হিলি স্থলবন্দর সূত্রে জানা গেছে, আগের বছরগুলোর মতো চলতি বছরেও হিলি বন্দর দিয়ে প্রতি মাসে ভারত থেকে কমবেশি পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে ২৬৪ ট্রাকে প্রায় সাত হাজার ৬৩১ টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয় এই বন্দর দিয়ে। আর চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১৩৫ ট্রাকে তিন হাজার ৯৫১ টন এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ২৩২ ট্রাকে ছয় হাজার ৯৫১ টন পেঁয়াজ আনা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগের সময়ের চেয়ে এ বন্দর দিয়ে এই তিন মাসে পেঁয়াজ আমদানি বাড়তির দিকেই রয়েছে।
এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, উৎপাদনের মৌসুমে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ুপেঁয়াজ আমদানিতে উচ্চ শুল্কহার বসাতে হবে। এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অবশ্যই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে। গত কয়েক বছরের পরিকল্পনায় পেঁয়াজের উৎপাদন এখন বাড়ছে। এটি ধরে রাখতে হলে কৃষকের সুরক্ষা দিতে হবে। আবার ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় অমৌসুমে আমদানির অনুমতি দিতে হবে। প্রতি কেজির দাম ৩০ টাকার নিচে নামলে কৃষক খুশি হয় না। এ জন্য ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করে কৃষকের সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।
কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রমজানের চাহিদা বিবেচনায় এবারে আমদানিতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য ভর্তুকি সহায়তা ও উপকরণ সহায়তা বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি ভালো ফলনের জন্য উন্নত বীজ দেওয়া হয়েছে। সংরক্ষণ সুবিধা বাড়ানো হয়েছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) তথ্য মতে, রাজধানীর বাজারসহ সারা দেশেই পেঁয়াজের দাম এখন নিম্নমুখী। মৌসুমের শুরুতে দাম নিম্নমুখী হওয়ার কারণে কৃষকরা উদ্বিগ্ন। রাজধানীর বাজারে এক বছরের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কমেছে প্রায় ৩২ শতাংশ। অন্যদিকে কৃষক পর্যায়ে এই পণ্যের দাম আরো কমেছে। গত বছরের তুলনায় প্রতি মণে পেঁয়াজের দাম কমেছে প্রায় ১০০ টাকা।
গত বুধবার রাজধানীর খুচরা বাজারগুলোতে গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়েছে। এক সপ্তাহ ধরেই এই দাম। এক মাসের ব্যবধানে প্রায় ১৩ শতাংশ দাম কমেছে। এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ৩২ শতাংশ।
অন্যদিকে আমদানীকৃত বিদেশি পেঁয়াজের দামও কমতির দিকে। বর্তমানে বিদেশি আমদানি পেঁয়াজের দাম ৩৫ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগে যা ছিল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে দাম প্রায় ১২ শতাংশ কমেছে। এক বছরের ব্যবধানে আমদানি পেঁয়াজের দাম কমেছে ২১ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বছরে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল ২২ লাখ ৬৯ হাজার টন, যা দুই অর্থবছর আগেও ছিল ১৮ লাখ টন। আর পণ্যটির চাহিদা ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন। ঘাটতি পেঁয়াজ ভারত, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়।
দেশের পেঁয়াজের বেশির ভাগই উৎপন্ন হচ্ছে তিন জেলায়। পাবনা, রাজবাড়ী ও ফরিদপুর জেলায়। কয়েক বছর ধরেই এই তিন জেলায় দেশের প্রায় ৬০ শতাংশের বেশি উৎপন্ন হচ্ছে।
রাজবাড়ী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, পেঁয়াজ আবাদের জন্য চরাঞ্চল সবচেয়ে উত্তম। দেশের গড় পেঁয়াজ উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে রয়েছে রাজবাড়ী জেলা। লাল তীর, বারী-১ ও বারী-৪ জাতের পেঁয়াজ এ জেলায় অধিক আবাদ হয়। বিগত বছর এ জেলায় ৩৪ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে উৎপন্ন হয়েছিল চার লাখ ৩৭ হাজার ৯২৫ টন। চলতি মৌসুমে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে ৩৪ হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে, যা বিগত বছরের চেয়ে ১১০ হেক্টর জমি বেশি। এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা চার লাখ ৩৯ হাজার টন পেঁয়াজ। জেলার বালিয়াকান্দিতে কিছু কৃষক বীজ কিনে প্রতারিত হয়েছেন। তবে এতে উৎপাদন খুব সামান্য ব্যাহত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কৃষি প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
ফরিদপুরের সালথা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ জীবাংশু দাস কালের কণ্ঠকে বলেন, সালথায় প্রায় দেড় লাখ টন পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়েছে। এবার ১০ হাজার ৯৭০ হেক্টর জমিতে হালি পেঁয়াজ চাষ করা হয়েছে। ফলনও আশানুরূপ হবে বলে প্রত্যাশা করি। ১৩০ হেক্টর জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবদ হয়েছে। কিন্তু দাম না পেয়ে চিন্তিত কৃষকরা। তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পেলে পেঁয়াজ চাষে আরো আগ্রহী হয়ে উঠবে। এতে উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে স্থানীয় চাহিদা মেটানো এবং আমদানি ব্যয় কমাতে সহায়ক হবে।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন কালের কণ্ঠ রাজবাড়ী প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর হোসেন ও ফরিদপুর (সালথা-নগরকান্দা) প্রতিনিধি নুরুল ইসলাম এবং হিলি প্রতিনিধি গোলাম মোস্তাফিজার রহমান মিলন।