Category Archives: Blog

  • চাল উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে বেশ প্রশংসা পেয়েছে। সরকারি তথ্যে দৈনিক জনপ্রতি যে ভোগ দেখানো হচ্ছে তাতে প্রতি বছর ৫০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু উদ্বৃত্ত তো থাকছেই না, উল্টো আমদানি করে ঘাটতি মেটাতে হচ্ছে। এ ঘাটতি আরো তীব্র হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) মনে করে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দৈনিক জনপ্রতি চাল ভোগের যে তথ্য দিয়েছে তাতে বাংলাদেশর জনগণের ভোগের সঠিক চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না। বিবিএসের তথ্যে জনপ্রতি চাল ভোগের যে পরিমাণ উঠে এসেছে তার সঙ্গে বেশ পার্থক্য রয়েছে ইফপ্রি ও বিআইডিএসের তথ্যের। একজন মানুষ দৈনিক কত গ্রাম চাল ভোগ করে তা নিয়ে একটি জরিপ করেছিল ইফপ্রি। সেই জরিপে তারা দেখিয়েছিল, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে দৈনিক জনপ্রতি চাল ভোগের পরিমাণ ছিল ৩৯৬ দশমিক ৬ গ্রাম, যা ২০১৬ সালেও ছিল ৪২৬ গ্রাম। অন্যদিকে ২০১৬ সালে দৈনিক জনপ্রতি চাল ভোগের পরিমাণ ৪৬০ গ্রাম ছিল বলে তথ্য দিয়েছে বিআইডিএস। যদিও একই বছরে দৈনিক জনপ্রতি চাল ভোগের হিসাব ৩৬৭ গ্রাম দেখানো হয়েছে বিবিএসের সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে। তিন সংস্থার তথ্যের তুলনা করলে দেখা যায়, জনপ্রতি চাল ভোগের পরিমাণ ইফপ্রির চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ এবং বিআইডিএসের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ কম বলে উঠে এসেছে বিবিএসের তথ্যে। চালের মজুদ নিয়ে সঠিক পরিকল্পনার জন্য জনপ্রতি ভোগের সঠিক তথ্য থাকা জরুরি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ভোগের তথ্য অনুযায়ীই চালের চাহিদা নিরূপণ ও মজুদের পরিকল্পনা করা হয়। এক্ষেত্রে সঠিক তথ্য না থাকলে এর প্রভাব গিয়ে পড়ে মজুদ  এবং সর্বোপরি বাজারের ওপর। সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলে সুন্দরভাবে লিখিত পরিকল্পনাও বাস্তবায়নে গলদ দেখা দিতে পারে বলে মনে করেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম। বণিক বার্তাকে  তিনি বলেন, জনপ্রতি চালের যে ভোগ দেখানো হচ্ছে তাতে উৎপাদনের তথ্যের সঙ্গে ন্যূনতম ৫০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু বাজারের তথ্য সেটি বলছে না। উৎপাদন কিংবা ভোগের তথ্যেও গরমিল রয়েছে। বাজার তথ্যের সঙ্গে আমাদের প্রকাশিত সব তথ্যের মিল থাকা প্রয়োজন। তা না হলে নীতি প্রণয়নে, বিশেষ করে চাল আমদানি কিংবা রফতানির বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া মুশকিল হয়ে পড়বে। চাল উৎপাদন ও ভোগের তথ্যের ক্ষেত্রে কোনো বিষয়ে পর্যালোচনার প্রয়োজন মনে করলে সেটি বিবেচনায় নিতে হবে। তা না হলে চাল আমদানির বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে না। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে  দেশে দৈনিক জনপ্রতি চাল ভোগের পরিমাণ ছিল ৪১৬ গ্রাম এবং সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ২০১৬ সালে তা ছিল ৩৬৭ দশমিক ২ গ্রাম। এ সময় জনপ্রতি ভোগের পরিমাণ গ্রামে প্রায় ৩৮৬ গ্রাম ও শহরে প্রায় ৩১৭ গ্রাম ছিল। অন্যদিকে ইফপ্রির জরিপের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ২০১৮ সালে দৈনিক জনপ্রতি চাল ভোগের পরিমাণ ৩৯৬ দশমিক ৬ গ্রামে নেমে এসেছে।  যদিও তা ২০১২ সালে প্রায় ৪৬৭ গ্রাম এবং ২০১৬ সালে ছিল প্রায় ৪২৬ গ্রাম। শহর ও গ্রামে জনপ্রতি চাল ভোগের পরিমাণে কম-বেশি পার্থক্য রয়েছে বলে জানিয়েছে ইফপ্রি। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে  গ্রামের মানুষ জনপ্রতি দৈনিক ৪১৭ গ্রাম করে চাল ভোগ করেছে, অন্যদিকে শহরের মানুষ ভোগ করেছে জনপ্রতি ৩৪২ গ্রাম। এ জরিপে ইফপ্রি একজন মানুষ নিজ বাড়িতে ও বাড়ির বাইরে যে খাবার গ্রহণ করে সে তথ্যও বিবেচনায় নিয়েছে। যেমন গ্রামের একজন মানুষ বাড়ির বাইরে দৈনিক গড়ে ১৫ গ্রাম খাবার গ্রহণ করছে, আর নিজ বাড়িতে গ্রহণ করছে ৪০২ গ্রাম। ইফপ্রি বলছে, আগামীতে জনপ্রতি চাল ভোগের পরিমাণ আরো কমে আসবে। সঠিক ভোগের তথ্য বিবেচনায় নিলে আমদানির বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে। সঠিক ও নিরাপদ পরিকল্পনার জন্য জনপ্রতি ভোগ ৪৮৯ গ্রামকে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। বাংলাদেশে ইফপ্রির কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. আখতার আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, পদ্ধতিগত কারণে ভোগের তথ্যের পার্থক্য হতে পারে। জনপ্রতি ভোগের তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ‘সাপ্তাহিক’ ও ‘২৪ ঘণ্টার’—এ দুটো জনপ্রিয় পদ্ধতি বিবেচনায় নেয়া হয়। আমরা ভোগের সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য একজন ভোক্তার ২৪ ঘণ্টার খাবারের তথ্য হিসাব করি। সে কখন কী পরিমাণে কী কী ধরনের খাবার গ্রহণ করছে সেটি লিপিবদ্ধ করি। এ পদ্ধতিটা বেশ ব্যয়বহুল হলেও সঠিক পরিমাণটা পাওয়া যায়। কিন্তু অন্য পদ্ধতিতে পরিমাণ কম-বেশি (ওভার কিংবা আন্ডারএস্টিমেট) হওয়ার ঝুঁকি থাকে। জনপ্রতি ভোগের বাইরে চালের আরো বেশকিছু ভোগ রয়েছে। বিশেষ করে প্রাণী খাদ্য হিসেবে চালের কয়েক লাখ টন ভোগ করা হয়। এছাড়া ধান-চাল উৎপাদনের তথ্যটি সাধারণত মাঠ পর্যায়ের হিসাব করা হয়। মাঠের ধান থেকে ভোক্তা পর্যায়ে চাল হয়ে আসতে নানা মাত্রায় পোস্ট ও প্রি-হারভেস্ট লস হয়। সেই ক্ষতির পরিমাণ ৮-১০ শতাংশ পর্যন্ত হয়। এজন্য উৎপাদন ও ভোগ সব ক্ষেত্রেই সঠিক তথ্য থাকাটা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, চাল অত্যন্ত সংবেদনশীল কৃষিপণ্য। এ কারণে এটির ভোগ ও উৎপাদনের সঠিক তথ্য থাকা প্রয়োজন। পাশাপাশি জনসংখ্যার তথ্যটিও সঠিকভাবে আসা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা দেখছি, এ তিনটি তথ্যের ক্ষেত্রে বেশ ঘাটতি রয়েছে। চালের জনপ্রতি ভোগ ও জনসংখ্যার তথ্য বিবেচনায় নিলে চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু উদ্বৃত্ত থাকছে না, উল্টো মাঝে মধ্যে বেসরকারিভাবে চাল আমদানি হচ্ছে। আমরা চাল উৎপাদনে বৈশ্বিকভাবে শীর্ষ তিনে অবস্থান করছি এবং সরকারিভাবে চাল আমদানি গত কয়েক বছর বন্ধই রয়েছে। তার পরও ভোগের তথ্যের সঙ্গে উৎপাদনের তথ্যের এ গরমিল কমানোর জন্য পর্যালোচনার দাবি রাখে। হিসাব করার ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়াতে হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ফুড প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিটকে (এফপিএমইউ) আরো শক্তিশালী করতে হবে। না হলে কার্যকর মনিটরিং ছাড়াও সঠিক তথ্য ও নীতি গ্রহণ করা দুষ্কর হয়ে পড়বে।

  • ছোট ছোট আইলে খণ্ডিত জমি। জমির আয়তন এতই ছোট যে সেখানে ট্রাক্টর ও কম্বাইন হারভেস্টরের মতো বড় কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের জো নেই। পদে পদে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয় সেচে, হয় না...

  • সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার আমলাপাড়ায় যমুনাপারের বাসিন্দা মর্জিনা বেগম। একসময় নদীর ওপারে বসতভিটা ও কিছু আবাদি জমি ছিল তাদের। কিন্তু নদীভাঙনে সব হারিয়েছেন। সেই থেকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছেন এ...

  • যমুনা নদীকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক করিডোর ও নৌপথের বাণিজ্য সম্ভাবনা, বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং নাব্যতা সংকটের প্রভাব নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্ব ব্রিটিশ আমলে দেশের অন্যতম ব্যস্ত নৌবন্দর ছিল সিরাজগঞ্জে। যমুনা নদীর সেই বন্দরকে ঘিরেই ছোট সিরাজগঞ্জ শহরে তৈরি করা হয়েছিল চারটি রেল স্টেশন। পাটপণ্য পরিবহনসহ আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যে ব্যবহার হতো এ বন্দর। কালের বিবর্তনে সিরাজগঞ্জের সেই নৌপথ ও বন্দর কোনোটিই নেই। রেল স্টেশন চারটিও বন্ধ। শুধু সিরাজগঞ্জের এ বন্দর নয়, ৫৫ বছর আগেও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মধ্যে নৌযান চলাচলে গুরুত্বপূর্ণ পথ হিসেবে ব্যবহার করা হতো যমুনা নদীকে। কুড়িগ্রামের চিলমারী হয়ে বাহাদুরাবাদ, সিরাজগঞ্জ থেকে দুদিকে চলে যেত নৌযান। একটি নৌপথ ছিল গড়াই নদী হয়ে কলকাতা, অন্যটি চলে যায় চাঁদপুর ও বরিশাল হয়ে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে ১৯৬৫ সালে বন্ধ হয়ে যায় নৌপথটি। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় বিভিন্ন ধরনের কৃষি উপকরণ, জ্বালানি তেল, পণ্য ও দানাদার খাদ্যশস্য পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে যমুনার নৌপথ। পণ্য পরিবহনে বিশাল সম্ভাবনা থাকলেও নাব্যতা সংকটে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে জাহাজ ভিড়তে প্রায়ই অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পণ্যবাহী জাহাজ চলার জন্য স্বাভাবিক সময়ে নৌপথে ১০-১৫ ফুট পানির গভীরতা প্রয়োজন। কিন্তু পাবনার বেড়া উপজেলার প্যাঁচাকোলা থেকে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার অংশের চ্যানেলটিতে পানির গভীরতা নেমে এসেছে ৬-৭ ফুটে। ফলে বাঘাবাড়ী বন্দরে সরাসরি আসতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে জাহাজ। এতে উত্তরাঞ্চলের পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কার্যকর পরিকল্পনার অভাবে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের সম্ভাবনাও কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ বিষয়ে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, সারা বিশ্বেই নদীকে ঘিরে অর্থনীতি ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় যমুনাকে ঘিরেই এ অঞ্চলে বড় বড় জাহাজ এবং নৌ-পরিবহনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। আমরা ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য যমুনাকে ঘিরে দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা গ্রহণ করে সে অনুসারে কাজ করছি। এ অঞ্চলের মানুষের প্রাণ যেন যমুনা নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠে, সে ব্যবস্থা করতে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা বাস্তবায়নে ভবিষ্যতে যমুনা নৌপথে বড় বড় জাহাজ চলবে। যমুনা সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ী নৌবন্দর ব্যবহার করেই অর্ধকোটি টনের বেশি সার, জ্বালানি তেল, সিমেন্ট, কয়লাসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে পাঠানো হয়। নৌপথটি ব্যবহার করে কুড়িগ্রাম পর্যন্ত পণ্য পরিবহনের সুযোগ রয়েছে। যদিও নাব্যতা সংকটসহ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে নেমে এসেছে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের মান। তার পরও বন্দরটি ঘিরে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিলে নৌপথটি ভারত ও নেপালের সঙ্গে বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নৌপথে পণ্য পরিবহন খরচ সড়ক পরিবহনের চেয়ে প্রায় অর্ধেক। আবার নৌপথে পণ্য পরিবহন করলে পরিবেশের ক্ষতি যেমন কম হয়, তেমনি পণ্যের গুণগত মানও ধরে রাখা যায়। এসব বিবেচনায় নিয়ে যমুনাকেন্দ্রিক এ নৌপথের উন্নয়ন ঘটালে নদীর দুই পাড়ে শিল্প গড়ে উঠবে, যা দেশে অর্থনীতির গতিকে বেগবান করবে। সিরাজগঞ্জের সচেতন নাগরিক ও স্থানীয় যমুনা প্রবাহ পত্রিকার সম্পাদক মোস্তাফা কামাল তারা বণিক বার্তাকে বলেন, যমুনা নদীর সঠিক ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে পারলে এ অঞ্চলে বাণিজ্যের মহাজাগরণ সম্ভব। অবহেলায় আমরা শত বছরের ঐতিহ্য নষ্ট করে ফেলেছি। যমুনার পানি এত দ্রুত কমে যাচ্ছে যে ভারী নৌযান চলাচল করতে পারে না। অথচ ভারী নৌযান চলাচলের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকলেও সেই সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। ভারতের আসাম থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে। ওই নদ যমুনা নাম ধারণ করে গোয়ালন্দের কাছে পদ্মা নদীতে মিশেছে। এ অংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। যদিও যমুনা নদীর শাখা ও উপনদীর দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার। প্রতি বছর যমুনা নদীতে ১২০ কোটি টন পলি ও বালি পড়ছে। এসব পলি পানিপ্রবাহের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু পানিপ্রবাহের গতি কম থাকায় নদীর বিভিন্ন স্থানে চর জেগে উঠছে। জমা এসব পলি ও বালি ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সরানো হচ্ছে না। দেখা দিচ্ছে নাব্যতা সংকট। ফলে বাণিজ্য সম্ভাবনা ক্ষয়ে যাচ্ছে। নৌপথে পণ্য পরিবহন খরচ সড়ক পরিবহনের চেয়ে প্রায় অর্ধেক। এ বিষয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় নতুন নৌপথ তৈরি করতে পারছি না, আবার পরীক্ষিত নৌপথগুলোকে রক্ষায় চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি। পদ্মাকে ঘিরে আরিচা থেকে ভারত পর্যন্ত শিল্পায়নের সুযোগ আমরা যেমন কাজে লাগাতে পারছি না। আবার শত শত বছরের গড়ে ওঠা একটি সম্ভাবনাময় অঞ্চলকে মৃতপ্রায় করে ফেলেছি। যমুনা নদীকে ঘিরে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত নৌপথটি অবহেলার মাধ্যমে নিঃশেষ করে দিয়েছি। যমুনা নদীকে বৈজ্ঞানিক ও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবস্থাপনা করতে না পারার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানিপ্রবাহ, ক্ষয়ে যাচ্ছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। সামগ্রিক বিবেচনায় নদীকে ড্রেজিং যেমন করা হচ্ছে না, তেমনি নদীভাঙন ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অবহেলা রয়েছে। অথচ যমুনা নদীকে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নৌপথ চালু করার পাশাপাশি দুই পাড়ে শিল্প-কারখানা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কাজে লাগানো যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, নদীভাঙন চলতে থাকলে শিল্পায়ন করা সম্ভব নয়। আবার পাইলট আকারে কোনো প্রকল্পও টেকসই হবে না। তাই দীর্ঘমেয়াদে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতে হবে।

  • যমুনা নদীকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক করিডোর ও নৌপথের বাণিজ্য সম্ভাবনা, বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং নাব্যতা সংকটের প্রভাব নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিকের শেষ পর্ব যমুনাকে ঘিরে অর্থনৈতিক চাঞ্চল্য সৃজনের কথা রয়েছে শত বছরের...

  • অর্থ সংকট মেটাতে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বড় অংকের ঋণ নেয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) অধীন চিনিকলগুলো। শুধু আখচাষীদের ঋণ দেয়ার উদ্দেশ্যেই বিভিন্ন সময়ে...

  • কয়েক বছর আগেও প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে আমদানীকৃত গরু দিয়েই মিটত দেশের মাংসের চাহিদা। প্রতি বছর কোরবানির সময় দেশ দুটি থেকে আমদানি হতো ২২-২৫ লাখ গবাদিপশু। কিন্তু...

  • মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ৫ শতাংশ হলে সে মাটিকে সবচেয়ে ভালো বলা হয়। ন্যূনতম ২ শতাংশ থাকলে সেটিকে ধরা হয় মোটামুটি মানের। কিন্তু দেশের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ এখন গড়ে ২ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। এছাড়া জৈব পদার্থের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে, যা দেশের মোট জমির প্রায় ৭৯ শতাংশ। মাটির উর্বরতা শক্তি ও জৈব পদার্থের উপস্থিতি নিয়ে একটি গবেষণা চালিয়েছে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই)। ‘ল্যান্ড ডিগ্রেডেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ সমীক্ষায় মাটির উর্বরতা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে মাটিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি ও নানা পুষ্টিকণা কমে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। পাশাপাশি ভূমিক্ষয়, অম্লমাটির পরিমাণ, উপকূলের লবণাক্ত এলাকা ও খরাপ্রবণ এলাকায় কী পরিমাণ মাটি রয়েছে—তারও পূর্ণাঙ্গ তথ্য উঠে এসেছে প্রতিষ্ঠানটির সমীক্ষায়। এতে দেখা যায়, দেশে সব ধরনের বিশেষ করে আবাদি, বনভূমি, নদী, লেক, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, সুন্দরবন ইত্যাদি এলাকা মিলিয়ে জমির পরিমাণ ১ কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে ফসফরাস ঘাটতিযুক্ত এলাকার পরিমাণ ৬৬ লাখ হেক্টর, যা মোট জমির প্রায় ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে পটাশিয়ামের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৫২ লাখ ৭০ হাজার বা ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশে। সালফারের ঘাটতি রয়েছে ৬৫ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর বা ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ এলাকায়। এর বাইরে বোরনের ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৫১ লাখ ১০ হাজার হেক্টরে (মোট জমির ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ)। জৈব পদার্থের ঘাটতি রয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর বা মোট জমির প্রায় ৭৮ দশমিক ৯০ শতাংশে। এসআরডিআইয়ের তথ্যমতে, পদ্মা অববাহিকা ও হাওড়াঞ্চলের কৃষিজমিতে স্বাভাবিকের তুলনায় দস্তার পরিমাণ কম। এর মধ্যে পদ্মা নদীর অববাহিকার মাটিগুলোয় চুন ও ক্ষারের (পিএইচ) মাত্রা অনেক বেশি। অন্যদিকে হাওড়াঞ্চলের জেলাগুলোয় আবাদি এলাকা নিচু এলাকা হওয়ার কারণে কৃষিজমিগুলো অধিকাংশ সময় জলমগ্ন থাকে। এজন্য সেখানে দেখা দেয় দস্তার অভাব। সব মিলিয়ে দেশে এখন দস্তার ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৫৫ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে, যা মোট জমির প্রায় ৩৮ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রমাগত ফসল ফলানোর কারণে দেশের মাটিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণে জৈব পদার্থ নেই। মাটিকে যথাযথভাবে ব্যবহার না করায় উর্বরতা শক্তি নষ্ট হচ্ছে। অপরিকল্পিত চাষাবাদ, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার, ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ, শিল্পায়ন, দূষণ, ব্যাপক হারে বনভূমি ধ্বংস এবং অপরিকল্পিতভাবে সারের ব্যবহারের কারণে মাটির উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ইটভাটার জন্য মাটির উপরিভাগের অংশ তুলে নেয়া ছাড়াও মাটির টেকসই ব্যবস্থাপনার অভাবে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতির ফলে মৃত্তিকা এখন হুমকির মুখে রয়েছে। এসব কারণে মাটির স্বাস্থ্যহীনতায় এখন প্রতি বছর ফসল উৎপাদনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও এগ্রেরিয়ান রিসার্চ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. আবদুল হামিদ বলেন, জমির উর্বরতা শক্তি সংরক্ষণে অবহেলা খাদ্যনিরাপত্তায় বড় হুমকি হতে পারে। টেকসই উন্নয়নের স্বার্থেই প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ জরুরি। মনে রাখতে হবে শুধু টেকসই কৃষি উৎপাদনই নয়, সমগ্র জীবমণ্ডলের অস্তিত্বও এখন মাটির স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভরশীল। এটা ঠিক, একই জমি বারবার ব্যবহারে মাটি উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে। এ ব্যাপারে পতিত রেখে জমির উর্বরতা শক্তি পুনরুদ্ধারে পরামর্শ দেয়া যেতে পারে ঠিকই। কিন্তু কোনো কৃষক জমি পতিত রাখার ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। ক্ষুদ্র কৃষকের খাদ্য ও আর্থিক প্রয়োজনের কারণেই তাকে উপর্যুপরি ফসল ফলাতে হচ্ছে। সমভূমিতে হোক বা পার্বত্যাঞ্চল—একই জমি বারবার চাষ করে কৃষি ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করার ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য কৃষক ও সরকারি পর্যায়ে অনুকূল নীতিকৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন। কৃষকরা সংঘবদ্ধ না হলে কার্যকরভাবে নীতিকৌশল বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন দরকার। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের ১ কোটি ১৬ লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে জৈব পদার্থের ঘাটতি রয়েছে। তার মধ্যে খুব খারাপ (ভেরি সিভিয়ার) অবস্থায় রয়েছে দেশের ১১ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর জমি। খারাপ (সিভিয়ার) অবস্থায় আছে ২৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর, মাঝারি (মডারেট) ধরনের খারাপ অবস্থায় আছে ৩৫ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর ও হালকা (লাইট) খারাপ অবস্থায় আছে ৩৩ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর জমি। অন্যদিকে দেশে অম্লযুক্ত মৃত্তিকার উপস্থিতি রয়েছে প্রায় ৮৩ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর বা মোট জমির প্রায় ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশে। পাহাড়ে ভূমিক্ষয় প্রাপ্ত এলাকা রয়েছে ১৭ লাখ হেক্টর। উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকার পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ ২০ হাজার হেক্টর। খরাপ্রবণ এলাকার পরিমাণ প্রায় ১৪ দশমিক ৩০ লাখ হেক্টর। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার বণিক বার্তাকে বলেন, অধিকাংশ কৃষকই প্রধান প্রধান ফসলের জন্য নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম সার ব্যবহার করেন। প্রশিক্ষণ ও জানাশোনার অভাবে সুষম সার ব্যবহার করেন খুব কমসংখ্যক কৃষক। অপরিমিত ও মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহারে ফলনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় এবং জমিতে ব্যবহূত সারের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে একসময়ে জমিগুলো অনুৎপাদনশীল হয়ে পড়বে এবং কৃষিতে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে। এজন্য রাসায়নিক ও জৈব সারের মিশ্র প্রয়োগের মাধ্যমে জমি থেকে ফসলের আহরিত খনিজ ও জৈব পদার্থের মাত্রা যদি ঠিকঠাক ধরে রাখা যায়, তাহলে মাটির উর্বরতা শক্তি ধরে রাখা সম্ভব। ঘাটতি কমানোর পাশাপাশি উর্বরতা শক্তি ধরে রাখতে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি জমি চাষে রোটেশন পদ্ধতি অনুসরণ ও কৃষি উপকরণ ব্যবহারে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবনধারণের জন্য উদ্ভিদ মাটি থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য হিসেবে খনিজ পদার্থ ও পানি সংগ্রহ করে। এজন্য ১৬টি পুষ্টি মৌল অপরিহার্য। এর কোনো একটির অভাব হলে ফসল তথা উদ্ভিদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে ও ফসলহানি ঘটে। ফসলের খাদ্য চাহিদা নিরূপণ করে জমির উর্বরতা বিচারে প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত খাদ্য মৌল সার হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। তবে উদ্ভিদের সব খাদ্য মৌল সরবরাহের জন্য সার ব্যবহার হয় না। এ কারণে ক্রমাগত ফসল ফলানোর কারণে মাটিতে অনেক খাদ্য মৌলের ঘাটতি সৃষ্টি হয়। এজন্য লবণাক্ত ও পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন, মাটির উর্বরতা মানের ভিত্তিতে সুষম সার প্রয়োগের ওপর অ্যাডাপ্টিভ ট্রায়াল চালানো, উপজেলা ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদ ব্যবহার নির্দেশিকা (উপজেলা নির্দেশিকা) নবায়ন, ইউনিয়নভিত্তিক ভূমি, মাটি ও সার সুপারিশ সহায়িকা প্রণয়ন এবং কৃষকদের চাহিদামাফিক ফসল বিন্যাসের জন্য উপজেলাভিত্তিক সার ব্যবহার নির্দেশিকা প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে এসআরডিআইয়ের মহাপরিচালক বিধান কুমার ভান্ডার বলেন, ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার ও মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সুষম সার ব্যবস্থাপনায় জোর দেয়া হচ্ছে। ভূমি জরিপের মাধ্যমে বিভিন্ন কলাকৌশল উদ্ভাবন করে দেশের অনাবাদি জমি চাষাবাদের আওতায় আনা হচ্ছে। মাটি পরীক্ষা ছাড়াও সারের গুণগত মান নিশ্চিত করতে বিভাগীয় গবেষণাগারের মাধ্যমে সার পরীক্ষা করা হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ মৃত্তিকা পরীক্ষাগারের মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে তাত্ক্ষণিক বিভিন্ন ফসলের জন্য সুষম সার সুপারিশ করা হচ্ছে। উপজেলা ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদ ব্যবহার নির্দেশিকা ব্যবহার করে বছরে কৃষককে সুষম সার সুপারিশ প্রদান করা হয়। এদিকে গতকাল ‘বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস’ পালন উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনার, শোকেসিং ও সয়েল কেয়ার অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি দেয়া প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে গিয়ে শস্যের নিবিড়তা বাড়ছে, কিন্তু মাটির উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। টেকসই মাটি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাটির উৎপাদনশীলতা, মাটিতে গাছের অপরিহার্য পুষ্টি উপাদানের মান বজায় রাখতে হবে। কারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ও খাদ্যনিরাপত্তা নির্ভর করে টেকসই মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার ওপর। সেজন্য মাটিকে সজীব রাখতে হবে, মাটির গুণাগুণ বজায় রাখতে হবে।

  • সেচকাজে যান্ত্রিকীকরণের শুরুটা দেশ ভাগের পর পরই। পাম্পের সাহায্যে হাওড়-বাঁওড়, খাল-বিল কিংবা নদীর পানি ফসলি জমিতে ব্যবহার তখন থেকেই শুরু করেন এ অঞ্চলের কৃষক। স্বাধীনতার পর নলকূপ আর গভীর নলকূপে আরো গতি পায় বাংলাদেশের সেচ কার্যক্রম। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছরে পা রাখতে চললেও দেশের বিপুলসংখ্যক সেচযোগ্য জমি রয়ে গেছে সেচ সুবিধার বাইরে। বছর বছর মোটা অংকের বিনিয়োগ করেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সেচের পরিধি বাড়াতে পারছে না সরকার। এতে ছেদ পড়ছে উৎপাদনশীলতায়। নিম্নগামী প্রবৃদ্ধি হচ্ছে শস্য খাতে। বাংলাদেশে আবাদের জন্য সেচযোগ্য জমি আছে ৭৭ দশমিক ৬ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে সর্বশেষ অর্থবছর পর্যন্ত সেচের আওতায় এসেছে ৫৬ লাখ হেক্টর। ২৭ শতাংশ বা প্রায় ২১ লাখ হেক্টর জমি এখনো রয়ে গেছে সেচ সুবিধার বাইরে। সেচের পানির দক্ষ ব্যবহারও করতে পারছেন না বাংলাদেশের কৃষক। সেচকাজে ব্যবহার হওয়া ৬০ শতাংশ পানিই অপচয় হচ্ছে। ফলে বিপুল পরিমাণ জমি সেচ সুবিধার বাইরে থাকার পাশাপাশি সেচকাজে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে। প্রতি বছর খাতটিতে মোটা অংকের অর্থ বিনিয়োগ করছে সরকার। তবে এর খুব একটা প্রভাব পড়ছে না মাঠ পর্যায়ে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর ৩১৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছর ২৮৩ কোটি ৩৬ লাখ, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ২১৫ কোটি ৫৪ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৪৩৯ কোটি ৩০ লাখ ও ২০১৯-২০ অর্থবছর ৪৮৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা—সব মিলিয়ে গত পাঁচ বছরে সেচ সম্প্রসারণে সরকারি বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকার বেশি। এর বিপরীতে সেচ সুবিধার আওতায় এসেছে মোটে এক লাখ হেক্টর জমি। ৫৪ লাখ ৯০ হাজার হেক্টর থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৫ লাখ ৯৮ হাজার হেক্টর। এসব জমি আবাদে ব্যবহূত হয়েছে ১৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪১৩টি সেচযন্ত্র। শ্যালো টিউবওয়েল ছিল ১৩ লাখ ৫৭ হাজার ৫৩২টি, শ্যালোর বাইরে সেচে ব্যবহার হচ্ছে প্রায় ৩৭ হাজার ৬৩৪টি গভীর নলকূপ ও ১ লাখ ৮৭ হাজার ১৮৮টি লো লিফট পাম্প। বিনিয়োগের বিপরীতে বাড়ছে না সেচ সুবিধায় আসা জমি। এর প্রভাব পড়ছে শস্য উৎপাদনে। কয়েক বছর ধরেই শস্য খাতে দেখা দিয়েছে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত প্রবণ এলাকা, চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমের চরাঞ্চলে সেচ সুবিধা এখনো পর্যাপ্ত সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়নি। বেশকিছু বিভাগে ব্যাপক হারে আবাদি জমি সেচের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। কিছু এলাকায় পানির স্তর নেমে যাওয়ায় গভীর নলকূপ ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। দেশের সেচ কার্যক্রমে এ গতিহীন ভাব বজায় থাকলে সামনের দিনে কৃষির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, কী কারণে এসব অঞ্চলে সেচ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না, সেটি নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। আবার সেচ সম্প্রসারণ করলে পরিবেশগত ও আর্থিকভাবে কতটুকু লাভবান হওয়া সম্ভব, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে। তবে সেচযোগ্য জমিতে যদি সেচ সুবিধা পৌঁছানো সম্ভব না হয়, তাহলে সেটি কৃষির জন্য বড় ক্ষতি হবে। এর মাধ্যমে আমরা শস্য বা কৃষি খাতের উৎপাদন যেমন হারাচ্ছি, তেমনি কৃষকের আর্থিক সুবিধা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। হয়তো এর মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের একটি বড় অংশকে আর্থিক সুবিধা দেয়া সম্ভব হবে। তাই সেচ সুবিধা সম্প্রসারণে একটি বড় ধরনের ধাক্কা প্রয়োজন। প্রয়োজনে আগের পদ্ধতি থেকে বের হয়ে এসে ভর্তুকি সুবিধা আরো বাড়াতে হবে। দেশের সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারণে এককভাবে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। ১৯৬৭-৬৮ সালে বিএডিসি গভীর নলকূপ স্থাপন করে সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার শুরু করে এবং ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে অগভীর নলকূপ স্থাপন শুরু করে। ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের হাইড্রোলিক স্ট্রাকচার নির্মাণের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি ও ভূ-উপরিভাগের পানির সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ানো প্রকল্প হাতে নিয়েছে। রাবার ড্যাম (চলমান), হাইড্রোলিক এলিভেটর ড্যাম (চলমান), সৌর শক্তিচালিত সেচপাম্প স্থাপন, সেচযন্ত্রে স্মার্ট বেজড প্রিপেইড মিটার স্থাপন ও ডাগওয়েলসহ টেকসই সেচ অবকাঠামো নির্মাণ করছে। আধুনিক ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ড্রিপ ইরিগেশন ও স্প্রিঙ্কলার ইরিগেশনের মতো লাগসই প্রযুক্তি ও ভ্রাম্যমাণ সেচপাম্প চালু করতে কার্যক্রম চালু করেছে। বিএডিসির সেচ কার্যক্রমের সার্বিক অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার পাশাপাশি উন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দ বিষয়ে কৃষি সচিব মো. মেসবাহুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বিএডিসির সঙ্গে আলাপের পরামর্শ দেন তিনি। পরে বিএডিসির ক্ষুদ্রসেচ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. জিয়াউল হক বণিক বার্তাকে বলেন, কয়েক বছর ধরে সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারণের পাশাপাশি সেচ ব্যবস্থাপনায় জোর দেয়া হয়েছে। ফলে সেচের আওতা এখন আর জ্যামিতিক হারে নয়, গাণিতিক হারে বাড়ছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর ভারসাম্য রক্ষা করেই একটি টেকসই সেচ ব্যবস্থাপনায় জোর দেয়া হচ্ছে। আবার কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলে সেচের কার্যক্রম কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। এসব অঞ্চলে ঢালাওভাবে কার্যক্রম নিয়ে সেচের আওতা বাড়ানো সম্ভব হবে না। অঞ্চলগুলোর প্রয়োজন বিবেচনায় নিয়েই সেচের কার্যক্রম সম্প্রসারণে আলাদা কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। চরাঞ্চলের ভাসমান সেচযন্ত্র দিয়ে নতুনভাবে জমিকে সেচের আওতায় আনা হচ্ছে। ডাগওয়েল বা ফিতা পাইপের মাধ্যমে দূরের জমিগুলোতে পানি নেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সেচের পানির অপচয় কমানো ও ভূ-উপরিস্থ পানির প্রাপ্যতা, সংরক্ষণ ও নিষ্কাশনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বেশি পরিমাণে খাল-নালা খনন ও পুনঃখনন করা হচ্ছে। ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহার করে সেচকৃত জমির পরিমাণ ৬০ লাখ হেক্টরে উন্নীত করতে মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।

  • চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে শুল্কহার কমিয়ে বেসরকারিভাবে চাল আমদানি উন্মুক্ত করেছে সরকার। তবে আমদানি হবে নিয়ন্ত্রিতভাবে। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার গতকাল এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, চালের বাজার স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। ২৪ ডিসেম্ব্বর বেসরকারিভাবে চালের আমদানি শুল্ক কমাতে প্রধানমন্ত্রী অনুমতি দিয়েছেন। সে আলোকে বেসরকারিভাবে চাল আমদানি শুল্ক আগের ৬২ দশমিক ৫০ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। বৈধ আমদানিকারকরা বেসরকারিভাবে চাল আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ২০২১ সালের ১০ জানুয়ারির মধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করবেন। পরবর্তী সময়ে একটা নীতিমালার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে খাদ্য মন্ত্রণালয় তাদের চাল আমদানির অনুমতি দেবে। নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হবে। সরকার নির্ধারিত দামে মিলাররা চাল দেবে না বলে যে ঘোষণা দিয়েছে, সেটিকে মন্ত্রণালয় কীভাবে দেখেছেন—সংবাদ সম্মেলনে এমন প্রশ্নের জবাবে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, সরকার কারো কাছে মাথা নত করে না। তারা এ ধরনের হুমকি নিয়ে থাকুক। আমরা পীড়াপীড়ি করিনি। তবে চুক্তি করে চাল না দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। মজুদ সক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনে কৃষকের কাছ থেকে ১৫-২০ লাখ টন ধান সরাসরি ক্রয় করা হবে। এজন্য ধান বিক্রিও উন্মুক্ত করা হয়েছে। যেকোনো কৃষক ১ হাজার ৪০ টাকা দরে ধান বিক্রি করতে পারবেন। যদিও বাজারে একটু বেশি দাম পাচ্ছেন বিধায় কৃষকরা এ মুহূর্তে আগ্রহী হচ্ছেন না। আর সরকারিভাবে এরই মধ্যে চার লাখ টন চাল আমদানির টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া ভারতের সঙ্গে জিটুজি ভিত্তিতে দেড় লাখ টন চাল আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে চাল আমদানির মাধ্যমে মজুদ বাড়ানো সম্ভব হবে। চাল আমদানির অনুমতির ক্ষেত্রে উৎপাদন পরিস্থিতি কতটুকু বিবেচনায় নেয়া হয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, দেশের চালের বাজারে দাম স্থিতিশীল থাকলেও তা এখনো বেশ উঁচুতে রয়েছে। বাজারে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি আরো বাড়ানো হবে। সরকারিভাবে চাল আমদানি করে মজুদ বাড়ানোর পাশাপাশি বাজারে সরবরাহও বাড়ানো হবে। এছাড়া দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমনের উৎপাদন কম হতে পারে। তবে সেটি কোনোভাবেই ঘাটতিতে নেই। আবাদি জমির পরিমাণ ঠিক রয়েছে। হেক্টরপ্রতি ফলন কমার কারণে উৎপাদন কিছুটা কমতে পারে। তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশে এমন কোনো মানদণ্ড নেই যেটির মাধ্যমে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই সন্তুষ্ট থাকবেন। চালের দাম বাড়লে কিংবা ধানের দাম কমে গেলে হাহাকার শুনতে হয়। কিন্তু এ দুটি পণ্যের দাম কতটা হলে স্বাভাবিক বা ন্যায্য এমন কোনো মানদণ্ড নেই। সে বিষয়েও কাজ করা হচ্ছে। এজন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। তারা চাল ও ধানের সহনীয় দাম নিয়ে নীতিমালা তৈরি করবে। খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সারোয়ার মাহমুদ ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক আজিজ মোল্লাসহ খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, চলতি বছরের ১৩ জুলাই প্রধানমন্ত্রী চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছিলেন। সে ধারাবাহিকতায় সরকারিভাবে চাল আমদানি শুরু হয়। কিন্তু কৃষকের ধানের দাম নিশ্চিত করতে বেসরকারিভাবে একটু দেরিতে অনুমোদন দেয়া হলো। তবে সেটিও ঢালাওভাবে নয়। চাল আমদানিকারকদের আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই করে কাকে কতটুকু চাল আমদানির অনুমোদন দেয়া যায় সে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। শুধু বৈধ ও অভিজ্ঞ আমদানিকারকদের চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া কেউ কোনো ধরনের চাল আমদানি করতে পারবে না।

To Top