ভোক্তার পকেট কাটছে ফড়িয়া-সিন্ডিকেট

November 18, 2025 0 Comments

 

সাহানোয়ার সাইদ শাহীন :

 

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ময়না গ্রামের কৃষক রাজিব শেখ। স্থানীয় সাতৈর বাজারে প্রতিবছর তিনি পেঁয়াজ বিক্রি করেন। গত মৌসুমে তিনি প্রতি মণ পেঁয়াজ এক হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি করেছিলেন। মৌসুমের শেষ দিকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত দাম পেয়েছিলেন।

 

ফলে তিনি মূলত পণ্যটি কেজিপ্রতি বিক্রি করেছেন ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। কিন্তু রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও হাতিরপুল খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি দরে। পেঁয়াজ ব্যবসায় জড়িত মধ্যস্বত্বভোগীরা এখান থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন ৭০ থেকে ৯০ টাকা। সবজি উৎপাদনের জেলা হিসেবে কয়েক বছর ধরে বেশ ভালো করছে যশোর।

 

জেলার সদর সাতমাইল বাজারটির কৃষিপণ্য বিক্রির জন্য সুখ্যাতি রয়েছে। এখান থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বাজারে শাক-সবজি সরবরাহ করা হয়। সাতমাইল বাজারে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতি কেজি পটোল ৫০ টাকা এবং ঢেঁড়স ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ দুটি পণ্য গতকাল রাজধানীতে বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ৮০ ও ১০০ টাকায়।

 

দেশের উৎপাদন পর্যায়ে কৃষকরা কেমন দাম পাচ্ছেন আর ভোক্তা পর্যায়ে কেমন দাম দিতে হচ্ছে, এর পার্থক্য নির্ধারণে তথ্য সংগ্রহ করেছে কালের কণ্ঠ। উৎপাদন পর্যায়ের তথ্যের জন্য যশোরের সাতমাইল, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার জিয়াবাজার, গাজীপুর সদরের বাজার এবং ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর বাজারে সবজি বিক্রির তথ্য নেওয়া হয়েছে।

 

অন্যদিকে রাজধানীর খুচরা পর্যায়ে সবজি বিক্রির তথ্য নিতে কারওয়ান বাজার ও হাতিরপুল বাজারে সবজির দাম যাচাই করা হয়েছে।

 

প্রান্ত ও কেন্দ্রের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কৃষক পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যায়ে সবজির দামের পার্থক্য কেজিতে ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। মুনাফা ও পরিবহন খরচ বাদ দিলে ভোক্তাদের গড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি দামে সবজি কিনতে হচ্ছে।

 

বাজারে সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও অতিমুনাফার কারণে ভোক্তাদের বেশি দামে সবজি কিনতে হলেও কৃষক কম দামে তাঁর পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার কিছু বাজারে অলিখিত কমিটি ছিল। বর্তমানে তারা পলাতক থাকায় সেসব বাজারে এক ধরনের অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। ফলে বাজারে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে দেশের বিভিন্ন বাজারে নতুন করে বাজার কমিটি গঠন এবং বাজার মনিটরিং টিমকে আরো গুরুত্বসহকারে বাজার তদারকির পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

 

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে কৃষক যেমন ন্যায্য দাম পান না, তেমনি ভোক্তাদেরও বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত হাতবদল এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বাড়ায় এসব হচ্ছে। এ ছাড়া দাদন ব্যবস্থার কারণে অনেক কৃষক আগেভাগে তাঁদের পণ্য কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। ফলে কৃষকদের অর্থায়ন সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা যাবে।

 

রাজধানীর পাইকারি বাজারগুলোয় অনেক ব্যবসায়ী সরকার নির্ধারিত পণ্যের নির্ধারিত মূল্য মানছেন না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু ক্ষেত্রে তারা সরকারকে হুমকি দিচ্ছে। কয়েক দিন আগে ডিম বিক্রি বন্ধের ডাক দেয় ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা। এটি অনেক ব্যবসার ক্ষেত্রেই হচ্ছে। এ ধরনের আচরণ আগের সরকারের স্বৈরাচারী ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।
তারা ভাবছে, গত ১৫ বছর তাদের কিছু হয়নি, এখনো কিছু হবে না।

 

এ ধরনের আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। আইন ভাঙলে শাস্তির দৃষ্টান্ত দেখাতে হবে কর্তৃপক্ষকে। শুধু কয়েক দিনের জন্য মনিটর করলে বা কমিটি গঠন করলেই বাজার স্থিতিশীল হবে না। এর জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।

 

উত্তরের দুই জেলা কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের পাইকারি বাজারের তথ্য সংগ্রহ করেছেন কালের কণ্ঠের উত্তরবঙ্গ প্রতিনিধি। সেখানকার কৃষকরা বলছেন, স্থানীয় বাজারগুলোর আড়ত সিন্ডেকেটের কবজায় থাকায় তাঁরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। বাজারে সবজি নিয়ে গেলে আড়তদাররা যে দাম বলেন, সে দামেই তাঁদের বিক্রি করতে হচ্ছে।

কুড়িগ্রাম বাজারে সবজি বিক্রি করতে আসা কৃষক মনু মোহাম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দাম কখন বাড়ে আর কখন কমে আমরা কিছুই বুঝি না, জানি না। আমরা আড়তে আসি মাল বেচি যাই। আজ পেঁপে বেচলাম ২৫ টাকা কেজি দরে।

 

লালমনিরহাট জেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের কৃষক হাসেম মিয়া ৩০ শতক জমিতে চাষ করেছেন দেশি জাতের বেগুন। গতকাল তিনি পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি করেছেন ৫৮ টাকা দরে।

রাজধানীর বাজারের গতকালের দাম জানানো হয় ওখানকার আটজন কৃষককে। কৃষকদের দামের চেয়ে কয়েকটি সবজি প্রায় দ্বিগুণ দামে রাজধানীতে বিক্রি হচ্ছে জেনে কৃষকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হতাশা প্রকাশ করে তাঁরা বলেন, ‘বাজারে দাম নির্ধারণ করার অধিকার আমাদের নেই।

 

কৃষকের পণ্যের দাম ও বঞ্চনার করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে সরকারের বিভিন্ন প্রতিবেদনেও। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ফুড প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিটের (এফপিএমইউ) বাংলাদেশ সেকেন্ড কান্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান (সিআইপি) নিউট্রিশন সেনসিটিভ ফুড সিস্টেম শীর্ষক প্রতিবেদনে দেশের অন্যতম তিনটি কৃষিপণ্য টমেটো, বেগুন ও আলুর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। এই তিনটি পণ্যের ক্ষেত্রে ভোক্তা যে দাম দিয়ে পণ্য কিনছে তার মাত্র ২৭ শতাংশ পাচ্ছে কৃষক। ফলে বাজার মুনাফার বেশির ভাগই চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের পকেটে।

 

বিপণন ও সরবরাহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদিত কৃষিপণ্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করতে অবশ্যই বিভিন্ন পর্যায়ে মধ্যস্বত্বভোগীর প্রয়োজন রয়েছে। তবে এসব ব্যবসায়ী কী মাত্রায় মুনাফা করবেন সে বিষয়ে কোনো তদারকি বা নিয়ম-নীতি নেই। আবার যেকোনো পরিস্থিতিতে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এতে উৎপাদকের পাশাপাশি প্রতারিত হচ্ছে ভোক্তা সাধারণ।

 

কৃষিসচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানো এবং দেশের মানুষের চাহিদা অনুসারে সরবরাহ বাড়ানোর জন্য যে ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন তার সব কটিই বর্তমান সরকার গুরুত্বসহকারে বাস্তবায়ন করছে। বাজার ব্যবস্থাপনায় এরই মধ্যে সরকারঘোষিত কমিটি কাজ শুরু করেছে।

আসছে শীত মৌসুমে আমাদের উৎপাদন বাড়ানোর বড় ধরনের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। শীত পড়া শুরু করলেই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে কৃষিপণ্যের সরবরাহ বাড়বে। তখন পণ্যের দাম আরো কমে আসবে। উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

 

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন কালের কণ্ঠের উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি তামজিদ হাসান তুরাগ, ফরিদপুর, যশোর, রাজবাড়ী প্রতিনিধি]

Leave A Comment

To Top