সাহানোয়ার সাইদ শাহীন :
সদ্যোবিদায়ি অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ চাল আমদানির পরও বাজারে প্রভাব পড়ছে না। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ১৩ লাখ পাঁচ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়েছে। এই সময়ে ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চাল ও গম আমদানি হয়। গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এই দুটি পণ্য আমদানিতে ব্যয় ছাড়িয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা।
তার পরও চালের দাম কমছে না। অথচ গত কয়েক বছর চালের আমদানি ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ চাল-গম আমদানি হয়েছিল ২০১৭-১৮ অর্থবছরে—৯৭ লাখ ৭৪ হাজার টন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমদানি হয় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে।
এই সময়ে আমদানি ছাড়িয়েছে ৭৫ লাখ ৪০ হাজার টন। এর মধ্যে গম আমদানি হয়েছে ৬২ লাখ ৩৫ হাজার টন। গমের বেশির ভাগই বেসরকারিভাবে আমদানি করা হয়েছে।
মোট চাল আমদানির মধ্যে আট লাখ ৩৫ হাজার টন সরকারিভাবে এবং চার লাখ ৬৯ হাজার ৪৬০ টন বেসরকারিভাবে আমদানি করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি ছিল ৬৬ লাখ ২৮ হাজার টন, যার পুরোটাই ছিল গম। ওই অর্থবছরে চাল আমদানি হয়নি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২ জুলাই মাঝারি মানের সিদ্ধ (ব্রি ধান-২৮, ব্রি ধান-২৯, বিআর-২৩ ইত্যাদি) চালের দাম পাইকারিতে ৫১-৫৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। খুচরা বাজারে তা ৫৫-৫৮ টাকায় বিক্রি হয়। যদিও খোলাবাজারে এই দামের সঙ্গে বেশ পার্থক্য রয়েছে।
অন্যদিকে পাইকারি বাজারে খোলা আটা বিক্রি হয়েছে ৩৪-৩৫ টাকায়। খুচরা বাজারে খোলা আটা বিক্রি হয় ৪০-৪২ টাকায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত অর্থবছরের পুরো সময়ের আমদানি ব্যয়ের হিসাব চূড়ান্ত করতে পারেনি। তবে অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এই দুটি পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ২০ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আমদানি ব্যয় হয়েছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। সেই সময় এ দুটি পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ২৪ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা। বিদায়ি অর্থবছরের শেষ দুই মাসের হিসাব চূড়ান্ত হলে আমদানি ব্যয় সর্বকালের রেকর্ডও হতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরের তুলনায় আউশ ও আমনের উৎপাদন কমেছে প্রায় তিন লাখ ২১ হাজার টন। এর মধ্যে আউশের উৎপাদন ৬ শতাংশ কমেছে। এখনো বোরোর উৎপাদনের হিসাব চূড়ান্ত না হলেও বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন কমতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ। ফলে গত অর্থবছর হবে সার্বিকভাবে চালের উৎপাদন কমার বছর।
গত অর্থবছরে আমনের উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৬৫ লাখ টন। অন্যদিকে আউশের উৎপাদন হয়েছে ২৭ লাখ ৯৩ হাজার টন। ফলে চালের আমদানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প ছিল না। এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চাল আমদানি হয়েছে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে—১৪ লাখ ৯০ হাজার টন। তবে গত অর্থবছরে ১৩ লাখ টনের বেশি চাল আমদানি করেও বাজারে প্রভাব রাখা যাচ্ছে না।
বেসরকারিভাবে চাল ও গম আমদানি কিছুটা ধীর থাকায় সরকারিভাবে খাদ্যশস্য আমদানিতে বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় বাজেট বক্তৃতা ২০২৫-২৬ প্রদানকালে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ তা স্বীকারও করেছেন। বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার। গত বছর আকস্মিক বন্যায় আউশ ও আমন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হওয়ায় খাদ্যশস্যের মজুদে কিছুটা ঘাটতি দেখা দেয়। সেই ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে আমরা (সরকারিভাবে) ৯ লাখ টন চাল এবং সাত লাখ টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নিই, যার আওতায় এর মধ্যে চাল ও গম আমদানি করা হয়েছে।
খাদ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে চাহিদার অনুপাতে গমের উৎপাদন না বাড়ায় পণ্যটির ক্ষেত্রে চাহিদার প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর হতে হচ্ছে। আবার গত অর্থবছরে ধান উৎপাদন স্বস্তি দিতে পারেনি। আবহাওয়াজনিত কারণে বোরো মৌসুমে উৎপাদন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না-ও হতে পারে। পাশাপাশি যুদ্ধ পরিস্থিতি বৈশ্বিক খাদ্যশস্য প্রাপ্তিতে কঠিন করতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে খাদ্যশস্য মজুদ ও আমদানিতে জোর দিতে হবে।
এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘বোরো মৌসুমে সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রম বেশ জোরদার করা হয়েছে। খাদ্যশস্যের মজুদ পর্যাপ্ত রাখতে সরকারিভাবে সংগ্রহ কার্যক্রমের পাশাপাশি আমদানিকেও গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে। সামনের দিনে আমদানি কী হারে হবে, এ ব্যাপারে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমাদের মূল্য লক্ষ্য খাদ্যশস্যের সরবরাহ নিশ্চিত রাখা।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সাবেক সভাপতি ড. জাহাঙ্গীর আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বোরো মৌসুম শেষে চালের দাম বেশি থাকার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। সরকারের চালসহ খাদ্যশস্য মজুদও বেশ ভালো। মূলত সরকারের ব্যবস্থাপনা সমস্যার কারণেই দীর্ঘ মেয়াদে বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বর্তমানে চালের বাজার কৃষক বা সরকারের হাতে পরিচালিত হচ্ছে না, চালের বাজার ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত। তাঁরাই অসাধু পন্থায় অতিমুনাফার লোভে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছেন। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।’