লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে নতুন বনায়ন

November 12, 2025 0 Comments
সাহানেয়োর সাইদ শাহীন   কক্সবাজারের রামু উপজেলার রাজারকুল রেঞ্জের অধীন প্রায় এক হাজার হেক্টর পাহাড়ি বনায়ন রয়েছে। কয়েক বছর আগেই এই রেঞ্জের সদর বিট বন এলাকায় ১০০ হেক্টরের বেশি জমির পুরোটাই বৃক্ষহীন করে ফেলে স্থানীয় লোকজন ও বনদস্যুরা। সেই স্থানে এখন দেশীয় বিরল প্রজাতির গাছ রোপণ করা হয়েছে। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে গাছগুলো। ফিরছে বিপন্ন ৮ প্রজাতির গাছএই বাগানটি সরেজমিন পরিদর্শনকালে আলাপ হয় কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নুরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই বনের বৈশিষ্ট্য হলো—শত হেক্টরে শত প্রজাতির গাছ রয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি দেশীয় বিরল প্রজাতির গাছ ফিরিয়ে আনতে। এ জন্য বিরল প্রজাতির প্রায় সব গাছই এই বাগানে রয়েছে। এ ছাড়া সবচেয়ে দামি কাঠ হিসেবে পরিচিত লাল চন্দনগাছও লাগানো হয়েছে। সেগুলো বেশ দ্রুত বাড়ছে।’ একই উপজেলার জোয়ারিয়ানালা রেঞ্জের বনটি একসময় বেশ সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু এই বনের প্রায় ৫০ হেক্টর জমি বৃক্ষহীন ছিল। সম্প্রতি বৃক্ষশূন্য এই জায়গা ছাড়া অন্যান্য স্থানে বনায়নের উদ্যোগ নেয় বন বিভাগ। ওই বাগানে প্রায় ৩৬২ হেক্টর জমিতে নতুন বাগান সৃজন করা হয়েছে। ৩০ প্রজাতির দেশীয় ও দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষে বনটি এখন পরিপূর্ণতার পথে। এ বিষয়ে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মারুফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, আমলকী, বহেড়া, হরীতকী, চিকরাশি, অর্জুন, কাঞ্জলভাদি, জারুল, পিতরাজ, সোনালু, তেঁতুল, রক্তচন্দন, জলপাই, পিটালি, শিমুলসহ দেশীয় প্রজাতির দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। চারা উত্তোলন, বাগান এলাকার জঙ্গল কাটা, বাগানে চারা রোপণ ও আগাছা পরিষ্কারকাজে স্থানীয় দরিদ্র মানুষের ব্যাপক কর্মসংস্থান হচ্ছে। বন বিভাগ স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় সৃজিত বাগান রক্ষার কাজ করে যাচ্ছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির বন সংরক্ষণে কাজ করেছে বন অধিদপ্তরের ‘টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল)’ প্রকল্প। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৬১ হাজার ১০৫ হেক্টর অবক্ষয়িত পাহাড়ি ও শাল বন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বৃক্ষশূন্য পাহাড়ি ও সমতল বনভূমির বনাঞ্চলে বিভিন্ন পদ্ধতিতে বনাচ্ছাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বনাঞ্চল পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ ছাড়া ৪২ হাজার ৮৫৫ হেক্টর নতুন জেগে ওঠা চরে সবুজ বেষ্টনী তৈরির জন্য উপকূলীয় এলাকায় নতুন বাগান সৃজন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশে বন পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও নতুন বনায়ন হয়েছে এক লাখ তিন হাজার ৯৬০ হাজার হেক্টর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় অর্থনীতি এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। একটি দেশে স্বাভাবিক বনভূমি হতে হবে মোট আয়তনের প্রায় ২৫ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি অনেক কম। দেশে এক শতাংশ বনভূমি বাড়াতে গেলে ৮০ থেকে ৮৫ হাজার হেক্টর জমিতে গাছ লাগাতে হবে। তাই নতুন সৃজিত এক লাখ চার হাজার হেক্টর বনায়নের মাধ্যমে দেশের সার্বিক বনভূমি এক শতাংশের বেশি বাড়বে। বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা শুধু নতুন বাগান বা বন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেই থেমে নেই। এসব বাগান সুরক্ষায় সর্বোচ্চ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে। বনের কাঠের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোকে বিকল্প জীবিকায়ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া নতুন ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা বনায়ন এখন ডিজিটালের আওতায় আনা হয়েছে। বন এলাকায় সাইট স্পেসিফিকেশন প্ল্যান (এসএসপি) পরিচালনা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কোথায় কী পরিমাণ বন রয়েছে সেটি ঘরে বসেই পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে। বনের তথ্য স্যাটেলাইট ইমেজের মাধ্যমে তদারকির কারণে সঠিক তথ্য মিলছে। এ ছাড়া দেশে গত কয়েক বছরে চার হাজার ৮২৬ কিমি স্ট্রিপ বাগান সৃজন সম্পন্ন হয়েছে। এর মাধ্যমে আগামী ৪০ বছরে মোট তিন কোটি ৩০ লাখ টন কার্বন অপসারণ করা সম্ভব হবে। ফলে কার্বন বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়বে। ফিরছে বিপন্ন আট প্রজাতির গাছ : এই প্রকল্পের মাধ্যমে আটটি বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের টিস্যু কালচার প্রটোকল প্রণয়ন করা হয়েছে। এসব উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে বৈলাম, চন্দন, রক্তচন্দন, হলদু, সাদা গর্জন, সিধা জারুল, পাদক ও রিঠা। এর মাধ্যমে দেশে এসব গাছের চারা রোপণ করা সম্ভব হচ্ছে। খুব শিগগিরই এসব গাছ সারা দেশে ব্যাপক আকারে আবার ফিরে আসবে। এ বিষয়ে বন অধিদপ্তরের উপপ্রধান বন সংরক্ষক ও সুফল প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক গোবিন্দ রায় বলেন, বিপন্ন প্রজাতির গাছ ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের বিদ্যমান এক হাজার উদ্ভিদের লাল তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। ফলে দেশে কোন উদ্ভিদ কী পরিমাণে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, সেটি নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে। এই তালিকায় পাঁচ প্রজাতির গাছ অতিবিপন্ন পর্যায়ে রয়েছে। এসব গাছের মধ্যে রয়েছে বাঁশপাতা, চাল মুগুর, বন খেজুর ও সুন্দরবনের দুটি অর্কিড গাছ। আবার বন রক্ষায় তরুণদের ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। ‘আজকের তারুণ্য বাঁচাবে অরণ্য’—এই উদ্দীপনা নিয়ে বন সংরক্ষণে কাজ করছে। এ বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোর প্রয়োজনে বনভূমি প্রতিনিয়ত বেদখল হচ্ছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জবরদখলের প্রবণতা রোধে বনভূমি জরিপ ও সীমানা নির্ধারণ করা আবশ্যক। বনজ সম্পদের সরবরাহ ও চাহিদার সঠিক ও হালনাগাদ তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ জরিপ হওয়া জরুরি। মনে রাখতে হবে, বাস্তুতন্ত্রের উপাদানগুলো একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই বনের কোনো উপাদানের বিলুপ্তি বা সংখ্যা হ্রাস পরিবেশের ভারসাম্য ক্ষুণ্ন করে। বন সুরক্ষায় বন বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামো যুগোপযোগী করে পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগের মাধ্যমে বন বিভাগের দক্ষতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

Leave A Comment

To Top