়ে লবণ মিল মালিক সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দিতে রাজি হননি কেউ। সমিতির সদস্যরা বলেছেন, কোম্পানিগুলো বিএসটিআইয়ের মানদণ্ড অনুসারে লবণ উৎপাদন ও বিপণন করছে। তবে বিএসটিআইয়ের মানদণ্ডে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সহনীয় মাত্রার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। যদি কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়, তাহলে তারা সেগুলো পরিপালন করবেন। জানা গেছে, সারা বিশ্বে গড়ে ৩৬ কোটি টন প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। বিশ্বব্যাংকের ‘টুয়ার্ডস এ মাল্টিসেক্টরাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাসটেইনেবল প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২০০৫ সালে ছিল ৩ দশমিক শূন্য ১ কেজি, যা ২০২০ সালে ৩ গুণ বেড়ে ৯ কেজিতে উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকা শহরে জনপ্রতি প্লাস্টিকের ব্যবহার ২২ কেজি ৫০০ গ্রাম, যা ২০০৫ সালে ছিল ৯ কেজি ২০০ গ্রাম। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্লাস্টিক মাটিতে মিশতে সময় লাগে প্রায় ৪০০ বছর। ফলে এতে একদিকে যেমন মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়, অন্যদিকে এটি ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠের পানির সঙ্গে মিশে পানিকে দূষিত করছে। এর মাধ্যমে এসব প্লাস্টিক মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের সঙ্গে ধীরে ধীরে মিশছে মাইক্রোপ্লাস্টিক, যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে গোটা প্রাণিজগতে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে ক্যান্সার, হরমোনের তারতম্য, প্রজনন প্রক্রিয়ায় বাধাসহ মারাত্মক সব ক্ষতি হচ্ছে। এ ভয়াবহ দূষণের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায় থেকেই বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, যে কয়টি উপাদান মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টি করে, তার মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক অন্যতম। বাতাস ও পানির মাধ্যমেও মানবদেহে এ প্লাস্টিক প্রবেশ করে। মাছেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে। দেশের সব লবণে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়াকে ইচ্ছাকৃত বলে মনে করছেন না এ বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, এটা অতিক্ষুদ্র একটি পরিমাণ। এতে লবণের ওজনে তেমন তারতম্য হবে না। এ ধরনের প্লাস্টিক মানুষের পরিপাকতন্ত্রের মাধ্যমে প্রবেশ করে যকৃৎ, ফুসফুসসহ অন্যান্য অঙ্গে বৈকল্য তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি হজমে প্রতিবন্ধকতা, নারী ও পুরুষের বন্ধ্যত্বও তৈরি করতে পারে। কারণ প্লাস্টিক মানবদেহে হরমোনের ভারসাম্যকে বাধাগ্রস্ত করে। দূষিত বাতাসের মাধ্যমেও প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে দেশে লবণের উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ১৬-১৯ লাখ টন। লবণ চাষে জড়িত ২৮-৩০ হাজার কৃষক। করোনাকালে কিছুটা ভাটা পড়লেও সম্প্রতি গড়ে প্রতি বছর ৫৭-৬৫ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হয়। গত বছর ৬০ হাজার ৭৯৬ একর জমিতে লবণ চাষ হয়েছে। এ বিপুল পরিমাণ লবণেই রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি। জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে লবণের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় কয়েক বছর আগে বিএসটিআই ২৭ ধরনের ৪০৬টি খাদ্যপণ্যের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করে। এর মধ্যে ৩১৩টি পণ্যের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। যেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৫২টি পণ্য নিম্নমানের পাওয়া যায়। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এ ৫২টি খাদ্যপণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এসব পণ্যের মধ্যে নয়টি লবণ কোম্পানিও ছিল। আবার বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের একটি যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও অণুজীবের পেটে ক্ষুদ্র আকারের মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। শুধু রাজধানীতে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টন বর্জ্য হচ্ছে, যার ১০ শতাংশই প্লাস্টিক। এসবের মাত্র ৪৮ শতাংশ ল্যান্ডফিল্ডে যাচ্ছে, ৩৭ শতাংশ পুনর্ব্যবহার হচ্ছে, ১২ শতাংশ প্লাস্টিক খাল ও নদীতে এবং ৩ শতাংশ ড্রেন ও খোলা জায়গায় ফেলা হচ্ছে। ফলে অবারিতভাবে প্লাস্টিক মিশছে পরিবেশে, যা মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে অনেক মাত্রায়। বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বুশরা নিশাত বলেন, দেশের শহরাঞ্চলে প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। বিশেষ বিশেষ এলাকায় এর ব্যবহার বেশি হচ্ছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে এ বৃদ্ধি উদ্বেগের কোনো কারণ হতো না। ইউরোপের দেশগুলোতে গড় মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেক বেশি হলেও সেগুলো সঠিকভাবে পুনর্ব্যবহার ও যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্লাস্টিক। বাংলাদেশ প্লাস্টিক দূষণের শিকার হওয়া দেশগুলোর তালিকায় সবচেয়ে উপরে থাকা দেশের অন্যতম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনাই এর জন্য দায়ী। প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হলে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে বলেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আলোচনায় উঠে এসেছে। সে অনুযায়ী সরকারকে পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ ও তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

  • সবশেষ আমন মৌসুমে দেশে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারের গুদামে বর্তমানে ১৭ লাখ টনের বেশি চাল মজুদ রয়েছে, যা অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় সরকারের চালের মজুদের রেকর্ড। এর পরও বাজারে চালের দাম সহনীয় পর্যায়ে আসছে না। সাধারণ মানের মোটা চালের দামও এখন অনেক মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। একটি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের জানুয়ারির খুচরা পর্যায়ের গড় দামের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক কৃষি বিভাগ ইউএসডিএ প্রকাশিত গ্রেইন অ্যান্ড ফিড আপডেট শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে খুচরা বাজারে সাধারণ মানের (মোটা চাল) প্রতি কেজি চালের গড় দাম ছিল ৩২ টাকার কিছু বেশি। সেই চালের দাম এ বছর হয়েছে ৪৭ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাত্ দুই বছরের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। অথচ ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে সাধারণ মানের চালের প্রতি কেজিতে গড় দাম ছিল ৩৬ টাকা। সেটি বেড়ে ২০১৮ সালে ৪৭ টাকার বেশি ছাড়িয়ে যায়। কয়েক দফা ওঠানামার পর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সর্বনিম্ন পর্যায়ে আসে। এরপর আবারো বাড়তে থাকে চালের দাম। সেই বছর নভেম্বরেই ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি কেজি চালের গড় দাম ৪৮ টাকা ছাড়িয়ে যায়। গত বছরের মে ও সেপ্টেম্বরে সাধারণ মানের চালের দাম ৪৯ টাকায় উন্নীত হয়, যা জানুয়ারিতে ৪৭ টাকা ৫০ পয়সায় নেমে আসে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর সবচেয়ে বেশি অভিঘাত পড়ে। চালের মূল্যস্ফীতি দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দেয়। আর কভিডকালে এ মূল্যস্ফীতি দ্বিমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সরকারের দুর্বল মজুদ ব্যবস্থাপনা ও খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থায় অপর্যাপ্ততার কারণে বাজারের নিয়ন্ত্রকসংশ্লিষ্টরা সুযোগ নিচ্ছেন। আমদানি ও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমে চালের মজুদ ও সরবরাহ পরিস্থিতি দ্রুত উন্নতি করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাজারে চালের সরবরাহে সংকট তৈরি না হলেও দাম অস্থিতিশীল। মূলত বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগীদের অনিয়ন্ত্রিত উত্থান, কার্যকর ও দক্ষ সরবরাহ চেইন না থাকা, চালের মজুদ ধারাবাহিকভাবে উচ্চপর্যায়ে না রাখা ও মনিটরিংয়ের অভাবে চালের বাজারে দাম অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৪৪-৪৮ টাকা। অন্যদিকে ভালো মানের চাল বিক্রি হয়েছে ৬০-৬৮ টাকায়। সরকারের শুল্ক সুবিধার মাধ্যমে চাল আমদানি করা, সরকারের মজুদ বেশি থাকা সত্ত্বেও চালের দাম খুব বেশি না কমার পেছনে মিলার ও ব্যবসায়ীদের একচ্ছত্র প্রভাবকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে ইউএনডিপির অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের মজুদ বেড়েছে। সরবরাহ বাড়াতে শুল্ক কমানো হয়েছে। এসব নানা উদ্যোগ নিয়েও বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। দেশের বড় ৫০টি অটো রাইস মিলের হাতেই থাকে বেশির ভাগ ধান-চালের মজুদ। তারা প্রচলিত আইন না ভেঙেই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। ফলে মজুদ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে। স্বাভাবিক আইনে অটো রাইস মিলগুলো চলার মতো ধান দেশে আছে কিনা সেটি ভাবতে হবে। ফলে কয়টা অটো রাইস মিলকে অনুমোদন দেয়া হবে এবং এসব মিলের উত্পাদন সক্ষমতা কতটুকু হবে, সে বিষয়ে সীমা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। তা না হলে কোনো ধরনের আইনের ব্যত্যয় না ঘটিয়েই চালের সব নিয়ন্ত্রণ এদের হাতে চলে যাবে। চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত বছরের ১২ আগস্ট চাল আমদানির শুল্ক কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। চালের আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। এ সুবিধা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। যদিও চাল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক বিরাজ করা হয়েছিল দেশীয় কৃষকদের সুবিধার জন্য। তবে চালের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণে ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্ব্বর বেসরকারিভাবে চালের আমদানি শুল্ক কমানোর অনুমতি দেয়া হয়। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শুল্কহার ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এরপর দেশে চালের আমদানি বেড়েছে ব্যাপক হারে। ২০২০-২১ অর্থবছরে চালের আমদানি হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ ৫৯ হাজার টন। এছাড়া চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চালের আমদানি হয়েছে ৯ লাখ ২৪ হাজার টন। এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে চালের দাম নির্ধারণ ও বিপণন প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগী বিশেষ করে মিলাররা ভীষণ শক্তিশালী ও পারদর্শী। কেননা বাজার তৈরি ও নিয়ন্ত্রণে কৃষকের কোনো ধরনের সাংগঠনিক সক্ষমতা নেই। সরকারের কর্তৃপক্ষ হিসেবে খাদ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই পর্যাপ্ত দক্ষতা ও হাতিয়ার। তাই সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। চালের সরবরাহ চেইনে আরো দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। পাশাপাশি কৃষকের মজুদ ক্ষমতা বাড়ানো ও তথ্য সরবরাহের ওপরও জোর দেয়ার কথা বলেন। বিভিন্ন মাধ্যম সঠিক নীতির অভাবে চাল কেনার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হতে দেখা যায় জানিয়ে তিনি বলেন, বাজার থেকে ধান না কেনার কারণে ধানের বাজারের একচ্ছত্র আধিপত্য মিলারদের কাছেই তুলে দেয়া হয়। ধানের এত বড় বাজার এককভাবে ব্যবসায়ী ও মিলারদের কাছে রাখা মোটেও যৌক্তিক নয়। সরবরাহ চেইনের সমস্যাগুলো দূর করার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এসব দূর হলে মধ্যস্বত্বভোগীরা অযৌক্তিক আচরণ করতে পারবে না। এজন্য সরকারের মজুদ সক্ষমতা বাড়ানো, কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার প্রচলন করতে হবে। পাশাপাশি চিকন ও মোটা দানার চালের জন্য সরকারের আলাদা ন্যূনতম সহায়তা মূল্য (এমএসপি) ঘোষণা করা প্রয়োজন। খাদ্য অধিদপ্তর যেন মোট উত্পাদনের প্রায় ১০ শতাংশ সংগ্রহ করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে সেটি খেয়াল রাখতে হবে। আবার মিলাররা তাদের মুনাফা দেখানোর ক্ষেত্রে অনেক সময় উপজাত দ্রব্য ভালো দামে বিক্রি করলেও সেটির হিসাব না দেখিয়ে বলে থাকেন তাদের মুনাফা হচ্ছে না। এর মাধ্যমে তারা সরকারের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেন। এর আগে গত মঙ্গলবার রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অবৈধ মজুদদারি রোধে করণীয় ও বাজার তদারকি-সংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ার করেছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। বাজারে পর্যাপ্ত চাল থাকা ও সরকারের কাছে মজুদ থাকা সত্ত্বেও চালের দাম বাড়ানো যৌক্তিক নয় বলে জানিয়েছেন তিনি। মিলারদের সতর্ক করে তিনি বলেন, গত বছর আম্পানে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তখন চালের দাম বাড়েনি। অথচ ভালো ফলন ও আমনের ভরা মৌসুমে দাম বাড়ছে। চালের দাম যেন না বাড়ে তা নিশ্চিত করতে আপনাদের ভূমিকা দেখতে চাই। শুধু মুনাফার উদ্দেশ্যে ব্যবসা না করে ভোক্তাদের স্বস্তি দিন। যারা ভাবছেন চাল ধরে রেখে বেশি মুনাফা করবেন তা হতে দেয়া হবে না। প্রয়োজন হলে চাল আমদানি করা হবে। আমাদের ফাইল রেডি আছে। মিল মালিকরা কী পরিমাণ ধান কিনছেন, স্টক করছেন ও ক্রাশিং করছেন তার হিসাব করছি আমরা। সে অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

To Top