ওজন কারচুপিতে কৃষকের ক্ষতি ৩৫ হাজার কোটি টাকা

November 18, 2025 0 Comments

সাহানোয়ার সাইদ শাহীন :

দেশের সবজি উৎপাদনকারী জেলা হিসেবে গত কয়েক দশক সুনাম কুড়িয়েছে যশোর। সবজির অর্থনীতির মাধ্যমে বিকশিত হওয়া জেলাটির কৃষকদের জন্য সবচেয়ে বড় বাজার হলো সদর উপজেলার সাতমাইল বাজার। এখানে প্রতি বৃহস্পতিবার ও রবিবার কৃষকরা তাঁদের পণ্য বিক্রি করতে পারেন। প্রতি হাটবারে সাত থেকে ১০ টন সবজি বেচাকেনা হয় এখানে।

 

সেই বাজারে গত ১৯ ডিসেম্বর কৃষকদের সঙ্গে ওজন কারচুপির সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ করেন এই প্রতিবেদক।
সেদিন এই বাজারে সবজি বিক্রি করতে এসেছিলেন কৃষক শুকুর আলী। ফসলের ক্ষেত থেকে ওজন দিয়ে ৭৩ কেজি শিম নিয়ে তিনি বাজারে এসেছিলেন। বাজারে বিক্রির সময় সেই শিম হয়ে যায় ৭১ কেজি।

৭৩ কেজি শিম বাজারে আনলেও তিনি দাম পান ৬৪ কেজির। ২০ টাকা কেজি দরে শিম বিক্রি করে শুকুর আলী পান এক হাজার ২৮০ টাকা। সঠিকভাবে ওজন পরিমাপ করা হলে তিনি পেতেন এক হাজার ৪৬০ টাকা। ফলে তিনি পরিমাপে বঞ্চিত ৯ কেজি আর অর্থের অঙ্কে ১৮০ টাকা।

 

বাজারেই আলাপ হয় শুকুর আলীর সঙ্গে। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওই কডা মালে (স্বল্প পরিমাণ সবজিতে) ঢল মারা বা ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের ক্ষতি পোষানোর জন্য সাত কেজির দাম কেটে রাখল। আমরা কেউ কিছু বলতে পারি না। বাড়ি থেকে ওজন দিয়ে যা আনলাম সেটিও এখানে সঠিক হয় না। আমাগের (আমাদের) ছোট কৃষকদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই।

আমরা যাব কনে (কোথায়)? কৃষক বাঁচবি কিরাম (কেমন) করে? বাজারে একটা নিরপেক্ষ লোকের (কর্তৃপক্ষ বোঝাতে চেয়েছেন) মাধ্যমে সুষ্ঠু ওজন প্রথার ব্যবস্থা করলে খুব ভালো হতো। এতে ছোট কৃষকরা ঠকত না।’
ওই বাজারে অপেক্ষাকৃত একটু বড় ও প্রভাবশালী কৃষক মো. রবিউল ইসলাম ১০ মণ করে মুলা ও বেগুন বিক্রি করলেন। প্রতি মণ মুলা বিক্রিতে তাঁকে ১০ কেজি বেশি দিতে হয়েছে। আর বেগুনে পাঁচ কেজি বেশি দিতে হয়েছে। ২০ মণ সবজি বিক্রি করে তাঁকে ১৫০ কেজি বেশি দিতে হয়েছে। সব মিলিয়ে তাঁকে দুই হাজার টাকা ঠকানো হয়েছে। আবার গত সপ্তাহের তুলনায় এ দুটি পণ্যে তিনি ২০ শতাংশ কম দাম পেয়েছেন।

 

মো. রবিউল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা দামে ঠকছি (ক্ষতিগ্রস্ত), ওজনেও ঠকছি। কৃষিপণ্যের বাজারে এই প্রতারণা নানাভাবে হচ্ছে। আমরা যারা একটু খোঁজখবর রাখতে পারি তারা প্রতি মণ সবজি বিক্রি করতে একটু কম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। কিন্তু ছোট কৃষকদের ওপর চড়াও হয় ব্যবসায়ীরা। বাজারে আপনি ১০ কেজির মাল (পণ্য) বিক্রি করতে পারবেন না। বাজারে মূল প্রতিবন্ধকতা হলো কৃষক সরাসরি ক্রেতার কাছে মাল (কৃষিপণ্য) বিক্রি করতে পারে না। এই ছোট্ট একটু বাজারে দু-তিন ধরনের দালাল থাকে। ফলে সেখানে প্রতারিত ও বঞ্চিত হয় কৃষক।’

এই প্রতারণার চিত্র শুধু যশোরেই নয়, সারা দেশের চিত্র এটি। যশোর ছাড়াও চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ জেলার বেশ কিছু বাজারে সরেজমিন তথ্য সংগ্রহকালে একই চিত্র পাওয়া গেছে। কৃৃষকদের সঙ্গে ওজন প্রতারণা ও কারচুপি এখন ওপেন সিক্রেট। কৃষকের কাছ থেকে বিভিন্ন সবজি কেনার সময় ঘোষণা দিয়ে মণপ্রতি পাঁচ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত কমিয়ে রাখা হয়। আবার দানাদার খাদ্যশস্য, বিশেষ করে ধান, গম ও ভুট্টার ক্ষেত্রে মণপ্রতি দু-তিন কেজি পর্যন্ত কমিয়ে রাখা হয়। এর বাইরে আবার কারচুপির মাধ্যমে কৃষকদের ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে। কৃষক পর্যায়ে ওজন প্রতারণা ও কারচুপি যেন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে।

 

কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজারে কৃষকরা যেসব পণ্য বিক্রি করছেন, সেই বিক্রির সময় যে হারে ওজন কম দেওয়া হচ্ছে তার ন্যূনতম মূল্য হিসাবে নিলেও কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। বাজারেই কৃষকের রক্ত চুষে নিচ্ছে এক শ্রেণির ফড়িয়া ও দালাল। তবে বাজারে এই ধরনের প্রতারণামূলক কার্যক্রম প্রতিরোধ বা তদারকিতে নেই সরকারি কোনো পদক্ষেপ। তাই এ বিষয়ে কার্যকর প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে সুপারিশ করেছেন কৃষি খাত বিশেষজ্ঞরা।

 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সাবেক সহসভাপতি ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এস এম গোলাম হাফিজ কেনেডি কালের কণ্ঠকে বলেন, বাজারে যেভাবে প্রতারণা হচ্ছে সেটা তো ভয়ংকর। কোনোভাবেই এই জালিয়াতি আর বাড়তে দেওয়া ঠিক হবে না। জরুরি ভিত্তিতে অবৈধ এই সিন্ডিকেট প্রথা ভাঙতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে (ডিএএম) যৌথভাবে কাজ করতে হবে। দেশের প্রতিটি বাজারে কৃষি কর্মকর্তার নেতৃত্বে কৃষিপণ্য ওজন দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেখান থেকে ওজন দিয়ে কৃষকের পণ্য বিক্রি করার ব্যবস্থা করতে হবে। এমনিতেই পণ্যের দামের ওপর মুনাফা করেন পাইকার ও ব্যাপারীরা। আবার ওজন প্রতারণা করেও তাঁরা বাড়তি মুনাফা করছেন। এটা সরকারি নিয়ম-নীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো। কৃষকের বাজারে এই ধরনের প্রতারণা থামাতে না পারলে কৃষক শস্য উৎপাদনে নিরুৎসাহ হবেন। এতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ভেঙে পড়বে।

 

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ধান, গম, ভুট্টা, আলু, পাট, তেলজাতীয় শস্য, ডাল, মসলা, মরিচ, পেঁয়াজ, তামাক, চা, বিভিন্ন ধরনের সবজি, টমেটো, মিষ্টি আলু, আখ ও ফলজাতীয় বিভিন্ন পণ্য নানাভাবে কৃষক স্থানীয় বাজারগুলোতে বিক্রি করেন। দেশে এসব কৃষিপণ্যের উৎপাদন ছাড়িয়েছে ১০ কোটি টন। এর মধ্যে ধানের উৎপাদন প্রায় ছয় কোটি টন। আলুর উৎপাদন এক কোটি টন; গম ও ভুট্টার উৎপাদন ছাড়িয়েছে অর্ধকোটি টন। সবজি ও ফলের উৎপাদন এক কোটি টন। এসব ফসল বাজারে বিক্রি করতে গেলে কৃষক নানাভাবে ওজন প্রতারণা ও কারচুপির শিকার হচ্ছেন।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তবে আখ ও পাটজাতীয় কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে কিছুটা ন্যায্য ওজন পাচ্ছেন কৃষক। সুগার মিলের মাধ্যমে স্থানীয় আখ সেন্টারে আখ কেনা হয়। ফলে সেখানে ওজনে প্রতারণার সুযোগ এখনো খুব কম। এই মডেল অন্য সব কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারলে কৃষকের আর্থিক ক্ষতি কমে আসতে পারে। এখন যে হারে কৃষকের সঙ্গে ওজন প্রতারণা করা হচ্ছে তাতে কৃষকের ন্যূনতম ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এ অবস্থায় দেশের প্রতিটি বাজারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির মাধ্যমে ওজন প্রক্রিয়া করার বিষয়টি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।

 

এ বিষয়ে কৃষিসচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ‘ওজন কারচুপির বিষয়টা আমরা মাঠ পর্যায় থেকে জানতে পারছি। এত বড় পরিসরে হচ্ছে কি না তা আমরা খতিয়ে দেখব। এ বিষয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা নীতিগতভাবে এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেব। কৃষিপণ্য বিক্রি করতে গিয়ে কোনোভাবেই কৃষক যাতে বঞ্চিত না হয় সে জন্য সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

Leave A Comment

To Top