Category Archives: Blog

  • দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে প্রায় ২৪ লাখ টন। পণ্যটির উৎপাদন মূলত একটি মৌসুমভিত্তিক হওয়ায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পেঁয়াজে পুরো চাহিদা মেটে না। প্রতি বছর ৮-১০ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। আর এতেই প্রায় প্রতি বছর অস্থিতিশীলতা দেখা দেয় কৃষিপণ্যটির দামে। মূলত আমদানির উৎস দেশগুলোয় মূল্যবৃদ্ধি বা শুল্কারোপের ফলে দেশে বছরের শেষ তিন মাসে মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পায় পেঁয়াজের দাম। গত এক দশকের ব্যবধানে পণ্যটির দামের ওঠানামা করেছে প্রায় ১৯ শতাংশ হারে। আর ২০১৮ সালেই স্থানভেদে পণ্যটির দামের পার্থক্য ছিল প্রায় ৭০ শতাংশ। প্রতি বছরই দামের অস্থিতিশীলতা দেখা দেয় এমন আরেকটি কৃষিপণ্য হলো মরিচ। বিশেষ করে বন্যার সময় মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায় মরিচের দাম। এক দশকের ব্যবধানে এ পণ্যটির দামের ওঠানামা হয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। ২০১৮ সালেই স্থানভেদে মরিচের দামে পার্থক্য ছিল ৬০ শতাংশ। দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলমান বন্যার প্রভাবে বর্তমান বাজারেও অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে মরিচের দামে। স্বাভাবিক সময়ে পণ্যটির দাম ১০০ টাকার নিচে থাকলেও বন্যায় সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেয়ায় এখন  মরিচের দাম প্রতি কেজি ৩০০ টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু মরিচ বা পেঁয়াজ নয়, কৃষিজ পণ্যের দামের ওঠানামার তালিকায় রয়েছে আলু, কলা, আম ও ডালজাতীয় পণ্যও। সম্প্রতি ১১টি কৃষিপণ্যের দামের অস্থিতিশীলতা নিয়ে একটি গবেষণা চালিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সেখানে ২০০৮-১৮ সময়ে এসব পণ্যের দামের পার্থক্য কেমন ছিল এবং ২০১৮ সালে এসব পণ্যের স্থানভেদে দামের পার্থক্য ও ওঠানামা কেমন ছিল তা দেখানো হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, ২০১৮ সালে স্থানভেদে ৫২ শতাংশ ওঠানামা করেছে আলুর দাম। ২০০৮ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে পণ্যটির দামের ওঠানামার হার ছিল প্রায় ১৭ শতাংশ। অন্যদিকে গত ১০ বছরের ব্যবধানে কলার দাম ওঠানামা করেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। স্থানভেদে পণ্যটির দামের ওঠানামার হার ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। এছাড়া তেলজাতীয় শস্যের দামে ওঠানামার হার গত ১০ বছরে ১২ শতাংশের মধ্যেই ছিল। ২০১৮ সালে স্থানভেদে পণ্যটির দামের পার্থক্য ছিল ১৩ শতাংশ। গত ১০ বছরে ডালজাতীয় শস্যের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ ওঠানামা করেছে। ২০১৮ সালে স্থানভেদে পণ্যটির দামের পার্থক্য ছিল ১৭ শতাংশ। ফলের মধ্যে এক দশকে আমের দামের পার্থক্য ছিল ১৭ শতাংশ এবং স্থানভেদে ২০১৮ সালে দামের পার্থক্য ছিল ২২ শতাংশ। বেগুনের দামের পার্থক্য ছিল গত ১০ বছরে প্রায় ২৩ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রে যে অঞ্চলে পণ্যটির উৎপাদন হচ্ছে সেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সরবরাহে বাধা বাজারে পণ্যটির দাম অস্থিতিশীল করে তোলে। যেমন বেগুন ও মরিচের উৎপাদনকারী অঞ্চলে সরবরাহ বাধা তৈরি হলেই সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ও বড় শহরে পণ্যটির দাম দ্রুত বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে মৌসুমি পণ্যের ক্ষেত্রে উৎপাদন কোন পর্যায়ে আছে এবং বাজারে সরবরাহ পরিস্থিতি কী পর্যায়ে রয়েছে  এবং আমদানি পরিস্থিতি কেমন, সেটার ওপর নির্ভর করে দামের ওঠানামা।  মূলত পেঁয়াজ ও ডালজাতীয় পণ্যের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে। এসব পণ্যের ক্ষেত্রে তথ্যের অবাধ প্রবাহ না থাকলে এবং ভোক্তাদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হলেই হঠাৎ দাম বৃদ্ধি পায়। আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কারোপ ও আমদানিতে কোনো ধরনের বাধা থাকলেও দাম ওঠানামা করে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, অধিদপ্তর থেকে প্রতিনিয়তই কৃষিপণ্যের দাম ওঠানামা পর্যালোচনা করে নীতিনির্ধারণ করতে সংশ্লিষ্টদের সুপারিশ করা হচ্ছে। দামের ওঠানামা বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে দেশের মজুদ, আমদানি ও উৎপাদন পরিস্থিতির বিষয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়। আবার বাজার ব্যবস্থাপনায় কোনো স্টেকহোল্ডার অস্বাভাবিক আচরণ বা কারসাজি করছে কিনা, সেটিও দেখা হচ্ছে। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে যৌক্তিকতা পাওয়া গেলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনেকের আচরণ অযৌক্তিক থাকে।  তখন আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হই। এছাড়া কয়েক বছর ধরেই কয়েকটি পণ্যের দাম একটি নির্দিষ্ট সময়েই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এগুলো সরবরাহ সংকটেই হয়ে থাকে। সরবরাহ সংকটে যেসব পণ্যের দামের অস্থিতিশীলতা রয়েছে, সেগুলো দেশেই উৎপাদন বাড়ানোর  দিকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ‘অ্যাসেসিং কম্পিটিশন ইন অনিয়ন মার্কেট অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, পেঁয়াজের ক্ষেত্রে ভোক্তা যে দাম দেয় তা থেকে উৎপাদনকারীর আয় হয় মাত্র ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশ। অন্যদিকে কমিশন এজেন্ট ও আড়তদার পায় ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ, ফড়িয়া ও ব্যাপারি পায় ৭ দশমিক ১ শতাংশ, পাইকার ৮ দশমিক ১৯ এবং খুচরা বিক্রেতারা পায় ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। মোট চাহিদায় আমদানির একটা বড় প্রভাব রয়েছে। মোট আমদানির প্রায় ৭৫-৮০ শতাংশ আসে ভারত থেকে। চীন থেকে আসে ১৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এছাড়া খুব সামান্য একটা অংশ আসে অস্ট্রেলিয়া, মিয়ানমার, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর ও অন্যান্য দেশ থেকে। তাই দামের ওঠানামা কমাতে আমদানি বাজার বহুমুখী করার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গবেষক ও বিআইডিএসের রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে পেঁয়াজের দাম মূলত একটি নির্দিষ্ট সময়েই বাড়ে। ইনফ্লেশনারি এক্সপেকটেশন বা দাম বেড়ে যাবে এমন আতঙ্ক থেকেই মূলত পণ্যটির দাম বেড়ে যায়। আর সে আতঙ্ক তৈরি হয় দেশে উৎপাদন মৌসুম কোন পর্যায়ে আছে, ভারতে উৎপাদন পরিস্থিতি ও শুল্কারোপ কী পর্যায়ে আছে, বন্দরে খালাস ও সেবা পরিস্থিতি কেমন তা ভোক্তারা না জানার কারণে। তাছাড়া উৎসবভিত্তিক চাহিদা বৃদ্ধিও হঠাৎ পেঁয়াজের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ। দামের ওঠানামা কমাতে হলে উৎপাদন মৌসুমের পেঁয়াজকে পরবর্তী সময়ে বাজারে সরবরাহ উপযোগী করতে হবে। এজন্য উৎপাদক ও বিপণন পর্যায়ে মজুদ সক্ষমতা বাড়ানো এবং আমদানির বাজার বহুমুখী করতে হবে। গত এক দশকে গম ও চালের দামের অস্থিতিশীলতা বা ওঠানামার পরিমাণ কিছুটা কম ছিল। এ সময়ে বোরো চালের দামে ওঠানামার হার ছিল প্রায় ৯ শতাংশ। তবে ২০১৮ সালে স্থানভেদে তা ১৬ শতাংশে উন্নীত হয়। এই সময়ে আমন ধানের দামের ওঠানামা ছিল ১১ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে ১৬ শতাংশে উন্নীত হয়। অন্যদিকে গমের দাম এক দশকের ব্যবধানে পার্থক্য ছিল মাত্র ৬ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে স্থানভেদে উন্নীত হয় ১৭ শতাংশে। ফলে চাল ও গমের দামের পার্থক্য সব সময়ই ২০ শতাংশের নিচেই ছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুল মুঈদ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, মূলত দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কারণেই এসব পণ্যের দামের স্থিতিশীলতা দেখা দেয়। তবে অন্য কয়েকটি কৃষিপণ্যের দাম বেশ ওঠানামা করার বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। মূলত মৌসুমের শেষ অথবা শুরুতে কিছু পণ্যের সরবরাহস্বল্পতা কিংবা বাজার মজুদ পরিস্থিতি কমে যাওয়ার কারণে বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম বেশ দ্রুত ওঠানামা করে। এর মধ্যে তেল, ডাল ও মসলাজাতীয় পণ্যই বেশি রয়েছে। আবাদ সম্প্রসারণে অর্থায়ন সুবিধাসহ প্রশিক্ষণ ও বিপণন সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া কৃষক পর্যায়ে মজুদ বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছি।

  • কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত ও কৌশলগতভাবে খাদ্য মজুদ শক্তিশালী করতে চলতি বছরের বোরো মৌসুমে রেকর্ড ২০ লাখ টন চাল-গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। গত সোমবার সময় শেষ হলেও সব মিলিয়ে সংগ্রহ হয়েছে ৮ লাখ ৫৪ হাজার টন ধান-চাল, যা লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও কম। এ অবস্থায় সংগ্রহ সময় আরো ১৫ দিন বাড়ানো হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি ধান-চাল সংগ্রহের সবচেয়ে বড় অংশ আসে বোরো থেকেই। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি সরকারি মজুদ শক্তিশালী করতে খাদ্যশস্য সংগ্রহের কাজটি মূলত খাদ্য অধিদপ্তরই করে। সে লক্ষ্যেই চলতি বছরের বোরো মৌসুমে কৃষক ও অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ৮ লাখ টন ধান এবং ১১ লাখ ৫০ হাজার টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সব মিলিয়ে এবার ২০ লাখ ২৫ হাজার টন ধান-চাল ও গম কেনার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে সেদ্ধ চাল ১০ লাখ টন, আতপ চাল দেড় লাখ টন  ও গম ৭৫ হাজার টন সংগ্রহের পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়। কৃষকদের কাছ থেকে ২৬ টাকা কেজি দরে ধান, মিলারদের কাছ থেকে ৩৬ টাকা কেজি দরে সেদ্ধ চাল ও ৩৫ টাকা কেজি দরে আতপ চাল এবং ২৮ টাকা কেজি দরে গম কেনা হচ্ছে এবার। ৭ মে শুরু হয়ে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। ১৫ এপ্রিলে গম কেনা শুরু হয়ে ৩০ জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। জুনে গম সংগ্রহ কার্যক্রম শেষে ৬৪ হাজার ৪২৯ টন মজুদ করা সম্ভব হয়েছে, যা গত বছর ছিল ৪৪ হাজার ১৫৮ টন। গত সোমবার পর্যন্ত বোরো ধান সংগ্রহ হয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৩৩৭ টন। এছাড়া বোরো সেদ্ধ চাল ৫ লাখ ৬৩ হাজার ৫৫৫ টন ও বোরো আতপ চাল ৮২ হাজার ৭৯৫ টন, সব মিলিয়ে ৮ লাখ ৪৬ হাজার ৬৮৭ টন সংগ্রহ করা হয়েছে। চালের আকারে সর্বমোট ৭ লাখ ৮১ হাজার ৭৬৯ টন সংগৃহীত হয়েছে। চাল ও গম হিসেবে নিলে মোট সংগ্রহের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮ লাখ ৪৬ হাজার ১৯৮ টন। যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ লাখ ২৫ হাজার টন। ফলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১১ লাখ ৭০ হাজার টন সংগ্রহ কম হয়েছে। গত মৌসুমে শুধু চালের সংগ্রহ হয়েছিল প্রায় ১৪ লাখ ৯ হাজার ৮৮৪ টন। ফলে চলতি মৌসুমে চালের আকারে গত মৌসুমের মাত্র ৫৬ শতাংশ অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ায় মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানির মাধ্যমে সংগ্রহ বাড়ানোর নতুন কৌশল নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংগ্রহ সময় বাড়িয়ে এরই মধ্যে সার্কুলার জারি করেছে মন্ত্রণালয়। তবে চাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে শুধু মিলারদের ওপর নির্ভর না করে উৎস পরিবর্তনের বিষয়ে মতামত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে চাল সংগ্রহ ওপেন মার্কেট দরপত্রের মাধ্যমে করা যায় কিনা, সেটি নিয়ে ভাবা যেতে পারে। সেটি করা গেলে বাজার আরো প্রতিযোগিতামূলক করা সম্ভব হবে। এছাড়া আইনি কাঠামো আরো শক্তিশালী করা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চলতি মৌসুমে খাদ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নাও হতে পারে এমন একটি বিষয়ের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিল। এজন্য অনেক আগে থেকেই আমি সরকারিভাবে চাল আমদানির পক্ষেই ছিলাম। সরকারের মজুদ কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত পরিমাণের নিচে রাখা যৌক্তিক হবে না। মহামারী পরিস্থিতিতে মজুদ কমে গেলে আরো বিপদ বাড়বে। পাশাপাশি কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় চাল আমদানি বেসরকারিভাবে উন্মুক্ত না হলে শুধু সরকারিভাবে করতে হবে। সরকারের সেই আমদানি দ্রুতই করতে হবে। এর পরও মজুদ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমতি দিতে হবে। যেসব মিলার চুক্তি অনুসারে সরকারকে চাল দিচ্ছে না তাদের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। চাল সংগ্রহে শুধু মিলারদের ওপর নির্ভর না করে কিংবা বিকল্প মডেল আছে কিনা সেটি নিয়ে ভাবা যেতে পারে।’ এবারের মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে ধান এবং মিলারদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে নাও হতে পারে, এমন পর্যালোচনা ছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে। সেজন্য বরিশাল বিভাগের সঙ্গে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রম পর্যালোচনা সভায় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার মিলারদের সতর্কবার্তাও দিয়েছিলেন। মিলারদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা এবং মিলকে কালো তালিকাভুক্ত করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় সরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমোদন নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।

  • তুলনামূলক স্বল্প খরচে কোনো পণ্য নিজ দেশে উৎপাদন সম্ভব হলে তা ওই পণ্যটির ক্ষেত্রে তুলনামূলক সুবিধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতিযোগী দেশের তুলনায় কোনো কৃষিপণ্য স্বল্প খরচে দক্ষতার সঙ্গে ঊৎপাদন করার বিষয়টি এক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়। এটি পরিমাপে ব্যবহার করা হয় রিভিলড কমপারেটিভ অ্যাডভানটেজ (আরসিএ) স্কোর। আর সেই মানদণ্ডে দেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এখন পাট। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। আরসিএ স্কোর ১-এর থেকে বেশি হলে পণ্যটি প্রতিযোগী দেশের তুলনায় ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। সেটি দেশে উৎপাদন করার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি লাভবান হওয়া সম্ভব। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে পাটের আরসিএ মান ৪৮৮। দেশে গত বছর প্রায় ৮৬ লাখ বেল পাটের উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া পাট ও পাটজাতীয় পণ্যের মাধ্যমে রফতানি আয় হয়েছে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার। ফলে আরসিএ মান বেশি থাকায় দেশে আরো বেশি পাটের উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে অধিক সুবিধা নেয়ার সুযোগ রয়েছে। কৃষিজ অন্যান্য যেসব পণ্যের ক্ষেত্রে আরসিএ মান ভালো সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সরিষা, রসুন, তিল ও তুলা। পাশাপাশি মাছ, মসলা, তামাক, পালংশাক, পেঁপে, আলু ও মরিচে ভালো অবস্থানে রয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের দেশের একটি বড় সুবিধা হলো ইচ্ছে করলেই সব উৎপাদন করতে পারি। আমাদের আবহাওয়া ও মাটি সেটিকে সাপোর্ট করে। তবে কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন বাড়ানো ও শস্যের বহুমুখীকরণে অবশ্যই বাণিজ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দিতে হবে। যে পণ্যটি বেশি সুবিধা দেবে সেটি দেশেই উৎপাদনে নজর দিতে হবে। তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে যেটি কম সুবিধা দেবে, সে শস্য উৎপাদন বাড়ানোর অর্থ হলো কৃষককে কার্যকর সুবিধা দিতে পারব না। যদি না সরকারের সরাসরি ইন্টারভেনশন থাকে। কৃষিপণ্যের তুলনামূলক সুবিধা একটি পরিবর্তনশীল বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি কার্যকর আরসিএ তালিকা থাকা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে নতুন কোনো পণ্য দেশে উৎপাদন করতে গেলে নীতি ও কৌশল নির্ধারণে সহায়ক হবে। পাশাপাশি প্রযুক্তি, জ্ঞান ও উপকরণ সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা যাবে। কমপারেটিভ অ্যাডভানটেজ বা তুলনামূলক সুবিধা তত্ত্বটি প্রথম প্রবর্তন করেন ১৮১৭ সালে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ডেভিড রিকার্ডো। যার মূল বিষয় ছিল আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানির চেয়ে দেশে উৎপাদন করে যেসব পণ্যে বেশি লাভবান হওয়া যাবে, সে পণ্যই দেশে উৎপাদন করা। যেটি কম লাভ দেবে, সে পণ্য প্রতিযোগী দেশে উৎপাদনের জন্য ছেড়ে দেয়া। আর এভাবেই দুটি দেশ দুটি পণ্য উৎপাদন ও বাণিজ্য করে তুলনামূলক সুবিধা পাবে। তখন দুই দেশের মধ্যে একটি পণ্য উৎপাদন অন্য পণ্যটি আমদানির মাধ্যমে ব্যয়ের সাশ্রয় ও দক্ষতা অর্জন করবে। দুটি দেশের দুটি পণ্যের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরীকৃত এ তত্ত্বটি জনপ্রিয় করে আরসিএ মানদণ্ডে পরিমাপ করা হয়। আর বাংলাদেশে সেখানে আরসিএ মানে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে কলা, দুধ, আঙুর, তিসি। এছাড়া যব, কপি ও ব্রকলি, সয়াবিন, লেবু ও আদার মান নিম্ন সারিতে রয়েছে। এসব কৃষিজ পণ্যে আরসিএ মান শূন্য দশমিক ১ শতাংশেরও কম। ১ শতাংশের নিচে রয়েছে বেশকিছু কৃষিজ পণ্য। এর মধ্যে পেঁপেতে শূন্য দশমিক ৯৩, আলুতে শূন্য দশমিক ৭৫, মরিচে শূন্য দশমিক ৭১। ফলে বাণিজ্য সুবিধায় পিছিয়ে রয়েছে এসব কৃষিজ পণ্য। এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সাবেক সভাপতি ও সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, সব কৃষিজ পণ্য একই সঙ্গে উৎপাদনের প্রয়োজন নেই। কৃষকের কাছে জোর করে কোনো পণ্য উৎপাদন বাড়াতে গেলে দক্ষতার পরিচয় হবে না। এক্ষেত্রে শস্যের উৎপাদন খরচ, প্রয়োজনীয়তা ও বাণিজ্যের তুলনামূলক সুবিধা বিশ্লেষণ জরুরি। পাশাপাশি ভূপ্রাকৃতিক গঠন, বাজারদর, আবহাওয়া উপযোগিতা ও মাটির কার্যকারিতা বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। বাণিজ্যিক ও রফতানিমুখী কৃষি এগিয়ে নিতে শস্য আবাদে বহুমুখীকরণে জোর দিতে হলে অবশ্যই বাণিজ্য সুবিধাকে বিবেচনায় নিতে হবে। জানা গেছে, আরসিএ মানে ভালো অবস্থানে থাকা অন্যান্য কৃষিজ পণ্যের মধ্যে সরিষা ও রসুনে স্কোর ১০ দশমিক ৫২। এছাড়া তিলে ৪ দশমিক ৮২, তুলায় ২ দশমিক ৩৪ ও মাছে ২ দশমিক ১৮। এছাড়া মসলায় ১ দশমিক ৫৪, তামাকে ১ দশমিক ২৬, পালংশাকে ১ দশমিক শূন্য ৪। এসব পণ্য আমদানি না করে দেশেই উৎপাদনে নজর দিলে দেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। পাশাপশি উৎপাদন প্রক্রিয়া হবে দক্ষ ও কার্যকর। কৃষিজ পণ্যের আমদানি প্রতি বছরই বাড়ছে। গত অর্থবছরে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি করতে হয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে তুলা। গত অর্থবছরে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকার তুলা আমদানি করতে হয়েছে। এছাড়া তেল ও মসলাজাতীয় পণ্যের আমদানিও বাড়ছে। এসব পণ্য দেশে উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুল মুঈদ বণিক বার্তাকে বলেন, কৃষিজ পণ্যের উৎপাদনে আমাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনাই ছিল দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। সরকারের সঠিক নীতিসহায়তা ও কার্যকর উদ্যোগের কারণে দানাদার খাদ্যে এখন আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছে। এখন আমরা শস্যের বহুমুখীকরণ ছাড়াও কৃষির বাণিজ্যিকীকরণে জোর দিচ্ছি। সেখানে যেসব কৃষিজ পণ্য মূল্য সংযোজন কিংবা কৃষকের বাড়তি মুনাফা দিতে পারবে এমন শস্য আবাদে কৃষকের উৎসাহিত করা হচ্ছে। বাণিজ্য সুবিধা ছাড়াও দেশের প্রয়োজন ও চাহিদাকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। সার্বিকভাবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় রাখতে উপকরণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের কৃষি, বিশেষ করে শস্য খাত।

  • কৃষকের খরচ কমিয়ে আনতে গত এক দশকে সারের মূল্য কমানো হয়েছে পাঁচবার। আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর চাপ উপেক্ষা করে অব্যাহত রাখা হয়েছে ভর্তুকি। গত এক যুগে শুধু সারেই প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। ভর্তুকি নিয়ে সরকারের এ ভালো নীতির সুফল পাচ্ছে দেশের কৃষি খাত। বেড়েছে শস্যের উৎপাদন, কমেছে কৃষকের খরচের চাপ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশে বিভিন্ন শস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় দেড় কোটি টন, যা এখন বেড়ে ৭ কোটি ১৫ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। যদিও এ সময়ের ব্যবধানে কমেছে কৃষিজমির পরিমাণ। বাংলাদেশকে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা প্রদানে ২০১১-১২ অর্থবছরে বেশকিছু শর্ত দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তাদের দেয়া শর্তের মধ্যে অন্যতম ছিল ভর্তুকি কাঠামোতে পরিবর্তন এনে বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকি কমানো।  কিন্তু আইএমএফের চাপ উপেক্ষা করে সারে ভর্তুকি অব্যাহত রেখেছে সরকার। গত এক দশকে পাঁচ দফা কমিয়েছে সারের মূল্য। দাম কমিয়ে ৮০ টাকার টিএসপি সার ২২, ৭০ টাকার এমওপি সার ১৫ ও ৯০ টাকার ডিএপি সার ১৬ টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বর মাসেই কমানো হয়েছে ডিএপি সারের দাম। আগে এ সারের  কেজিপ্রতি মূল্য ছিল ২৫ টাকা। এখন তা ৩৬ শতাংশ কমিয়ে ১৬ টাকা করা হয়েছে। ডিলার পর্যায়ে বর্তমান ২৩ টাকার পরিবর্তে ১৪ টাকা কেজিতে ডিএপি সার কিনতে পারছেন কৃষক। এতে ডিএপি সারে সরকারের বছরের প্রণোদনা বাবদ খরচ হবে ৮০০ কোটি টাকা। সারে সরকারের এ ভর্তুকি সহায়তা কার্যক্রম  শস্যের উৎপাদন বাড়াতে সহায়ক হচ্ছে। কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান নীতিই হলো কৃষকের উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার পাশাপাশি সারের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করা। কৃষকের পাশে থাকতে পারলেই দেশের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব। সে বিবেচনায় সারের দাম কমানোর মাধ্যমে ভর্তুকি সহায়তা বাড়াতে সরকার কখনই কার্পণ্য করে না। সামনের দিনেও সারের দাম সহনীয় রাখতে কৃষকবান্ধব নীতিতে অটল থাকবে সরকার। কৃষিপণ্যের বিপণন ও প্রক্রিয়াজাতে ভর্তুকি বাড়ানোসহ এর আওতা আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ৬৫ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকার ভর্তুকি সহায়তা দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে সার বাবদ ভর্তুকি দেয়া হয়েছে ৫৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৭ হাজার কোটি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে সারে। সব মিলিয়ে গত ১২ বছরে শুধু সারেই প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। সারের ভর্তুকি কার্যক্রমের কারণে পাঁচটি শস্যের ক্ষেত্রে গ্রস মার্জিন বা মোট আয় কী পরিমাণ হচ্ছে এবং ভর্তুকি না থাকলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াত—এ দুইয়ের পার্থক্য উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায়। ‘বিল্ডিং রেজিলেন্স অ্যান্ড কমপিটিটিভনেস অ্যালং ভ্যালু-চেইনস ইন এগ্রি-ফুড সিস্টেম’ শীর্ষক ওই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ভর্তুকি ছাড়া প্রতি হেক্টরে ভুট্টায় কৃষকের মোট আয় (গ্রস মার্জিন) হতো ২৯৮ ডলার, যা ভর্তুকির কারণে ৪১২ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ফলে ভর্তুকিতে প্রায় ১১৪ ডলার বাড়তি আয় করতে পারছেন কৃষক। সয়াবিনের ক্ষেত্রে ভর্তুকি বাদে প্রতি হেক্টরে কৃষকের মার্জিন হতো ৫৩ ডলার, যা ভর্তুকির কারণে ২৩৮ ডলার পাচ্ছেন কৃষক। ফলে প্রায় ১৮৫ ডলার বাড়তি আয় করতে পারছেন কৃষক। আমন ধানের ক্ষেত্রে ভর্তুকি বাদে প্রতি হেক্টরে কৃষকের আয় হতো ৪০ ডলার, যা বর্তমানে ১১৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। এতে প্রায় ৭৪ ডলার বাড়তি আয় হচ্ছে। আউশ ধানের ক্ষেত্রে ভর্তুকি বাদে প্রতি হেক্টরে কৃষকের মার্জিন হতো ৫৩ ডলার, যা বর্তমানে ১২৬ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ফলে ভর্তুকির কারণে প্রায় ৭৩ ডলার বাড়তি আয় করতে পারছেন কৃষক। তবে বোরো ধানে ভর্তুকি না দিলে মোট ক্ষতি হতো ১৭১ ডলার। ভর্তুকির কারণে মোট ক্ষতি ৭১ ডলারে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ফলে মোট ক্ষতি ১০০ ডলার পর্যন্ত কমানো যাচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫৬ লাখ ১০ হাজার টন। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট রাসায়নিক সারের চাহিদা নিরূপণ হয় ৫৯ লাখ ৩৪ হাজার টন। এর মধ্যে ইউরিয়া ২৬ দশমিক ৫০ লাখ টন, টিএসপি ৭ দশমিক ৫০ লাখ, ডিএপি ৯ লাখ, এমওপি ৮ দশমিক ৫০ লাখ ও এমএপি শূন্য দশমিক ৫০ লাখ টন। এছাড়া অন্যান্য রাসায়নিক সারের মধ্যে জিপসাম ৪ লাখ টন, জিংক সালফেট ১ লাখ ৩৩ হাজার, অ্যামোনিয়াম সালফেট ১০ হাজার, ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ৮০ হাজার ও বোরন ৪১ হাজার টন। অন্যদিকে এনপিকেএস ৭০ হাজার টন নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব সারের বাজারমূল্য থেকে অনেক মূল্যে সারের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সরকার ভর্তুকি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

  • উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে বিভিন্ন সময়ে ৮ হাজার ৪২২ কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। কিন্তু করোনা মহামারী, প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে বিলম্ব, জমি গ্রহণে জটিলতা, অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতাসহ নানা জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরে স্থবিরতা বিরাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন প্রকল্পে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৫৯ কোটি ৮০ লাখ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৮০ কোটি ৬০ লাখ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫০ কোটি ৫৬ লাখ, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৩৮ কোটি ৩৭ লাখ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ হাজার ৯২০ কোটি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ হাজার ৬৫৫ কোটি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটিতে ১ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি চলছে। দীর্ঘ ছুটিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চলমান উন্নয়নকাজ এক প্রকার বন্ধই রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়তে পারে। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হওয়ার পর সবচেয়ে বড় বরাদ্দ পেয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানার তেঘরিয়া ইউনিয়নের পশ্চিমদি মৌজায় প্রায় ২০০ একর ভূমির ওপর নতুনভাবে ক্যাম্পাস নির্মাণ করা হবে। কেরানীগঞ্জে নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনে ১ হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকার প্রকল্প চলমান রয়েছে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, নতুন ক্যাম্পাসে একাধিক একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, ছাত্রছাত্রীদের জন্য হল, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসন ব্যবস্থা, চিকিৎসা কেন্দ্র, ক্যাফেটেরিয়া, খেলার মাঠ, সুইমিং পুল, মসজিদ এবং পরিবহন ও আধুনিক বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। গত বছর বরাদ্দের সব টাকা খরচ করা হলেও চলতি বছর করোনার কারণে পুরো বরাদ্দ খরচ করা সম্ভব হয়নি। এখন এ প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪৬ শতাংশ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, এ প্রকল্পে ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানার তেঘরিয়া ইউনিয়নের পশ্চিমদি মৌজায় প্রায় ২০০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, যেটা আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। গত দুই বছরে প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রায় ৪৬ শতাংশ। করোনার কারণে উন্নয়ন কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। আশা করছি সরকারের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩টি স্থাপনা নির্মাণসহ সার্বিক উন্নয়নে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয় ২০১৮ সালে। অবকাঠামো উন্নয়ন, আবাসিক এবং অন্যান্য সুবিধা সম্প্রসারণের মাধ্যমে মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য উপযুক্ত শিক্ষাদান ও শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে নেয়া প্রকল্পটি ২০২২ সালে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। তবে অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা ও করোনার কারণে কাজের অগ্রগতি এখনো ১০ শতাংশের নিচে। করোনার মহামারীর মধ্যেই প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার পরিচালক নাসির উদ্দিন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, করোনার মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে উন্নয়নকাজ অব্যাহত রয়েছে। তবে গত বছরের বরাদ্দের তুলনায় ২০ শতাংশ কাজ কম হয়েছে এ বছর। গত অর্থবছরে সরকার যা বরাদ্দ দিয়েছিল তার সব কাজই শেষ হয়েছিল। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮ সালের ১০ জুলাই ৬৫৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০২২ সাল নাগাদ এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এ প্রকল্প দিয়ে দুটি প্রশাসনিক ভবন (একটি ১০ তলা, অন্যটি তিনতলা) নির্মাণ, ১০ তলাবিশিষ্ট ছয়টি একাডেমিক ভবন, আটটি দোতলাবিশিষ্ট মাঠ গবেষণা,  ১০ তলাবিশিষ্ট তিনটি হোস্টেল (একটি ছাত্রী, দুটি ছাত্র), শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য ছয়টি আবাসিক ভবন (পাঁচটি ১০ তলা, একটি ছয়তলা), ছয়তলাবিশিষ্ট টিএসসি কমপ্লেক্স ভবন, আটতলাবিশিষ্ট মাল্টিপারপাস ভবন এবং নারীদের জন্য একটি সুইমং পুল নির্মাণ করা হবে। নানা কারণে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২৯ দশমিক ২৩ শতাংশ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. লুত্ফুল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে এ ধরনের বড় বরাদ্দ সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো অর্থ ছাড়ে দেরি ও পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আমরা কাজের অগ্রগতি আশানুরূপ করতে পারিনি। প্রথম অর্থবছর অর্থ ছাড়ে দেরি করার কারণে খরচ করতে পারিনি। ফলে কাজের অগ্রগতি হয়নি। সেজন্য সেই অর্থ ফেরতও দিয়েছিলাম। পরের অর্থবছরে করোনার কারণে নির্দিষ্ট কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারিনি। মহামারী পরিস্থিতি সব উন্নয়ন প্রকল্পেই বাধা তৈরি করেছে। তবে ঘুরে দাঁড়াতে আমরা বিকল্প পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। প্রতিটি কাজকে আলাদা ভাগে বিভক্ত করে একজন অধ্যাপকের নেতৃত্বে শক্তিশালী তদারকি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি কাজগুলো সময়মতো শেষ করার পাশাপাশি মান তদারক করছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় ২০১৮ সালে। দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ ২ হাজার ৫০০ আসনবিশিষ্ট অডিটোরিয়াম নির্মাণ, নবনির্মিত একাডেমিক ভবনটি ১০ তলায় বর্ধিতকরণ, প্রশাসনিক ভবন পাঁচতলা থেকে ১০ তলায় উন্নীতকরণ, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ডরমিটরি ও হলগুলো পাঁচতলা থেকে ছয়তলায় বর্ধিতকরণ, অ্যাম্ফিথিয়েটার নির্মাণের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। তবে কাজের অগ্রগতি ৪৯ শতাংশ। প্রকল্পের কাজের অগ্রগতির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার ডেপুটি ডিরেক্টর তুহিন মাহমুদ বণিক বার্তাকে বলেন, উন্নয়নের জন্য ২৫০ কোটি টাকার বিপরীতে ১১৩ কোটি বরাদ্দ হয়েছে। শ্রমিক সংকটের কারণে তিন মাস উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। তবে এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। প্রশাসনিক ভবন পাঁচতলা থেকে ১০ তলায় উন্নীতকরণ প্রকল্পে আরো দোতলা ছাদ হয়ে গেছে। ২০১৮ সালে ৮৩৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকার প্রকল্প নেয়া হয় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রকল্পটি ২০২২ সালে সমাপ্ত হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পের অধীনে ভূমি অধিগ্রহণ, ১০ তলাবিশিষ্ট নতুন একাডেমিক ভবন ও ইনস্টিটিউট ভবন নির্মাণ, পাঁচতলাবিশিষ্ট দুটি ছাত্র হল ও দুটি ছাত্রী হল, পাঁচতলা পর্যন্ত দুটি ছাত্র হলের আনুভূমিক সম্প্রসারণ, ১০ তলাবিশিষ্ট শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবন, পাঁচতলাবিশিষ্ট শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের ডরমিটরি ভবন, ১০ তলাবিশিষ্ট স্টাফদের আবাসিক ভবন, সোলার সিস্টেম স্থাপনসহ সাবস্টেশন নির্মাণ করা হবে।  এখন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১০ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক ড. কাজী একিউএম মহিউদ্দিন এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, গত বছরের বরাদ্দের প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ করা সম্ভব হয়েছে। বাকি ৩০ শতাংশ কাজ করোনার কারণে ব্যাহত হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে পারা সম্ভব হবে না বিধায় এরই মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হয়েছে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন’ নামে ১ হাজার ৬৫৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার অনুমোদন দেয় একনেক, যা ২০১৮ সালের নভেম্বরে শুরু হয়ে ২০২৩ সালের জুনে শেষ করতে হবে। তবে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২০ শতাংশ। এ বিষয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতার কারণে প্রকল্পটি এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে কিছুদিন হলো এ জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। আর্থিক কার্যক্রম সম্পন্ন হলে অগ্রগতি আরো বেশি হবে। প্রকল্পের দায়িত্ব সেনাবাহিনী নেয়ার পর কার্যক্রমে দ্রুত অগ্রগতি হচ্ছে। চলতি বছরে প্রকল্পের দৃশ্যমান উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি স্থাপনে ১ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। তবে দুই বছরে বিভিন্ন সমন্বয়হীনতায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন সেভাবে করা সম্ভব হয়নি। ফলে প্রকল্পের অগ্রগতি এখনো ১০ শতাংশের নিচে। প্রশাসনের কর্মকর্তা বলছেন, কভিড-পরবর্তী সময়ে দ্রুতগতিতে কাজ এগিয়ে চলছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন তারা। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮ সালে শুরু হওয়া ৪৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকার প্রকল্পের মাধ্যমে একটি ১০ তলা প্রশাসনিক ভবন, দুটি ১২ তলা একাডেমিক ভবন, ছাত্রদের একটি ১০ তলা ও ছাত্রীদের একটি ১০ তলা আবাসিক হল, একটি চারতলা টিএসসি, একটি চারতলা কনভেনশন সেন্টার, একটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ বেশকিছু কার্যক্রম করা হবে। এ প্রকল্পের কাজের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে দুদিনে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের  উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম রুস্তম আলীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও প্রকল্পের বাস্তবায়ন হারের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলে বণিক বার্তাকে বলেন।

  • আশির দশকে শিক্ষাজীবন শেষ করে মত্স্য উৎপাদন ও বিপণনে যুক্ত হন ময়মনসিংহের তিন তরুণ। চাকরিতে না ঢুকে মত্স্য খামারের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান করতে গিয়ে শুরুতে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হলেও একপর্যায়ে সাফল্যের দেখা পান তারা। তাদের সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্থানীয় অনেক তরুণই এগিয়ে আসেন মত্স্য চাষের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানে। একপর্যায়ে এ চর্চা ছড়িয়ে পড়ে গোটা জেলায়, যার ধারাবাহিকতায় দেশে এখন মত্স্য উৎপাদনে শীর্ষ জেলা হয়ে উঠেছে ময়মনসিংহ। বর্তমানে বৈশ্বিক মত্স্য উৎপাদনে (অ্যাকুয়াকালচার) শীর্ষ পাঁচ দেশের অন্যতম বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে ময়মনসিংহ জেলার অবদান সবচেয়ে বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জেলাটিতে মাছ উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ৮২ হাজার টন। এর পরের অবস্থানে রয়েছে যশোর। জেলাটিতে এ সময় মাছ উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার টন। তৃতীয় শীর্ষ জেলা কুমিল্লায় এ সময় মোট মত্স্য উৎপাদনের পরিমাণ ২ লাখ ১৪ হাজার টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে মোট চাষকৃত মাছের উৎপাদন ছিল ৩৬ লাখ ২২ হাজার টন। এর মধ্যে এ তিন জেলায়ই উৎপাদন হয়েছে ৮ লাখ ৪৭ হাজার টন। সে হিসেবে দেশে চাষকৃত মাছের প্রায় ২৪ শতাংশই সরবরাহ হচ্ছে জেলা তিনটি থেকে। জানা গিয়েছে, ময়মনসিংহের তিন তরুণ শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯৮৩ সালে জেলার ত্রিশাল, ভালুকা ও মুক্তাগাছা এলাকায় মাছের চাষ শুরু করেন। নদী থেকে রেণু নিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে পোনা উৎপাদনের মাধ্যমেই মত্স্য খামার গড়ে তোলেন আল-ফালাহ মত্স্য খামারের পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন, ব্রহ্মপুত্র মত্স্য হ্যাচারির স্বত্বাধিকারী নুরুল হক ও রিলায়েন্স অ্যাকুয়া ফার্মের মালিক হূতিশ পণ্ডিত। তাদের দেখাদেখি শম্ভুগঞ্জ ও ফুলপুর, গৌরীপুর, ভালুকায়ও বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা স্বল্প পরিসরে মত্স্য চাষকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। একপর্যায়ে জেলার সব উপজেলায় লাখ লাখ তরুণ এভাবে মত্স্য খামারের দিকে ঝুঁকে পড়েন। পাশাপাশি বড় কয়েকটি করপোরেট গ্রুপও এখন জেলাটিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বৃহৎ পরিসরে মাছের উৎপাদন শুরু করেছে। এছাড়া মত্স্য গবেষণাগত দিক থেকেও বড় দুটি প্রতিষ্ঠান জেলাটিতে মত্স্য উৎপাদনে বড় ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত্স্য অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা তাদের গবেষণার প্রাথমিক ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন এ এলাকার বিভিন্ন উপজেলাকে। আঞ্চলিক সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল দ্রুত রপ্ত করতে পারছেন স্থানীয় খামারিরা। ফলে এখানে মত্স্য চাষের সম্প্রসারণও হয়েছে অনেকটা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে। এ বিষয়ে মত্স্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, ময়মনসিংহে মাছের উৎপাদন বাড়াতে তিন তরুণ এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও মত্স্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তবে উৎপাদন ও বিপণনে এখনো বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সেগুলো দূর করতে হবে। এছাড়া মাছের খাদ্যের দাম কমিয়ে আনতে উদ্যোগ প্রয়োজন। মাছ চাষে প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের বিলটাও কমিয়ে আনতে হবে। কৃষির শস্য উপখাতের মতো সুযোগ-সুবিধা দেয়া গেলে মত্স্য উপখাতও প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে। এছাড়া মত্স্য খামারিদের জমির লিজের অর্থায়ন নিয়েও আরো কাজ করতে হবে। মত্স্য চাষে যশোর জেলার শুরুটা অবশ্য চল্লিশের দশকে। সে সময়ে প্রতাপাদিত্য নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি চাঁচড়ার বর্মণ পাড়া এলাকায় পাবদা মাছের চাষ শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ষাটের দশকে মহসিন আলী মাস্টার নামের একজন উদ্যোক্তা পাবদা ছাড়াও অন্যান্য মাছ চাষের জন্য রেণু উৎপাদন শুরু করেন। তার দেখাদেখি পরবর্তী সময়ে এগিয়ে আসেন নতুন উদ্যোক্তারা। ফলে বর্তমানে দেশের প্রধান রেণু সরবরাহকারী অঞ্চলে পরিণত হয়েছে চাঁচড়া। যশোর উঠে এসেছে মত্স্য উৎপাদনে দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ জেলা হিসেবে। বর্তমানে যশোর জেলায় ২২ প্রজাতির মাছের চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে রুই। উপজেলা পর্যায়ে মত্স্য খামার স্থাপনে এগিয়ে আসছেন বেসরকারি অনেক উদ্যোক্তা। জেলাটিতে মাছ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে আফিল অ্যাকুয়া ফিশ। দুই হাজার বিঘা জমির ওপর মাছ চাষ করছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিদিন মাছ ও মাছের পোনা উৎপাদন হচ্ছে ১০ টন। মত্স্য চাষের মাধ্যমে এখানে যেমন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি তা এখানকার জলাবদ্ধতার সমস্যা দূর করায়ও ভূমিকা রাখছে। এ বিষয়ে আফিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ আফিল উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ২০০৮ সালে শার্শা উপজেলার মান্দারতলা এলাকায় জলাবদ্ধতা নিয়ে ভাবতে শুরু করি। এরপর মত্স্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেই গড়ে তুলি অ্যাকুয়া ফিশ ফার্ম। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে আফিল অ্যাকুয়া ফিশে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছ উৎপাদন করা হচ্ছে। যেখানে মাছের গুণগত মান সঠিক রাখা হয়েছে। এতে একদিকে যেমন এলাকার মানুষ জলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে, তেমনি নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি করা গিয়েছে। আমরা ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে মাছের উৎপাদনে যাব। বর্তমানে যশোরের উৎপাদিত মাছ প্রতিবেশী ভারতে রফতানি করা হচ্ছে বলে জানালেন বেনাপোল স্থলবন্দরের ফিশারিজ কোয়ারেন্টিন অফিসার মাহবুবুর রহমান। তিনি জানান, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এখান থেকে ভারতে মাছ রফতানি হয়েছে ৩২ লাখ ৬৭ হাজার ৪৪ কেজি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ লাখ ৮৩ হাজার ৬৩০ কেজিতে। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ উন্নীত হয় ৫২ লাখ ৪৫ হাজার ৮ কেজিতে, যার রফতানি মূল্য ১ কোটি ৩১ লাখ ১২ হাজার ৫২০ ডলার। এ বিষয়ে যশোর জেলা মত্স্য কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান জানান, যশোর জেলায় ৭০ হাজার ২৯২ হেক্টর জমিতে মাছের উৎপাদন হচ্ছে। জেলাটি বর্তমানে দেশে মত্স্য উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। বছরে এখানে উৎপাদিত মাছ বেচাকেনা হচ্ছে প্রায় হাজার কোটি টাকার। এখানকার মাছ রফতানির পাশাপাশি সারা দেশেই বিক্রি হচ্ছে। জেলায় মাছ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের জন্য আমরা সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সুবিধার সম্প্রসারণ করছি। বাজারজাত ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন এবং উন্নত জাতের পোনা সরবরাহ করা গেলে দেশের খামারগুলোয় মাছের উৎপাদন বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় গুণগত ও মানসম্পন্ন ব্রুড মাছ আমদানি করে বেসরকারি খাতে সরবরাহ করলে মাছের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন আরো বাড়ানো সম্ভব। এছাড়া ফিশ ফিডের দামও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। উৎপাদন টেকসই করতে হলে পরিবেশগত ভারসাম্য আনাটাও জরুরি। এছাড়া মাছ উৎপাদন শিল্পে মূল্য সংযোজন কীভাবে বাড়ানো যায়, সেদিকেও নজর দিতে হবে।

  • বোরো মৌসুমে প্রতি কেজি ধানের সরকার নির্ধারিত দাম ছিল ২৬ টাকা। সেই ধান কৃষকের কাছ থেকে চালকল মালিক ও ফড়িয়ারা কিনছেন ১৫ টাকারও কম দামে। প্রতি মণ ধান কিনতে তাদের ব্যয় হচ্ছে ৬০০ টাকারও কম। প্রতি মণ ধান থেকে তৈরি হয় ২৭ কেজি চাল, যা সরকারের কাছে হাজার টাকায় বিক্রি করছেন তারা। সে হিসেবে প্রতি মণ ধানে ৪০০ টাকা অর্থাৎ অস্বাভাবিক মুনাফা করছেন চালকল মালিক ও আড়তদাররা। ২০১৯ সালের বোরো মৌসুমে ধান-চালের দাম, উৎপাদন খরচ ও সংগ্রহ পদ্ধতির ওপর একটি গবেষণা করেছে আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই)। গবেষণায় দেখা গেছে, ওই মৌসুমে চালকল মালিকরা কৃষকের কাছ থেকে প্রতি কেজি ধান ১৪ টাকা ৯৭ পয়সা দামে কিনেছেন, যা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রায় ১১ টাকা কম। আবার সেই ধান প্রক্রিয়াজাত করে ন্যূনতম ৩৬ টাকায় বিক্রি করেছেন তারা। শুধু মিলার নয়, ট্রেডার্স বিশেষ করে ফড়িয়া, ব্যাপারী, আড়তদাররাও ধান সংগ্রহকালে কৃষকদের দামে ঠকিয়েছেন। কৃষকের কাছ থেকে তারা ধান কিনেছেন প্রতি কেজি ১৫ টাকা ২৬ পয়সায়। বাজারের প্রায় ৯২ শতাংশ ধান ট্রেডার্সরাই কিনে থাকেন। ফলে এ শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের কাছেই সবচেয়ে বেশি ঠকেছেন কৃষক। মিলার ও ট্রেডার্সদের অতিমুনাফার প্রবণতা থেকে কৃষকদের রক্ষা করতে হলে ধান সংগ্রহ কার্যক্রম সম্পূর্ণ সরকারিভাবে পরিচালিত করার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সরকার কৃষকের সব ধান কিনে নিলে গত বোরো মৌসুমে ধানের বাজারমূল্য প্রায় ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব হতো। এতে কৃষকরা আরো লাভবান হতে পারতেন। এমনকি ধানের দাম সরকার নির্ধারিত ২৬ টাকার নিচে হলেও প্রকৃত বাজারমূল্য উন্নত হতে পারত এতে। আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. আখতার আহমেদ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, কৃষকের কাছ থেকে প্রতি কেজি ধান ১২-১৬ টাকায় কেনা মোটেও অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিযুক্ত নয়। নগদ অর্থের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে মৌসুমের শুরুতেই কম দামে ধান বিক্রি করেন কৃষক। আর এর সুযোগ নিচ্ছেন মিলার ও ফড়িয়ারা। মিলারদের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো বাজার থেকে সবচেয়ে কম দামে ধান কিনতে পারা, বিশেষ করে হাইব্রিড ধান। বাজারে এ ধানটির কোনো ক্রেতা থাকে না বলে মিলাররা অনেক ক্ষেত্রে ১২ টাকার নিচে ধানটি কিনতে পারেন। পরবর্তী সময়ে এ ধান প্রক্রিয়াজাত করে ৩৬ টাকায় সরকারের কাছে বিক্রি করেন তারা, যা থেকে তাদের অস্বাভাবিক মুনাফা হয়। কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার কোনো বিকল্প নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ধান কেনায় আর্দ্রতা নিয়ে সমস্যা হতে পারে। সে প্রতিবন্ধকতা মেটাতে হলে আর্দ্রতা অনুসারে দাম নির্ধারণ করে কৃষকের কাছ থেকেই কিনতে হবে। আর্দ্র ধান শুকানোর কাজে চার্জের বিনিময়ে মিলারদের যুক্ত করতে হবে। সেটি করা গেলে কৃষকরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি মিলাররাও ব্যবসায় টিকে থাকতে পারবেন। সরকারের ক্রয়প্রক্রিয়ায়ও দক্ষতা আসবে এতে। মিলার ও ট্রেডার্সদের কাছে কম দামে ধান বিক্রি করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা। কেননা বোরো চাষে যুক্ত কৃষকের প্রায় ৪৭ শতাংশই ক্ষুদ্র কৃষক। এসব কৃষকের জমির পরিমাণ শূন্য দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৪৯ একর। অন্যান্য শ্রেণীর কৃষকের তুলনায় তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছেন গত বোরো মৌসুমে। এ শ্রেণীর কৃষকরা ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে তাদের মোট বোরো ধানের প্রায় অর্ধেক বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।  স্বাভাবিকভাবে এ সময়ে ধানের দাম কম থাকায় ন্যায্যমূল্য পাননি তারা। শুধু ক্ষুদ্র কৃষক নয়, দাদন নিয়ে ধান চাষ করেছেন এমন অন্য শ্রেণীর কৃষকরা দাম কম পেয়ে ক্ষতির শিকার হন। বোরো আবাদে যুক্ত কৃষকের ৩৩ শতাংশই বর্গাচাষী ও দাদন নিয়ে আবাদকারী কৃষক। জমির মালিকদের দ্রুত নগদ অর্থ পরিশোধের তাড়া থাকে তাদের। বর্গা বা ভাগচাষীর সংখ্যা মোট কৃষকের প্রায় ২৬ শতাংশ। এ শ্রেণীর কৃষককেও জমির ভাড়া বাবদ অর্থ পরিশোধ করতে হয়। এজন্য তারাও কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন। ক্ষুদ্র ও বর্গাচাষীদের লোকসান কমাতে সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহ বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হলেও সে কার্যক্রমে সরকারের অংশগ্রহণ খুবই কম। ২০১৯ সালের ক্রয় মৌসুমে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করেছেন মাত্র ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ কৃষক। এ সময় মোট ধান সংগ্রহ করা হয়েছে ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৮৬২ টন, যা ২০১৯ বোরো সংগ্রহ মৌসুমে মোট বোরো ধান উৎপাদনের মাত্র ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। মূলত মধ্যস্বত্বভোগীদের উত্থানের কারণেই ধানের দামে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা। সেজন্য বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের পাশাপাশি মৌসুমের শুরুতে ধানের দাম নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়া সরকারের ধান সংগ্রহ বৃদ্ধি করতে হলে মজুদ সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি মৌসুমের শুরুতেই কৃষকরা যাতে ধান মজুদ বা সংরক্ষণ করতে পারেন, সে ব্যবস্থাও করতে হবে। সে সঙ্গে বাজার তদারকির দায়িত্বে থাকা বিপণন অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করার ওপরও জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও চলতি মৌসুমের বোরো সংগ্রহ কার্যক্রম তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। প্রায় ২০ লাখ টনের বেশি সংগ্রহ লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় সময়সীমা আরো ১৫ দিন বাড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারের সংগ্রহ কার্যক্রমের মূল লক্ষ্যই হলো কৃষকের দাম নিশ্চিত করা এবং সরকারের খাদ্য মজুদ শক্তিশালী অবস্থানে রাখা। আর সরকারের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালিত হয় বোরো মৌসুমে। চলতি বোরো মৌসুমে বাজারে ভালো দাম পাওয়ার কারণে বাজারে তারা বিক্রি করছে। নিজেদের মজুদ রেখে কিছু অংশ সরকারের কাছে বিক্রি করছে। কৃষকরা ন্যায্যমূল্যে যাতে মিলার ও ব্যবসায়ীদের কাছে ধান বিক্রি করতে পারেন, এজন্য সরকারি সংগ্রহ মূল্য মৌসুমের বেশ আগেই জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। এর সুফল এবারের মৌসুমে পাওয়া গেছে। আমরা কৃষকের সর্বোচ্চ ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে সব ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রাখব।

  • দেশে কয়েক বছর ধরেই আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে এসে পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে নিয়মিতভাবে। দেশী ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে পণ্যটির আমদানিতে ভারতের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতাকে। এজন্য পেঁয়াজ আমদানির উৎস বহুমুখীকরণের পাশাপাশি পণ্যটির উৎপাদন বাড়ানো, বিপণন ও তদারকি ব্যবস্থার দুর্বলতা দূর করা, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ঠেকানোসহ বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সরকারি যেসব সংস্থার এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা, সেগুলোর মধ্যকার সমন্বয়হীনতার কারণে এর কোনোটিই এখনো বাস্তবায়ন করা যায়নি। এ সমন্বয়হীনতার কারণে আমদানিতে এক দেশের ওপর নির্ভরশীলতা যেমন কাটানো যায়নি, তেমনি দূর করা যায়নি উৎপাদন বৃদ্ধি ও বিপণনের প্রতিবন্ধকতাগুলোও। বাজার বিশেষজ্ঞরাও পেঁয়াজের বাজারে প্রতি বছর নিয়মিতভাবে সংকট তৈরির পেছনে মূলত সরকারি সংস্থাগুলোর এ সমন্বয়হীনতাকেই দায়ী করছেন। পেঁয়াজের মোট চাহিদার ৭০ শতাংশ উৎপাদন হয় বাংলাদেশেই। তার পরও বাজারে প্রধান প্রভাবক হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারত থেকে আমদানীকৃত পেঁয়াজ। বিষয়টিকে দেশের পেঁয়াজ বাজারের প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে ২০১৩ সালেই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি)। প্রতিবেদনে আমদানিতে ভারতের ওপর অতিনির্ভরশীলতার পাশাপাশি দায়ী করা হয় অক্টোবর ও নভেম্বরে বাজারে সরবরাহ ধরে রাখা নিয়ে সমন্বয়হীনতাকে। উপকরণ সহায়তা ও সমন্বিত নীতির প্রয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে দ্রুত কাজে লাগিয়ে এ সংকটকে সহজেই মোকাবেলা করা সম্ভব বলে মত দেয়া হয় প্রতিবেদনে। এর কয়েক বছরের মাথায় এ সংকট নিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। সেটিতেও আমদানিতে একক দেশ-নির্ভরতার বিষয়টিকে বাজার অস্থিতিশীলতার জন্য দায়ী করা হয়। পাশাপাশি উঠে আসে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণে তদারকির অভাব ও নানা দুর্বলতার কথাও। একই কথার পুনরাবৃত্তি দেখা যায় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে। সমস্যা থেকে উত্তরণে এসব প্রতিবেদনে অত্যাবশ্যকীয় একটি ভোগ্যপণ্য হিসেবে পেঁয়াজের উৎপাদন, বিপণন ও আমদানি-সংক্রান্ত নানা সুপারিশও করা হয়েছে। কিন্তু এসব নীতি-সুপারিশ বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে নীতি-সমন্বয়হীনতার কারণে। ফলে কাটানো যাচ্ছে না পেঁয়াজের বাজার সংকটও। বছরের এ সময় বিশেষ করে আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পেঁয়াজের বাজার মারাত্মক সংকটের মধ্য দিয়ে যায়। ভারত সরকার কোনো কারণে পণ্যটির রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা বা সীমা আরোপ করলেই বাংলাদেশে পেঁয়াজের মূল্য হয়ে ওঠে আকাশচুম্বী। বাজারের এ প্রবণতা সবচেয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে ২০১২ সালের পর থেকে। গত এক দশকে বেশ কয়েকবার পণ্যটির রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ভারত। সর্বশেষ গত বছর এ নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশের বাজারে পেঁয়াজের কেজিপ্রতি দাম ৩০০ টাকায় উঠে যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরবরাহ সংকটের পাশাপাশি বাজার তদারকির অভাব ও ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফার প্রবণতাই ওই সময় পণ্যটির মূল্যকে অস্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। আগের বছরগুলোতেও এ সংকট দেখা গিয়েছিল নানা মাত্রায়। দেশে প্রতি বছর গড়ে ৮-১০ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। পণ্যটির মোট আমদানির ৭৫-৮০ শতাংশই আসছে ভারত থেকে। চীন থেকে আসে ১৫-১৯ শতাংশ। এর বাইরে মিসর, অস্ট্রেলিয়া, মিয়ানমার, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর ও অন্যান্য দেশ থেকে আনা হয় যৎসামান্য পরিমাণে। এ একাধিপত্যের কারণে ভারতে উৎপাদন কমে যাওয়া, শুল্কারোপ, বন্দর জটিলতা ইত্যাদি যেকোনো সমস্যা দেখা দিলেই তা বাংলাদেশে পেঁয়াজের মূল্যে খুব দ্রুত প্রভাব ফেলছে। এ কারণে দ্রুত পণ্যটির আমদানি বাজার বহুমুখী করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, উৎপাদন সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি বিপণন প্রক্রিয়ার সমন্বয় সাধন করা গেলেই এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব ছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব থাকায় তা কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন তথ্য নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উপাত্তে বেশ গরমিল রয়েছে। এ গরমিলের কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য আমদানি-সংক্রান্ত সঠিক ও কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণও বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পণ্যটির উৎপাদন তথ্যের গরমিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) সঙ্গে বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পেঁয়াজের উৎপাদন তথ্যের দূরত্ব কয়েক বছর ধরে ক্রমেই বেড়ে চলেছে। গত কয়েক বছরে সে পার্থক্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন-পাঁচ লাখ টনে। বিবিএসের হিসাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছে ১৮ লাখ টন। ডিএইর হিসাবে তা প্রায় ২৩ লাখ টন। এক্ষেত্রে বৈদেশিক বাণিজ্যের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে এখন পোস্ট হারভেস্ট লস ও অন্যান্য ক্ষতি বাদ দিয়ে বিবিএসের হিসাবের কাছাকাছি তথ্যই গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে উৎপাদন সম্ভাবনা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও মানসম্মত বীজের অভাব। তথ্যমতে, দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে শ্রমিকদের পেছনে, যা মোট উৎপাদন খরচের প্রায় ৩৫ শতাংশ। অন্যদিকে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন ও বিপণনে বেসরকারি খাতকে খুব একটা আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। আবার সরকারিভাবেও বীজ উৎপাদনে খুব বেশি নজর নেই। অথচ এসব বিষয়ে যথাযথ নীতিসহায়তা পেলেই দেশকে পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ম্ভর করে তুলতে পারতেন কৃষকরা। উন্নত জাতের ভালো বীজ কাজে লাগিয়ে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে দেশে। কিন্তু সেখানেও রয়েছে সংকট। দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজ বীজের চাহিদা রয়েছে ১ হাজার ১০০ টন থেকে ১ হাজার ৩০০ টন পর্যন্ত। কিন্তু সরকারিভাবে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) উৎপাদন করে পাঁচ-সাত টন। অন্যদিকে বেসরকারিভাবে প্রধানত কয়েকটি কোম্পানি ৫০-৫৫ টন বীজ উৎপাদন করে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) সাবেক মহাপরিচালক ড. আবুল কালাম আযাদ বণিক বার্তাকে বলেন, পেঁয়াজ এখন রাজনৈতিক পণ্যে পরিণত হয়েছে। ফলে দেশেই উৎপাদনের মাধ্যমে স্বয়ম্ভরতার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে চালের মতো সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। আশার বিষয় হলো দেশে গত কয়েক বছরে যে হারে উৎপাদন বেড়েছে, তাতে ১০-১২ লাখ টনের ঘাটতি খুব সহজে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পূরণ করা সম্ভব। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বীজ সরবরাহ বৃদ্ধি ও কৃষকের কাছে তা পৌঁছাতে হবে। দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় এমন জাত আবাদ জনপ্রিয় করতে হবে। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে আবাদযোগ্য বারি-৫, বারি-২ ও বারি-৩ জাতকে কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় করা যেতে পারে। শীতকালে আবাদ এলাকা বাড়াতে হলে তাহেরপুরী জাতের পাশাপাশি বারি-১ জাতটিরও সম্প্রসারণ করতে হবে। এছাড়া কৃষকের আর্থিক উদ্দীপনা হিসেবে ৪ শতাংশ সুদে যে ঋণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, সেটি প্রকৃত পেঁয়াজ চাষীদের কাছে পৌঁছাতে হবে। পাশাপাশি জাতীয়ভাবে চালের মতো পেঁয়াজের মজুদাগার নির্মাণ বা কৃষক পর্যায়ে সংরক্ষণাগার তৈরিতে নজর বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে ইফপ্রির কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. আখতার আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, চাহিদা যে হারে বাড়ছে ঠিক সে হারে উৎপাদন না বাড়ার কারণেই আমদানি নির্ভরশীলতা থেকে বের হতে পারছে না বাংলাদেশ। পণ্যটির আমদানিতে ভারতের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতার কারণে রফতানিকারক দেশটি দাম বাড়ানোয় সুযোগ নিচ্ছে। অন্যদিকে সরবরাহ সংকট দেখিয়ে দেশের মধ্যস্বত্বভোগীরা দাম বাড়ায়। ফলে একদিকে আমদানি পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগীদের অতিমুনাফার প্রবণতার কারণে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। দেশের বাজারে একটি নির্দিষ্ট সময়েই পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে উৎপাদনে জোর দেয়ার পাশাপাশি অবশ্যই আমদানির বাজার বহুমুখী করতে হবে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে পণ্যটির মজুদ বাড়াতে হবে। বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারি ব্যবস্থাপনা জোরদার করা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের অযৌক্তিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের উদ্যোগ দৃশ্যমান করতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে কৃষকের উন্নত বীজ ও উন্নত প্রযুক্তি সরবরাহ করতে হবে। আবার উৎপাদন মৌসুমে কৃষককে দামের সুরক্ষাও দিতে হবে। তবে আশার আলো দেখাচ্ছে নতুন এক গবেষণার তথ্য। এতে বলা হয়েছে, দেশে আবাদি জমি না বাড়িয়ে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। বিশেষ করে শীতকালে আখের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে আবাদ করা যেতে পারে পণ্যটি। আবার গ্রীষ্মকালে আদা, হলুদ ও মরিচের সঙ্গেও উৎপাদন করা সম্ভব। কৃষকের পণ্যের দামের নিশ্চয়তা দেয়ার পাশাপাশি মজুদ সক্ষমতা বাড়ানো গেলে পেঁয়াজের উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন কয়েক বছরের মধ্যেই সম্ভব। এ বিষয়ে ডিএই মহাপরিচালক ড. মো. আবদুল মুঈদ বলেন, সব ধরনের তথ্যগত বিষয়গুলো সমাধান করা হয়েছে। পোস্ট হারভেস্ট লস বাদ দিয়ে প্রকৃত বা শুকনো পেঁয়াজের উৎপাদনের তথ্য হিসাবে নেয়া হচ্ছে। উৎপাদন বাড়াতে স্থানীয় উন্নত জাত, বিশেষ করে তাহেরপুরী ও ফরিদপুরী জাত সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি নতুন হাইব্রিড বীজ কৃষকের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। কম জমিতে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে আমরা তত্পর। ফসল ওঠার মৌসুমে কৃষক যাতে দাম পায়, সে ব্যবস্থাও আমরা করছি। পাশাপাশি গত মৌসুম থেকে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে ব্যাপক আকারে পেঁয়াজের উৎপাদনে জোর দেয়া হচ্ছে।

  • দেশে তুলার বার্ষিক চাহিদা ৭৩-৭৪ লাখ বেল। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১ লাখ ৭১ হাজার বেল। ফলে চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি থাকা ৭১ লাখ বেল আমদানি করতে হচ্ছে। তুলা আমদানিতে বাংলাদেশের নির্ভরতা ভারতের ওপরই সবচেয়ে বেশি। আমদানি করা তুলার ১৯ শতাংশ বা এক-পঞ্চমাংশ ভারতীয় উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়। তবে আমদানিনির্ভরতা কমাতে ২০৪১ সালের মধ্যে ২০ লাখ বেল তুলা উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে তুলা উন্নয়ন বোর্ড (সিডিবি)। কৃষি মন্ত্রণালয়াধীন প্রতিষ্ঠান সিডিবি সূত্রে জানা গেছে, মাত্র দুই লাখ হেক্টর জমিতে তুলা চাষ করে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। সেজন্য হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ১০ বেলে উন্নীত করতে হবে। বাংলাদেশে গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ছিল ৬ দশমিক ১৫ বেল, যেখানে বিশ্বের শীর্ষ তুলা উৎপাদনকারী দেশগুলোয় হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ১০ বেলের ওপরে। ২০১৯-২০ অর্থবছর দেশে ৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে তুলা চাষ হয়েছে। এ সময় তুলা উৎপাদন হয় ১ লাখ ৭১ হাজার বেল। সম্প্রতি তুলা উন্নয়ন বোর্ডের হাইব্রিড উন্নত জাতের তুলা উদ্ভাবন ও চাষের ফলে দেশে উৎপাদন বাড়ছে। অন্যদিকে চাহিদার তুলনায় উৎপাদনের ঘাটতিতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ তুলা আমদানি করতে হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানি করতে হয়েছে ৭১ লাখ বেল তুলা। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরটিতে মোট তুলা আমদানির মধ্যে ভারত থেকে ১৯ শতাংশ, মালি থেকে ১৩, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১২, ব্রাজিল ও বেনিন থেকে ১০ শতাংশ করে সংগ্রহ করা হয়েছে। বিশ্ব তুলা দিবস ২০২০ উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার রাতে আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারের আয়োজন করে সিডিবি। এতে তুলা উৎপাদন ও আমদানির বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন সিডিবির নির্বাহী পরিচালক মো. ফরিদ উদ্দিন। ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক এমপি বলেন, তুলা উৎপাদনের ওপর সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকার সব দিক দিয়ে তুলা উন্নয়ন বোর্ডকে শক্তিশালী করছে। সম্প্রতি তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। ভৌত অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, ল্যাবরেটরি স্থাপন ও দক্ষ মেধাবী জনবল নিয়োগ করছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপযোগী নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে তুলা উৎপাদন ত্বরান্বিত ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়। সিডিবি পরিচালক মো. ফরিদ উদ্দিনের সভাপতিত্বে ইন্টারন্যাশনাল কটন অ্যাডভাইজরি কমিটির নির্বাহী পরিচালক কাই হিউজেস, খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি রবার্ট ডি. সিম্পসন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান এসএম বখতিয়ার, মিসরের কটন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আল সাইদ নেগম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইন্টারন্যাশনাল কটন অ্যাডভাইজরি কমিটির টেকনিক্যাল ইনফরমেশনের হেড কেশব ক্রান্তি ও সিডিবির নির্বাহী পরিচালক মো. ফরিদ উদ্দিন। দেশে তুলা চাষ সম্প্রসারণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগ্রহে ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হয়। তুলা গবেষণা, তুলা চাষ সম্প্রসারণ, বীজ উৎপাদন ও বিতরণ প্রভৃতি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে আসছে সংস্থাটি। খাদ্য উৎপাদনে কোনো বিঘ্ন না ঘটিয়ে তুলা চাষ সম্প্রসারণের জন্য তুলা উন্নয়ন বোর্ড তামাক ও কৃষি বনায়ন জমিতে, লবণাক্ত, চর ও পাহাড়ি এলাকার মতো অপ্রচলিত বিভিন্ন অঞ্চলে তুলা চাষ সম্প্রসারণ করছে।

  • চাল উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে বেশ প্রশংসা পেয়েছে। সরকারি তথ্যে দৈনিক জনপ্রতি যে ভোগ দেখানো হচ্ছে তাতে প্রতি বছর ৫০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু উদ্বৃত্ত তো থাকছেই না, উল্টো আমদানি করে ঘাটতি মেটাতে হচ্ছে। এ ঘাটতি আরো তীব্র হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) মনে করে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দৈনিক জনপ্রতি চাল ভোগের যে তথ্য দিয়েছে তাতে বাংলাদেশর জনগণের ভোগের সঠিক চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে না। বিবিএসের তথ্যে জনপ্রতি চাল ভোগের যে পরিমাণ উঠে এসেছে তার সঙ্গে বেশ পার্থক্য রয়েছে ইফপ্রি ও বিআইডিএসের তথ্যের। একজন মানুষ দৈনিক কত গ্রাম চাল ভোগ করে তা নিয়ে একটি জরিপ করেছিল ইফপ্রি। সেই জরিপে তারা দেখিয়েছিল, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে দৈনিক জনপ্রতি চাল ভোগের পরিমাণ ছিল ৩৯৬ দশমিক ৬ গ্রাম, যা ২০১৬ সালেও ছিল ৪২৬ গ্রাম। অন্যদিকে ২০১৬ সালে দৈনিক জনপ্রতি চাল ভোগের পরিমাণ ৪৬০ গ্রাম ছিল বলে তথ্য দিয়েছে বিআইডিএস। যদিও একই বছরে দৈনিক জনপ্রতি চাল ভোগের হিসাব ৩৬৭ গ্রাম দেখানো হয়েছে বিবিএসের সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে। তিন সংস্থার তথ্যের তুলনা করলে দেখা যায়, জনপ্রতি চাল ভোগের পরিমাণ ইফপ্রির চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ এবং বিআইডিএসের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ কম বলে উঠে এসেছে বিবিএসের তথ্যে। চালের মজুদ নিয়ে সঠিক পরিকল্পনার জন্য জনপ্রতি ভোগের সঠিক তথ্য থাকা জরুরি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ভোগের তথ্য অনুযায়ীই চালের চাহিদা নিরূপণ ও মজুদের পরিকল্পনা করা হয়। এক্ষেত্রে সঠিক তথ্য না থাকলে এর প্রভাব গিয়ে পড়ে মজুদ  এবং সর্বোপরি বাজারের ওপর। সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলে সুন্দরভাবে লিখিত পরিকল্পনাও বাস্তবায়নে গলদ দেখা দিতে পারে বলে মনে করেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম। বণিক বার্তাকে  তিনি বলেন, জনপ্রতি চালের যে ভোগ দেখানো হচ্ছে তাতে উৎপাদনের তথ্যের সঙ্গে ন্যূনতম ৫০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু বাজারের তথ্য সেটি বলছে না। উৎপাদন কিংবা ভোগের তথ্যেও গরমিল রয়েছে। বাজার তথ্যের সঙ্গে আমাদের প্রকাশিত সব তথ্যের মিল থাকা প্রয়োজন। তা না হলে নীতি প্রণয়নে, বিশেষ করে চাল আমদানি কিংবা রফতানির বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া মুশকিল হয়ে পড়বে। চাল উৎপাদন ও ভোগের তথ্যের ক্ষেত্রে কোনো বিষয়ে পর্যালোচনার প্রয়োজন মনে করলে সেটি বিবেচনায় নিতে হবে। তা না হলে চাল আমদানির বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে না। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে  দেশে দৈনিক জনপ্রতি চাল ভোগের পরিমাণ ছিল ৪১৬ গ্রাম এবং সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ২০১৬ সালে তা ছিল ৩৬৭ দশমিক ২ গ্রাম। এ সময় জনপ্রতি ভোগের পরিমাণ গ্রামে প্রায় ৩৮৬ গ্রাম ও শহরে প্রায় ৩১৭ গ্রাম ছিল। অন্যদিকে ইফপ্রির জরিপের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ২০১৮ সালে দৈনিক জনপ্রতি চাল ভোগের পরিমাণ ৩৯৬ দশমিক ৬ গ্রামে নেমে এসেছে।  যদিও তা ২০১২ সালে প্রায় ৪৬৭ গ্রাম এবং ২০১৬ সালে ছিল প্রায় ৪২৬ গ্রাম। শহর ও গ্রামে জনপ্রতি চাল ভোগের পরিমাণে কম-বেশি পার্থক্য রয়েছে বলে জানিয়েছে ইফপ্রি। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে  গ্রামের মানুষ জনপ্রতি দৈনিক ৪১৭ গ্রাম করে চাল ভোগ করেছে, অন্যদিকে শহরের মানুষ ভোগ করেছে জনপ্রতি ৩৪২ গ্রাম। এ জরিপে ইফপ্রি একজন মানুষ নিজ বাড়িতে ও বাড়ির বাইরে যে খাবার গ্রহণ করে সে তথ্যও বিবেচনায় নিয়েছে। যেমন গ্রামের একজন মানুষ বাড়ির বাইরে দৈনিক গড়ে ১৫ গ্রাম খাবার গ্রহণ করছে, আর নিজ বাড়িতে গ্রহণ করছে ৪০২ গ্রাম। ইফপ্রি বলছে, আগামীতে জনপ্রতি চাল ভোগের পরিমাণ আরো কমে আসবে। সঠিক ভোগের তথ্য বিবেচনায় নিলে আমদানির বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে। সঠিক ও নিরাপদ পরিকল্পনার জন্য জনপ্রতি ভোগ ৪৮৯ গ্রামকে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। বাংলাদেশে ইফপ্রির কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. আখতার আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, পদ্ধতিগত কারণে ভোগের তথ্যের পার্থক্য হতে পারে। জনপ্রতি ভোগের তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ‘সাপ্তাহিক’ ও ‘২৪ ঘণ্টার’—এ দুটো জনপ্রিয় পদ্ধতি বিবেচনায় নেয়া হয়। আমরা ভোগের সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য একজন ভোক্তার ২৪ ঘণ্টার খাবারের তথ্য হিসাব করি। সে কখন কী পরিমাণে কী কী ধরনের খাবার গ্রহণ করছে সেটি লিপিবদ্ধ করি। এ পদ্ধতিটা বেশ ব্যয়বহুল হলেও সঠিক পরিমাণটা পাওয়া যায়। কিন্তু অন্য পদ্ধতিতে পরিমাণ কম-বেশি (ওভার কিংবা আন্ডারএস্টিমেট) হওয়ার ঝুঁকি থাকে। জনপ্রতি ভোগের বাইরে চালের আরো বেশকিছু ভোগ রয়েছে। বিশেষ করে প্রাণী খাদ্য হিসেবে চালের কয়েক লাখ টন ভোগ করা হয়। এছাড়া ধান-চাল উৎপাদনের তথ্যটি সাধারণত মাঠ পর্যায়ের হিসাব করা হয়। মাঠের ধান থেকে ভোক্তা পর্যায়ে চাল হয়ে আসতে নানা মাত্রায় পোস্ট ও প্রি-হারভেস্ট লস হয়। সেই ক্ষতির পরিমাণ ৮-১০ শতাংশ পর্যন্ত হয়। এজন্য উৎপাদন ও ভোগ সব ক্ষেত্রেই সঠিক তথ্য থাকাটা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, চাল অত্যন্ত সংবেদনশীল কৃষিপণ্য। এ কারণে এটির ভোগ ও উৎপাদনের সঠিক তথ্য থাকা প্রয়োজন। পাশাপাশি জনসংখ্যার তথ্যটিও সঠিকভাবে আসা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা দেখছি, এ তিনটি তথ্যের ক্ষেত্রে বেশ ঘাটতি রয়েছে। চালের জনপ্রতি ভোগ ও জনসংখ্যার তথ্য বিবেচনায় নিলে চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু উদ্বৃত্ত থাকছে না, উল্টো মাঝে মধ্যে বেসরকারিভাবে চাল আমদানি হচ্ছে। আমরা চাল উৎপাদনে বৈশ্বিকভাবে শীর্ষ তিনে অবস্থান করছি এবং সরকারিভাবে চাল আমদানি গত কয়েক বছর বন্ধই রয়েছে। তার পরও ভোগের তথ্যের সঙ্গে উৎপাদনের তথ্যের এ গরমিল কমানোর জন্য পর্যালোচনার দাবি রাখে। হিসাব করার ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়াতে হবে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ফুড প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিটকে (এফপিএমইউ) আরো শক্তিশালী করতে হবে। না হলে কার্যকর মনিটরিং ছাড়াও সঠিক তথ্য ও নীতি গ্রহণ করা দুষ্কর হয়ে পড়বে।

To Top