
মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে মানুষের শরীরে রোগ বাড়ছে। দেশে ক্যান্সারে আক্রান্তদের ৩৬ শতাংশই কৃষক। আগে নিরাপদ খাদ্যের কথা বলা হলেও এখন পুষ্টিনিরাপত্তার কথা বলা হচ্ছে। কেননা, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে মাটি উর্বরতা হারাচ্ছে। একই সঙ্গে এভাবে উৎপাদিত খাবার গ্রহণের ফলে মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমছে। গতকাল বণিক বার্তা কার্যালয়ে ‘জাতীয় কৃষি নীতির বিভিন্ন দিক এবং কৃষি খাদ্য ব্যবস্থা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণ’ শীর্ষক পলিসি ডায়ালগে এসব কথা বলেন বক্তারা।
এগ্রোইকোলজি কোয়ালিশন বাংলাদেশ, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), জার্মানিভিত্তিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ওয়েল্টহাঙ্গারহিলফে ও বণিক বার্তার উদ্যোগে পলিসি ডায়ালগটি অনুষ্ঠিত হয়।
পিকেএসএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদেরের সভাপতিত্বে পলিসি ডায়ালগে প্রধান অতিথি ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। বিশেষ অতিথি ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এসএম সোহরাব উদ্দিন। আয়োজনটি সঞ্চালনা করেন বণিক বার্তার সহকারী সম্পাদক ও বিশেষ সংবাদদাতা বদরুল আলম।
পলিসি ডায়ালগে স্বাগত বক্তব্য দেন এগ্রোইকোলজি কোয়ালিশন বাংলাদেশের আহ্বায়ক ও ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চের গবেষণা পরিচালক আহমেদ বোরহান।
আয়োজনে আরো বক্তব্য রাখেন সার্ক কৃষি কেন্দ্রের পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কম্পোনেন্ট পরিচালক (উপসচিব) ড. মোহাম্মদ রাজু আহমেদ, হেইফার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুরুন নাহার, ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট ড. মো. মঞ্জুরুল আলম, ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টের (ইফাদ) কান্ট্রি প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট মাশিয়াত চৌধুরী, সিরডাপের গবেষণা পরিচালক ড. গঙ্গা দত্ত আচার্য্য, ওয়েল্টহাঙ্গারহিলফের প্রকল্পপ্রধান মো. মামুনুর রশীদ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব ইসলাম, এশিয়ান ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর সাসটেইনেবল রুরাল ডেভেলপমেন্টের অপারেশনস ম্যানেজার (দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া) আমিরুল ইসলাম, বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সাহানোয়ার সাইদ শাহীন, বিএসএএফই ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি আতাউর রহমান মিটন, কৃষি মোর্চা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক মিজানুর রহমান, চুয়াডাঙ্গার কৃষি মোর্চা প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলী ও মানিকগঞ্জ কৃষি মোর্চা প্রতিনিধি জান্নাতুল মৌসুমী।
স্বাগত বক্তব্যে এগ্রোইকোলজি কোয়ালিশন বাংলাদেশের আহ্বায়ক ও ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী বলেন, ‘শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিকেএসএফের সহযোগিতায় একটি এগ্রোইকোলজি সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। আমরা যে এগ্রোইকোলজি লার্নিং সেন্টার গড়ে তুলেছি সেখানে শুধু বাংলাদেশ না, সার্কভুক্ত বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা শিক্ষা নিতে পারবেন।’
প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চের গবেষণা পরিচালক আহমেদ বোরহান বলেন, ‘মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে মাটি ও পানির দূষণ বাড়ছে। জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। রাসায়নিক ব্যবহারের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি রয়েছে। অনিরাপদ খাদ্য ব্যবহারে মানবদেহে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কৃষক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন।’
বিদ্যমান জাতীয় কৃষি নীতিতে কিছু অসংগতি ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন আহমেদ বোরহান। তিনি বেশ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় কৃষি নীতিকে পর্যালোচনা করে নীতিগত দ্বৈততা পরিহার, এগ্রোইকোলজি পলিসি ও কৃষি খাদ্য ব্যবস্থার কাঠামোকে এ নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা। কৃষি উপকরণ, বিশেষত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যে জৈব সার খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা। কৃষক-কৃষাণী ও যুবদের কৃষক সংগঠন ‘ফার্মার প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন/কোম্পানি’ গঠনে কৃষি মন্ত্রণালয়ে বিশেষায়িত উইং তৈরির মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়ায় রেজিস্ট্রেশন প্রদান এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা করা। কৃষকবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষককে সহায়তা ও দক্ষতা উন্নয়ন করা। রূপান্তরমূলক কৃষিচর্চায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি সেচ ও কোল্ড স্টোরেজ খাতে বিনিয়োগ করা। দেশব্যাপী কৃষক সংগঠনকেন্দ্রিক ‘স্বতন্ত্র বিপণন ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা করা। এগ্রোইকোলজি চর্চা ত্বরান্বিতকরণে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা এবং কৃষক-কৃষাণীদের জন্য পৃথক কোর্স কারিকুলাম উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
পলিসি ডায়ালগে সভাপতির বক্তব্যে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের বলেন, ‘কৃষিতে মাত্র ৬ শতাংশ রিটার্ন অব ইন্টারেস্ট আসে। দেশে আর কোনো খাতে এত কম রিটার্ন আসে না। কৃষক পিতা চান না, তার সন্তান এ পেশায় আসুক। কৃষি উৎপাদন বাড়ছে, কিন্তু কৃষকের মুনাফা বাড়েনি।’
তিনি আরো বলেন, ‘মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে নানা রোগবালাই বাড়ছে। দেশে ক্যান্সারে আক্রান্তদের ৩৬ শতাংশই কৃষক। আগে বলা হতো নিরাপদ খাদ্যের কথা। এখন বলা হয় পুষ্টিনিরাপত্তার কথা। অর্থাৎ শুধু খাবার হলেই হবে না, এটির পুষ্টিগুণের বিষয়টি এখন বেশি আলোচনা হয়।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এসএম সোহরাব উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের দেশের জনসংখ্যা বিপুল। এখানে পুরোপুরি অর্গানিক ফার্মিং চালু করা বাস্তবসম্মত নয়। আমাদের জনসংখ্যা দুই কোটি হলে হয়তো তা করা যেত।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা যদি শুধু “বিষমুক্ত খাবার চাই” বলে যাই, কিন্তু উৎপাদন ও দামের বাস্তবতা না দেখি, তাহলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে, তাই বাড়ছে উৎপাদনের চাপ। এ ভারসাম্য বজায় রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই নীতিগুলো বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় তৈরি করতে হবে। বিদেশের মডেল অন্ধভাবে অনুসরণ করে লাভ নেই। ভিনদেশে যেটা ভালো হয়েছে, সেটা আমাদের জন্য কার্যকর নাও হতে পারে।’
সার্ক কৃষি কেন্দ্রের পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া সরলরৈখিক। এর সঙ্গে যখন ফুড লস্ট ও ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট যুক্ত করব তখন এটি সার্কুলার (চক্রাকার) হবে। কৃষককে আমরাই শিখিয়েছি সার ও কীটনাশক দিতে হবে। এটি তাদের দোষ না। এখানে দেখতে হবে তারা অতিরিক্ত ব্যবহার করছেন কিনা। আমরা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছি। এটি করতে গেলে এভিডেন্স বেজড কিছু না থাকলে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না।’
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কম্পোনেন্ট পরিচালক (উপসচিব) ড. মোহাম্মদ রাজু আহমেদ বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ের চ্যালেঞ্জ আছে, কিছু অর্জনও আছে। এখন প্রায় প্রতিটি গ্রামে ভার্মি কম্পোস্ট উদ্যোক্তা আছেন। তবে এসব জৈব উপাদান বিক্রির বাজার সীমিত, এটাও বাস্তবতা।’
নারীবান্ধব কৃষিপ্রযুক্তির ওপর জোর দিয়ে হেইফার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুরুন নাহার বলেন, ‘নারীবান্ধব কৃষিপ্রযুক্তি উন্নয়ন জরুরি। বর্তমানে ব্যবহৃত অনেক যন্ত্রপাতি বেশ ভারী, ফলে নারীরা তা ব্যবহার করতে পারেন না। তাদের উপযোগী হালকা, ব্যবহারবান্ধব প্রযুক্তি উন্নয়নে আমাদের সুপারিশ প্রয়োজন।’
নীতিমালা বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে বলে উল্লেখ করেন ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট ড. মো. মঞ্জুরুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমাদের নীতিমালাগুলো যথেষ্ট ভালো, কিন্তু বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়ে গেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সেন্সর, আইওটি, ডিজিটাল কৃষি ইত্যাদি একসঙ্গে এগোচ্ছে। আমাদের অবকাঠামো দুর্বল, ডাটানির্ভর সিদ্ধান্ত এখনো সীমিত। ডিজিটাল কৃষি বাস্তবায়নে শক্তিশালী ডাটাবেজ ও ডাটা সেন্টার প্রয়োজন। একই সঙ্গে মানবসম্পদের প্রশিক্ষণ দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম হালনাগাদ না করলে ভবিষ্যতের প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিকে আমরা ধরতে পারব না।’
পরিবেশবান্ধব কৃষিতে কৃষকদের আগ্রহ বাড়াতে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের তাগিদ দেন ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টের (আইএফএডি) কান্ট্রি প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট মাশিয়াত চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘কৃষকরা স্থায়ী প্রণোদনা বা ইনসেন্টিভ না পাওয়ায় পরিবেশবান্ধব কৃষিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। যারা এগ্রোইকোলজিক্যাল পদ্ধতিতে উৎপাদন করেন, বাজারে তারা ন্যায্যমূল্য পান না। তাদের পণ্য ও রাসায়নিক চাষের পণ্যের দাম প্রায় সমান। এভাবে জৈব উৎপাদন করে তারা রাসায়নিকের সঙ্গে টিকে থাকতে পারবেন না। এছাড়া আমাদের সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার, যাতে এ কৃষকরা তাদের পণ্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো দামে বিক্রি করতে পারেন।’
সিরডাপের গবেষণা পরিচালক ড. গঙ্গা দত্ত আচার্য্য বলেন, ‘নীতি সম্পর্কিত ক্ষেত্রে এখানে কোনো সমস্যা নেই। কারণ নীতি তৈরির সময় বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে ভালো ভালো জিনিস সংগ্রহ করে সেখানে যুক্ত করা হয়। আমাদের সব জায়গায় অসাধারণ নীতিমালা আছে। কিন্তু নীতিকে মাঠে বাস্তবে প্রয়োগ করতে গেলে প্রকৃত চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়। কৃষি খাতে বাংলাদেশ গত ৩০-৪০ বছরে অসাধারণ ভালো করছে। কিন্তু এখানে অনেক সমস্যা আছে। আমরা কৃষকদের কাছ গেলে তারা বলেন, সময়মতো ভালো মানের বীজ, সার পাচ্ছেন না। এগুলো অনেক ব্যয়বহুলও। শ্রমিকের অভাব আছে। বাজারে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এ ধরনের কথা এখনো প্রতিটি এলাকায় পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।’
ওয়েল্টহাঙ্গারহিলফের প্রকল্পপ্রধান মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে কৃষি ও অর্গানিক কৃষি নীতিমালায় এগ্রোইকোলজির বিষয়টি স্পষ্টভাবে নেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের যৌথভাবে একটি জাতীয় ফুড সিস্টেম ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা দরকার। এটি আলাদা নীতিমালা বা বিদ্যমান নীতির অংশ হিসেবেও হতে পারে। মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে সরকারের সঙ্গে আমাদের আনুষ্ঠানিক সমঝোতা (এমওইউ) দরকার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সহায়তায় এ প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করা প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সাহানোয়ার সাইদ শাহীন বলেন, ‘আমাদের কৃষি উৎপাদন ১০ কোটি টন ছাড়িয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ অর্জনের জন্য আমরা কী হারাচ্ছি? গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়া কৃষকদের প্রায় অর্ধেকই বালাইনাশক সম্পর্কিত কারণে আক্রান্ত। গত ৪০ বছরে আমরা ১০০ কোটি কেজির বেশি কীটনাশক ব্যবহার করেছি—এটি একধরনের জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়।’
বিএসএএফই ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি আতাউর রহমান মিটন বলেন, ‘পরিবেশ ধ্বংস করে নিরাপদ খাদ্য চাওয়া সম্ভব নয়। বর্তমানে আমাদের খাদ্যনীতিতে যে তিনটি আইন আছে, সেগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। একদিকে আমরা জৈব ও পরিবেশবান্ধব কৃষির কথা বলি, অন্যদিকে রাসায়নিক সারে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে, অথচ জৈব সারের ভর্তুকি কার্যত শূন্য। এ বৈষম্য দূর করতে হলে নীতিগুলোকে পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত করতে হবে।’
কৃষি মোর্চা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক মিজানুর রহমান বলেন, ‘মাটির স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে পরিবেশসম্মত কৃষিতে ফিরতে হবে। এজন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন ও রাসায়নিক কৃষির আগ্রাসন রোধ জরুরি।’
কৃষি মোর্চার চুয়াডাঙ্গার প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘জৈব সার খাতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। সরকার এ খাতে স্বল্পসুদে ঋণ দিতে পারে।’
কৃষি মোর্চার মানিকগঞ্জের প্রতিনিধি জান্নাতুল মৌসুমী বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে ছোট কৃষকদের নিয়ে সংগঠন করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে ছোট কৃষকরা কৃষি সম্পর্কে তথ্য পাবেন এবং তারা সামনে এগিয়ে যেতে পারবেন। কৃষকদের প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষিত করা প্রয়োজন।’
কৃষিতে তথ্য ঘাটতি খুব বড় একটি বিষয় উল্লেখ করে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব ইসলাম বলেন, ‘গবেষণায় উৎপাদন এক রকম দেখা যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে হয়তো অন্য রকম। আবার গবেষণায় মান এক রকম দেখালেও ফিল্ডে হয়তো অন্য রকম। এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। কৃষির রূপান্তরে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্তি থাকতে হবে। বহির্বিশ্বে কোন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে।’
এশিয়ান ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর সাসটেইনেবল রুরাল ডেভেলপমেন্টের অপারেশনস ম্যানেজার (দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া) আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে সব পেশাজীবীর সংগঠন আছে, কেবল কৃষকদের নেই। সমবায় ব্যবস্থা আছে ঠিকই, কিন্তু কার্যত অকার্যকর। জাপান, কোরিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডসহ সব দেশেই কৃষক সংগঠন শক্তিশালী, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক। সেখানে সরকার, অর্থ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় সবাই একসঙ্গে কাজ করে। আমাদের দেশে সে সমন্বয় অনুপস্থিত।’
‘জাতীয় কৃষি নীতির বিভিন্ন দিক এবং কৃষি খাদ্য ব্যবস্থা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণ’ শীর্ষক পলিসি ডায়ালগে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ‘আমরা রিসোর্স প্ল্যানিং করতে চাই। সেখানে নিড ও ডিমান্ড দুটোই থাকবে। সার, সেচ, জৈব কীটনাশক সবগুলোর চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ে পর্যালোচনা করব। আমরা মেকানাইজেশন নিয়ে কাজ করব। তবে হুট করে কিছু করব না। হঠাৎ করে এমন কোনো প্রযুক্তি আনা যাবে না যেখানে কৃষক কর্মসংস্থান হারান। কেননা, তাদের জন্য পর্যাপ্ত বিকল্প পেশার সুযোগ আমাদের হাতে নেই।’
কৃষি সচিব আরো বলেন, ‘জৈব সার আমার খুবই আগ্রহের জায়গা। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার কমানো প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রচারণা দরকার। কৃষকদের বোঝাতে হবে, জৈব সার ব্যবহারের সুবিধা কী কী; পাশাপাশি রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে কী কী অপকারিতা তৈরি হচ্ছে। রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, ক্যান্সার বাড়ছে—এমন নানা সমস্যা নিয়ে প্রচারণা চালাতে হবে।’
মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে মানুষের শরীরে রোগ বাড়ছে। দেশে ক্যান্সারে আক্রান্তদের ৩৬ শতাংশই কৃষক। আগে নিরাপদ খাদ্যের কথা বলা হলেও এখন পুষ্টিনিরাপত্তার কথা বলা হচ্ছে। কেননা, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে মাটি উর্বরতা হারাচ্ছে। একই সঙ্গে এভাবে উৎপাদিত খাবার গ্রহণের ফলে মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমছে। গতকাল বণিক বার্তা কার্যালয়ে ‘জাতীয় কৃষি নীতির বিভিন্ন দিক এবং কৃষি খাদ্য ব্যবস্থা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণ’ শীর্ষক পলিসি ডায়ালগে এসব কথা বলেন বক্তারা।
এগ্রোইকোলজি কোয়ালিশন বাংলাদেশ, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), জার্মানিভিত্তিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ওয়েল্টহাঙ্গারহিলফে ও বণিক বার্তার উদ্যোগে পলিসি ডায়ালগটি অনুষ্ঠিত হয়।
পিকেএসএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদেরের সভাপতিত্বে পলিসি ডায়ালগে প্রধান অতিথি ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। বিশেষ অতিথি ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এসএম সোহরাব উদ্দিন। আয়োজনটি সঞ্চালনা করেন বণিক বার্তার সহকারী সম্পাদক ও বিশেষ সংবাদদাতা বদরুল আলম।
পলিসি ডায়ালগে স্বাগত বক্তব্য দেন এগ্রোইকোলজি কোয়ালিশন বাংলাদেশের আহ্বায়ক ও ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চের গবেষণা পরিচালক আহমেদ বোরহান।
আয়োজনে আরো বক্তব্য রাখেন সার্ক কৃষি কেন্দ্রের পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কম্পোনেন্ট পরিচালক (উপসচিব) ড. মোহাম্মদ রাজু আহমেদ, হেইফার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুরুন নাহার, ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট ড. মো. মঞ্জুরুল আলম, ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টের (ইফাদ) কান্ট্রি প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট মাশিয়াত চৌধুরী, সিরডাপের গবেষণা পরিচালক ড. গঙ্গা দত্ত আচার্য্য, ওয়েল্টহাঙ্গারহিলফের প্রকল্পপ্রধান মো. মামুনুর রশীদ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব ইসলাম, এশিয়ান ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর সাসটেইনেবল রুরাল ডেভেলপমেন্টের অপারেশনস ম্যানেজার (দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া) আমিরুল ইসলাম, বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সাহানোয়ার সাইদ শাহীন, বিএসএএফই ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি আতাউর রহমান মিটন, কৃষি মোর্চা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক মিজানুর রহমান, চুয়াডাঙ্গার কৃষি মোর্চা প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলী ও মানিকগঞ্জ কৃষি মোর্চা প্রতিনিধি জান্নাতুল মৌসুমী।
স্বাগত বক্তব্যে এগ্রোইকোলজি কোয়ালিশন বাংলাদেশের আহ্বায়ক ও ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী বলেন, ‘শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিকেএসএফের সহযোগিতায় একটি এগ্রোইকোলজি সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। আমরা যে এগ্রোইকোলজি লার্নিং সেন্টার গড়ে তুলেছি সেখানে শুধু বাংলাদেশ না, সার্কভুক্ত বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা শিক্ষা নিতে পারবেন।’
প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চের গবেষণা পরিচালক আহমেদ বোরহান বলেন, ‘মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে মাটি ও পানির দূষণ বাড়ছে। জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। রাসায়নিক ব্যবহারের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি রয়েছে। অনিরাপদ খাদ্য ব্যবহারে মানবদেহে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কৃষক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন।’
বিদ্যমান জাতীয় কৃষি নীতিতে কিছু অসংগতি ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন আহমেদ বোরহান। তিনি বেশ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় কৃষি নীতিকে পর্যালোচনা করে নীতিগত দ্বৈততা পরিহার, এগ্রোইকোলজি পলিসি ও কৃষি খাদ্য ব্যবস্থার কাঠামোকে এ নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা। কৃষি উপকরণ, বিশেষত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যে জৈব সার খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা। কৃষক-কৃষাণী ও যুবদের কৃষক সংগঠন ‘ফার্মার প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন/কোম্পানি’ গঠনে কৃষি মন্ত্রণালয়ে বিশেষায়িত উইং তৈরির মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়ায় রেজিস্ট্রেশন প্রদান এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা করা। কৃষকবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষককে সহায়তা ও দক্ষতা উন্নয়ন করা। রূপান্তরমূলক কৃষিচর্চায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি সেচ ও কোল্ড স্টোরেজ খাতে বিনিয়োগ করা। দেশব্যাপী কৃষক সংগঠনকেন্দ্রিক ‘স্বতন্ত্র বিপণন ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা করা। এগ্রোইকোলজি চর্চা ত্বরান্বিতকরণে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা এবং কৃষক-কৃষাণীদের জন্য পৃথক কোর্স কারিকুলাম উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
পলিসি ডায়ালগে সভাপতির বক্তব্যে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের বলেন, ‘কৃষিতে মাত্র ৬ শতাংশ রিটার্ন অব ইন্টারেস্ট আসে। দেশে আর কোনো খাতে এত কম রিটার্ন আসে না। কৃষক পিতা চান না, তার সন্তান এ পেশায় আসুক। কৃষি উৎপাদন বাড়ছে, কিন্তু কৃষকের মুনাফা বাড়েনি।’
তিনি আরো বলেন, ‘মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে নানা রোগবালাই বাড়ছে। দেশে ক্যান্সারে আক্রান্তদের ৩৬ শতাংশই কৃষক। আগে বলা হতো নিরাপদ খাদ্যের কথা। এখন বলা হয় পুষ্টিনিরাপত্তার কথা। অর্থাৎ শুধু খাবার হলেই হবে না, এটির পুষ্টিগুণের বিষয়টি এখন বেশি আলোচনা হয়।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এসএম সোহরাব উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের দেশের জনসংখ্যা বিপুল। এখানে পুরোপুরি অর্গানিক ফার্মিং চালু করা বাস্তবসম্মত নয়। আমাদের জনসংখ্যা দুই কোটি হলে হয়তো তা করা যেত।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা যদি শুধু “বিষমুক্ত খাবার চাই” বলে যাই, কিন্তু উৎপাদন ও দামের বাস্তবতা না দেখি, তাহলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে, তাই বাড়ছে উৎপাদনের চাপ। এ ভারসাম্য বজায় রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই নীতিগুলো বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় তৈরি করতে হবে। বিদেশের মডেল অন্ধভাবে অনুসরণ করে লাভ নেই। ভিনদেশে যেটা ভালো হয়েছে, সেটা আমাদের জন্য কার্যকর নাও হতে পারে।’
সার্ক কৃষি কেন্দ্রের পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া সরলরৈখিক। এর সঙ্গে যখন ফুড লস্ট ও ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট যুক্ত করব তখন এটি সার্কুলার (চক্রাকার) হবে। কৃষককে আমরাই শিখিয়েছি সার ও কীটনাশক দিতে হবে। এটি তাদের দোষ না। এখানে দেখতে হবে তারা অতিরিক্ত ব্যবহার করছেন কিনা। আমরা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছি। এটি করতে গেলে এভিডেন্স বেজড কিছু না থাকলে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না।’
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কম্পোনেন্ট পরিচালক (উপসচিব) ড. মোহাম্মদ রাজু আহমেদ বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ের চ্যালেঞ্জ আছে, কিছু অর্জনও আছে। এখন প্রায় প্রতিটি গ্রামে ভার্মি কম্পোস্ট উদ্যোক্তা আছেন। তবে এসব জৈব উপাদান বিক্রির বাজার সীমিত, এটাও বাস্তবতা।’
নারীবান্ধব কৃষিপ্রযুক্তির ওপর জোর দিয়ে হেইফার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুরুন নাহার বলেন, ‘নারীবান্ধব কৃষিপ্রযুক্তি উন্নয়ন জরুরি। বর্তমানে ব্যবহৃত অনেক যন্ত্রপাতি বেশ ভারী, ফলে নারীরা তা ব্যবহার করতে পারেন না। তাদের উপযোগী হালকা, ব্যবহারবান্ধব প্রযুক্তি উন্নয়নে আমাদের সুপারিশ প্রয়োজন।’
নীতিমালা বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে বলে উল্লেখ করেন ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট ড. মো. মঞ্জুরুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমাদের নীতিমালাগুলো যথেষ্ট ভালো, কিন্তু বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়ে গেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সেন্সর, আইওটি, ডিজিটাল কৃষি ইত্যাদি একসঙ্গে এগোচ্ছে। আমাদের অবকাঠামো দুর্বল, ডাটানির্ভর সিদ্ধান্ত এখনো সীমিত। ডিজিটাল কৃষি বাস্তবায়নে শক্তিশালী ডাটাবেজ ও ডাটা সেন্টার প্রয়োজন। একই সঙ্গে মানবসম্পদের প্রশিক্ষণ দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম হালনাগাদ না করলে ভবিষ্যতের প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিকে আমরা ধরতে পারব না।’
পরিবেশবান্ধব কৃষিতে কৃষকদের আগ্রহ বাড়াতে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের তাগিদ দেন ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টের (আইএফএডি) কান্ট্রি প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট মাশিয়াত চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘কৃষকরা স্থায়ী প্রণোদনা বা ইনসেন্টিভ না পাওয়ায় পরিবেশবান্ধব কৃষিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। যারা এগ্রোইকোলজিক্যাল পদ্ধতিতে উৎপাদন করেন, বাজারে তারা ন্যায্যমূল্য পান না। তাদের পণ্য ও রাসায়নিক চাষের পণ্যের দাম প্রায় সমান। এভাবে জৈব উৎপাদন করে তারা রাসায়নিকের সঙ্গে টিকে থাকতে পারবেন না। এছাড়া আমাদের সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার, যাতে এ কৃষকরা তাদের পণ্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো দামে বিক্রি করতে পারেন।’
সিরডাপের গবেষণা পরিচালক ড. গঙ্গা দত্ত আচার্য্য বলেন, ‘নীতি সম্পর্কিত ক্ষেত্রে এখানে কোনো সমস্যা নেই। কারণ নীতি তৈরির সময় বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে ভালো ভালো জিনিস সংগ্রহ করে সেখানে যুক্ত করা হয়। আমাদের সব জায়গায় অসাধারণ নীতিমালা আছে। কিন্তু নীতিকে মাঠে বাস্তবে প্রয়োগ করতে গেলে প্রকৃত চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়। কৃষি খাতে বাংলাদেশ গত ৩০-৪০ বছরে অসাধারণ ভালো করছে। কিন্তু এখানে অনেক সমস্যা আছে। আমরা কৃষকদের কাছ গেলে তারা বলেন, সময়মতো ভালো মানের বীজ, সার পাচ্ছেন না। এগুলো অনেক ব্যয়বহুলও। শ্রমিকের অভাব আছে। বাজারে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এ ধরনের কথা এখনো প্রতিটি এলাকায় পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।’
ওয়েল্টহাঙ্গারহিলফের প্রকল্পপ্রধান মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে কৃষি ও অর্গানিক কৃষি নীতিমালায় এগ্রোইকোলজির বিষয়টি স্পষ্টভাবে নেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের যৌথভাবে একটি জাতীয় ফুড সিস্টেম ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা দরকার। এটি আলাদা নীতিমালা বা বিদ্যমান নীতির অংশ হিসেবেও হতে পারে। মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে সরকারের সঙ্গে আমাদের আনুষ্ঠানিক সমঝোতা (এমওইউ) দরকার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সহায়তায় এ প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করা প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সাহানোয়ার সাইদ শাহীন বলেন, ‘আমাদের কৃষি উৎপাদন ১০ কোটি টন ছাড়িয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ অর্জনের জন্য আমরা কী হারাচ্ছি? গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়া কৃষকদের প্রায় অর্ধেকই বালাইনাশক সম্পর্কিত কারণে আক্রান্ত। গত ৪০ বছরে আমরা ১০০ কোটি কেজির বেশি কীটনাশক ব্যবহার করেছি—এটি একধরনের জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়।’
বিএসএএফই ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি আতাউর রহমান মিটন বলেন, ‘পরিবেশ ধ্বংস করে নিরাপদ খাদ্য চাওয়া সম্ভব নয়। বর্তমানে আমাদের খাদ্যনীতিতে যে তিনটি আইন আছে, সেগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। একদিকে আমরা জৈব ও পরিবেশবান্ধব কৃষির কথা বলি, অন্যদিকে রাসায়নিক সারে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে, অথচ জৈব সারের ভর্তুকি কার্যত শূন্য। এ বৈষম্য দূর করতে হলে নীতিগুলোকে পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত করতে হবে।’
কৃষি মোর্চা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক মিজানুর রহমান বলেন, ‘মাটির স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে পরিবেশসম্মত কৃষিতে ফিরতে হবে। এজন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন ও রাসায়নিক কৃষির আগ্রাসন রোধ জরুরি।’
কৃষি মোর্চার চুয়াডাঙ্গার প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘জৈব সার খাতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। সরকার এ খাতে স্বল্পসুদে ঋণ দিতে পারে।’
কৃষি মোর্চার মানিকগঞ্জের প্রতিনিধি জান্নাতুল মৌসুমী বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে ছোট কৃষকদের নিয়ে সংগঠন করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে ছোট কৃষকরা কৃষি সম্পর্কে তথ্য পাবেন এবং তারা সামনে এগিয়ে যেতে পারবেন। কৃষকদের প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষিত করা প্রয়োজন।’
কৃষিতে তথ্য ঘাটতি খুব বড় একটি বিষয় উল্লেখ করে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব ইসলাম বলেন, ‘গবেষণায় উৎপাদন এক রকম দেখা যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে হয়তো অন্য রকম। আবার গবেষণায় মান এক রকম দেখালেও ফিল্ডে হয়তো অন্য রকম। এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। কৃষির রূপান্তরে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্তি থাকতে হবে। বহির্বিশ্বে কোন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে।’
এশিয়ান ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর সাসটেইনেবল রুরাল ডেভেলপমেন্টের অপারেশনস ম্যানেজার (দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া) আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে সব পেশাজীবীর সংগঠন আছে, কেবল কৃষকদের নেই। সমবায় ব্যবস্থা আছে ঠিকই, কিন্তু কার্যত অকার্যকর। জাপান, কোরিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডসহ সব দেশেই কৃষক সংগঠন শক্তিশালী, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক। সেখানে সরকার, অর্থ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় সবাই একসঙ্গে কাজ করে। আমাদের দেশে সে সমন্বয় অনুপস্থিত।’
‘জাতীয় কৃষি নীতির বিভিন্ন দিক এবং কৃষি খাদ্য ব্যবস্থা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণ’ শীর্ষক পলিসি ডায়ালগে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ‘আমরা রিসোর্স প্ল্যানিং করতে চাই। সেখানে নিড ও ডিমান্ড দুটোই থাকবে। সার, সেচ, জৈব কীটনাশক সবগুলোর চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ে পর্যালোচনা করব। আমরা মেকানাইজেশন নিয়ে কাজ করব। তবে হুট করে কিছু করব না। হঠাৎ করে এমন কোনো প্রযুক্তি আনা যাবে না যেখানে কৃষক কর্মসংস্থান হারান। কেননা, তাদের জন্য পর্যাপ্ত বিকল্প পেশার সুযোগ আমাদের হাতে নেই।’
কৃষি সচিব আরো বলেন, ‘জৈব সার আমার খুবই আগ্রহের জায়গা। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার কমানো প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রচারণা দরকার। কৃষকদের বোঝাতে হবে, জৈব সার ব্যবহারের সুবিধা কী কী; পাশাপাশি রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে কী কী অপকারিতা তৈরি হচ্ছে। রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, ক্যান্সার বাড়ছে—এমন নানা সমস্যা নিয়ে প্রচারণা চালাতে হবে।’
মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে মানুষের শরীরে রোগ বাড়ছে। দেশে ক্যান্সারে আক্রান্তদের ৩৬ শতাংশই কৃষক। আগে নিরাপদ খাদ্যের কথা বলা হলেও এখন পুষ্টিনিরাপত্তার কথা বলা হচ্ছে। কেননা, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে মাটি উর্বরতা হারাচ্ছে। একই সঙ্গে এভাবে উৎপাদিত খাবার গ্রহণের ফলে মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমছে। গতকাল বণিক বার্তা কার্যালয়ে ‘জাতীয় কৃষি নীতির বিভিন্ন দিক এবং কৃষি খাদ্য ব্যবস্থা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণ’ শীর্ষক পলিসি ডায়ালগে এসব কথা বলেন বক্তারা।
এগ্রোইকোলজি কোয়ালিশন বাংলাদেশ, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), জার্মানিভিত্তিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ওয়েল্টহাঙ্গারহিলফে ও বণিক বার্তার উদ্যোগে পলিসি ডায়ালগটি অনুষ্ঠিত হয়।
পিকেএসএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদেরের সভাপতিত্বে পলিসি ডায়ালগে প্রধান অতিথি ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। বিশেষ অতিথি ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এসএম সোহরাব উদ্দিন। আয়োজনটি সঞ্চালনা করেন বণিক বার্তার সহকারী সম্পাদক ও বিশেষ সংবাদদাতা বদরুল আলম।
পলিসি ডায়ালগে স্বাগত বক্তব্য দেন এগ্রোইকোলজি কোয়ালিশন বাংলাদেশের আহ্বায়ক ও ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চের গবেষণা পরিচালক আহমেদ বোরহান।
আয়োজনে আরো বক্তব্য রাখেন সার্ক কৃষি কেন্দ্রের পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কম্পোনেন্ট পরিচালক (উপসচিব) ড. মোহাম্মদ রাজু আহমেদ, হেইফার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুরুন নাহার, ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট ড. মো. মঞ্জুরুল আলম, ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টের (ইফাদ) কান্ট্রি প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট মাশিয়াত চৌধুরী, সিরডাপের গবেষণা পরিচালক ড. গঙ্গা দত্ত আচার্য্য, ওয়েল্টহাঙ্গারহিলফের প্রকল্পপ্রধান মো. মামুনুর রশীদ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব ইসলাম, এশিয়ান ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর সাসটেইনেবল রুরাল ডেভেলপমেন্টের অপারেশনস ম্যানেজার (দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া) আমিরুল ইসলাম, বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সাহানোয়ার সাইদ শাহীন, বিএসএএফই ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি আতাউর রহমান মিটন, কৃষি মোর্চা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক মিজানুর রহমান, চুয়াডাঙ্গার কৃষি মোর্চা প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলী ও মানিকগঞ্জ কৃষি মোর্চা প্রতিনিধি জান্নাতুল মৌসুমী।
স্বাগত বক্তব্যে এগ্রোইকোলজি কোয়ালিশন বাংলাদেশের আহ্বায়ক ও ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী বলেন, ‘শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিকেএসএফের সহযোগিতায় একটি এগ্রোইকোলজি সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। আমরা যে এগ্রোইকোলজি লার্নিং সেন্টার গড়ে তুলেছি সেখানে শুধু বাংলাদেশ না, সার্কভুক্ত বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা শিক্ষা নিতে পারবেন।’
প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চের গবেষণা পরিচালক আহমেদ বোরহান বলেন, ‘মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে মাটি ও পানির দূষণ বাড়ছে। জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। রাসায়নিক ব্যবহারের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি রয়েছে। অনিরাপদ খাদ্য ব্যবহারে মানবদেহে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কৃষক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন।’
বিদ্যমান জাতীয় কৃষি নীতিতে কিছু অসংগতি ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন আহমেদ বোরহান। তিনি বেশ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় কৃষি নীতিকে পর্যালোচনা করে নীতিগত দ্বৈততা পরিহার, এগ্রোইকোলজি পলিসি ও কৃষি খাদ্য ব্যবস্থার কাঠামোকে এ নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা। কৃষি উপকরণ, বিশেষত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যে জৈব সার খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করা। কৃষক-কৃষাণী ও যুবদের কৃষক সংগঠন ‘ফার্মার প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন/কোম্পানি’ গঠনে কৃষি মন্ত্রণালয়ে বিশেষায়িত উইং তৈরির মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়ায় রেজিস্ট্রেশন প্রদান এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা করা। কৃষকবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষককে সহায়তা ও দক্ষতা উন্নয়ন করা। রূপান্তরমূলক কৃষিচর্চায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি সেচ ও কোল্ড স্টোরেজ খাতে বিনিয়োগ করা। দেশব্যাপী কৃষক সংগঠনকেন্দ্রিক ‘স্বতন্ত্র বিপণন ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা করা। এগ্রোইকোলজি চর্চা ত্বরান্বিতকরণে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা এবং কৃষক-কৃষাণীদের জন্য পৃথক কোর্স কারিকুলাম উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
পলিসি ডায়ালগে সভাপতির বক্তব্যে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের বলেন, ‘কৃষিতে মাত্র ৬ শতাংশ রিটার্ন অব ইন্টারেস্ট আসে। দেশে আর কোনো খাতে এত কম রিটার্ন আসে না। কৃষক পিতা চান না, তার সন্তান এ পেশায় আসুক। কৃষি উৎপাদন বাড়ছে, কিন্তু কৃষকের মুনাফা বাড়েনি।’
তিনি আরো বলেন, ‘মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে নানা রোগবালাই বাড়ছে। দেশে ক্যান্সারে আক্রান্তদের ৩৬ শতাংশই কৃষক। আগে বলা হতো নিরাপদ খাদ্যের কথা। এখন বলা হয় পুষ্টিনিরাপত্তার কথা। অর্থাৎ শুধু খাবার হলেই হবে না, এটির পুষ্টিগুণের বিষয়টি এখন বেশি আলোচনা হয়।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এসএম সোহরাব উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের দেশের জনসংখ্যা বিপুল। এখানে পুরোপুরি অর্গানিক ফার্মিং চালু করা বাস্তবসম্মত নয়। আমাদের জনসংখ্যা দুই কোটি হলে হয়তো তা করা যেত।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা যদি শুধু “বিষমুক্ত খাবার চাই” বলে যাই, কিন্তু উৎপাদন ও দামের বাস্তবতা না দেখি, তাহলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে, তাই বাড়ছে উৎপাদনের চাপ। এ ভারসাম্য বজায় রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই নীতিগুলো বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় তৈরি করতে হবে। বিদেশের মডেল অন্ধভাবে অনুসরণ করে লাভ নেই। ভিনদেশে যেটা ভালো হয়েছে, সেটা আমাদের জন্য কার্যকর নাও হতে পারে।’
সার্ক কৃষি কেন্দ্রের পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া সরলরৈখিক। এর সঙ্গে যখন ফুড লস্ট ও ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট যুক্ত করব তখন এটি সার্কুলার (চক্রাকার) হবে। কৃষককে আমরাই শিখিয়েছি সার ও কীটনাশক দিতে হবে। এটি তাদের দোষ না। এখানে দেখতে হবে তারা অতিরিক্ত ব্যবহার করছেন কিনা। আমরা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছি। এটি করতে গেলে এভিডেন্স বেজড কিছু না থাকলে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না।’
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কম্পোনেন্ট পরিচালক (উপসচিব) ড. মোহাম্মদ রাজু আহমেদ বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ের চ্যালেঞ্জ আছে, কিছু অর্জনও আছে। এখন প্রায় প্রতিটি গ্রামে ভার্মি কম্পোস্ট উদ্যোক্তা আছেন। তবে এসব জৈব উপাদান বিক্রির বাজার সীমিত, এটাও বাস্তবতা।’
নারীবান্ধব কৃষিপ্রযুক্তির ওপর জোর দিয়ে হেইফার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুরুন নাহার বলেন, ‘নারীবান্ধব কৃষিপ্রযুক্তি উন্নয়ন জরুরি। বর্তমানে ব্যবহৃত অনেক যন্ত্রপাতি বেশ ভারী, ফলে নারীরা তা ব্যবহার করতে পারেন না। তাদের উপযোগী হালকা, ব্যবহারবান্ধব প্রযুক্তি উন্নয়নে আমাদের সুপারিশ প্রয়োজন।’
নীতিমালা বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে বলে উল্লেখ করেন ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট ড. মো. মঞ্জুরুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমাদের নীতিমালাগুলো যথেষ্ট ভালো, কিন্তু বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়ে গেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সেন্সর, আইওটি, ডিজিটাল কৃষি ইত্যাদি একসঙ্গে এগোচ্ছে। আমাদের অবকাঠামো দুর্বল, ডাটানির্ভর সিদ্ধান্ত এখনো সীমিত। ডিজিটাল কৃষি বাস্তবায়নে শক্তিশালী ডাটাবেজ ও ডাটা সেন্টার প্রয়োজন। একই সঙ্গে মানবসম্পদের প্রশিক্ষণ দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম হালনাগাদ না করলে ভবিষ্যতের প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিকে আমরা ধরতে পারব না।’
পরিবেশবান্ধব কৃষিতে কৃষকদের আগ্রহ বাড়াতে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের তাগিদ দেন ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্টের (আইএফএডি) কান্ট্রি প্রোগ্রাম অ্যানালিস্ট মাশিয়াত চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘কৃষকরা স্থায়ী প্রণোদনা বা ইনসেন্টিভ না পাওয়ায় পরিবেশবান্ধব কৃষিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। যারা এগ্রোইকোলজিক্যাল পদ্ধতিতে উৎপাদন করেন, বাজারে তারা ন্যায্যমূল্য পান না। তাদের পণ্য ও রাসায়নিক চাষের পণ্যের দাম প্রায় সমান। এভাবে জৈব উৎপাদন করে তারা রাসায়নিকের সঙ্গে টিকে থাকতে পারবেন না। এছাড়া আমাদের সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার, যাতে এ কৃষকরা তাদের পণ্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো দামে বিক্রি করতে পারেন।’
সিরডাপের গবেষণা পরিচালক ড. গঙ্গা দত্ত আচার্য্য বলেন, ‘নীতি সম্পর্কিত ক্ষেত্রে এখানে কোনো সমস্যা নেই। কারণ নীতি তৈরির সময় বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে ভালো ভালো জিনিস সংগ্রহ করে সেখানে যুক্ত করা হয়। আমাদের সব জায়গায় অসাধারণ নীতিমালা আছে। কিন্তু নীতিকে মাঠে বাস্তবে প্রয়োগ করতে গেলে প্রকৃত চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়। কৃষি খাতে বাংলাদেশ গত ৩০-৪০ বছরে অসাধারণ ভালো করছে। কিন্তু এখানে অনেক সমস্যা আছে। আমরা কৃষকদের কাছ গেলে তারা বলেন, সময়মতো ভালো মানের বীজ, সার পাচ্ছেন না। এগুলো অনেক ব্যয়বহুলও। শ্রমিকের অভাব আছে। বাজারে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এ ধরনের কথা এখনো প্রতিটি এলাকায় পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।’
ওয়েল্টহাঙ্গারহিলফের প্রকল্পপ্রধান মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে কৃষি ও অর্গানিক কৃষি নীতিমালায় এগ্রোইকোলজির বিষয়টি স্পষ্টভাবে নেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের যৌথভাবে একটি জাতীয় ফুড সিস্টেম ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা দরকার। এটি আলাদা নীতিমালা বা বিদ্যমান নীতির অংশ হিসেবেও হতে পারে। মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে সরকারের সঙ্গে আমাদের আনুষ্ঠানিক সমঝোতা (এমওইউ) দরকার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সহায়তায় এ প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করা প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সাহানোয়ার সাইদ শাহীন বলেন, ‘আমাদের কৃষি উৎপাদন ১০ কোটি টন ছাড়িয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ অর্জনের জন্য আমরা কী হারাচ্ছি? গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়া কৃষকদের প্রায় অর্ধেকই বালাইনাশক সম্পর্কিত কারণে আক্রান্ত। গত ৪০ বছরে আমরা ১০০ কোটি কেজির বেশি কীটনাশক ব্যবহার করেছি—এটি একধরনের জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়।’
বিএসএএফই ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি আতাউর রহমান মিটন বলেন, ‘পরিবেশ ধ্বংস করে নিরাপদ খাদ্য চাওয়া সম্ভব নয়। বর্তমানে আমাদের খাদ্যনীতিতে যে তিনটি আইন আছে, সেগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। একদিকে আমরা জৈব ও পরিবেশবান্ধব কৃষির কথা বলি, অন্যদিকে রাসায়নিক সারে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে, অথচ জৈব সারের ভর্তুকি কার্যত শূন্য। এ বৈষম্য দূর করতে হলে নীতিগুলোকে পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত করতে হবে।’
কৃষি মোর্চা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক মিজানুর রহমান বলেন, ‘মাটির স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে পরিবেশসম্মত কৃষিতে ফিরতে হবে। এজন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন ও রাসায়নিক কৃষির আগ্রাসন রোধ জরুরি।’
কৃষি মোর্চার চুয়াডাঙ্গার প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘জৈব সার খাতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। সরকার এ খাতে স্বল্পসুদে ঋণ দিতে পারে।’
কৃষি মোর্চার মানিকগঞ্জের প্রতিনিধি জান্নাতুল মৌসুমী বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে ছোট কৃষকদের নিয়ে সংগঠন করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে ছোট কৃষকরা কৃষি সম্পর্কে তথ্য পাবেন এবং তারা সামনে এগিয়ে যেতে পারবেন। কৃষকদের প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষিত করা প্রয়োজন।’
কৃষিতে তথ্য ঘাটতি খুব বড় একটি বিষয় উল্লেখ করে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব ইসলাম বলেন, ‘গবেষণায় উৎপাদন এক রকম দেখা যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে হয়তো অন্য রকম। আবার গবেষণায় মান এক রকম দেখালেও ফিল্ডে হয়তো অন্য রকম। এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। কৃষির রূপান্তরে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্তি থাকতে হবে। বহির্বিশ্বে কোন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে।’
এশিয়ান ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর সাসটেইনেবল রুরাল ডেভেলপমেন্টের অপারেশনস ম্যানেজার (দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া) আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে সব পেশাজীবীর সংগঠন আছে, কেবল কৃষকদের নেই। সমবায় ব্যবস্থা আছে ঠিকই, কিন্তু কার্যত অকার্যকর। জাপান, কোরিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডসহ সব দেশেই কৃষক সংগঠন শক্তিশালী, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক। সেখানে সরকার, অর্থ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় সবাই একসঙ্গে কাজ করে। আমাদের দেশে সে সমন্বয় অনুপস্থিত।’
‘জাতীয় কৃষি নীতির বিভিন্ন দিক এবং কৃষি খাদ্য ব্যবস্থা বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণ’ শীর্ষক পলিসি ডায়ালগে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ‘আমরা রিসোর্স প্ল্যানিং করতে চাই। সেখানে নিড ও ডিমান্ড দুটোই থাকবে। সার, সেচ, জৈব কীটনাশক সবগুলোর চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ে পর্যালোচনা করব। আমরা মেকানাইজেশন নিয়ে কাজ করব। তবে হুট করে কিছু করব না। হঠাৎ করে এমন কোনো প্রযুক্তি আনা যাবে না যেখানে কৃষক কর্মসংস্থান হারান। কেননা, তাদের জন্য পর্যাপ্ত বিকল্প পেশার সুযোগ আমাদের হাতে নেই।’
কৃষি সচিব আরো বলেন, ‘জৈব সার আমার খুবই আগ্রহের জায়গা। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার কমানো প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রচারণা দরকার। কৃষকদের বোঝাতে হবে, জৈব সার ব্যবহারের সুবিধা কী কী; পাশাপাশি রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে কী কী অপকারিতা তৈরি হচ্ছে। রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, ক্যান্সার বাড়ছে—এমন নানা সমস্যা নিয়ে প্রচারণা চালাতে হবে।’