বাংলাদেশে কেন বাঘ বেড়েছে?

July 29, 2024 0 Comments

বাঘ আছে এমন ৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সাতে

বাঘ মৃত্যুর অভয়ারণ্য পূর্ব সন্দরবন

২৩ বছরে ৪২ টি বাঘের মৃত্যু

সাইদ শাহীন  

২০১৯ সালে বাঘ জরিপের তথ্য প্রকাশ করা হয়। সেই জরিপে বাংলাদেশের বাঘের সংখ্যা উঠে আসে ১১৪টি। বাঘের সংখ্যা জানতে জরিপ শেষ হলেও তথ্য পর্যালোচনার চুড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সেই জরিপের প্রাথমিক তথ্যে বাংলাদেশে এবারে বাঘের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী মাসের শেষের দিকে চুড়ান্ত তথ্য প্রকাশ করা হবে। জানা গেছে, ২৯ জুলাই পালিত হবে বিশ্ব বাঘ দিবস। বাঘ টিকে আছে বিশ্বে এমন ১৩টি দেশে ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর এ দিনটি বিশ্ব বাঘ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। যদিও চারটি দেশে ইতোমধ্যে বাঘ বিলুপ্তি হয়েছে এবং একটি দেশে বিলুপ্তির পথে। প্রতি বছর দিবসটিকে ঘিরে বাংলাদেশের বন অধিদপ্তর একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে থাকে। তবে দেশে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও বাঘ গনণা জরিপ কাজ শেষ না হবার কারনে এবারের অনুষ্ঠান পিছিয়ে আগষ্টের শেষ সপ্তাহে করা হতে পারে। এবারের বাঘ দিবসের প্রতিপাদ্য বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে এমন বিষয়কে বিবেচনায় নিয়েই তৈরি করা হয়েছে। এজন্য প্রতিবেদন প্রকাশ করার সময় আনুষ্ঠানিকভাবে বাঘ দিবস পালনের দিন এ প্রতিপাদ্য প্রকাশ করা হবে।

 

বিভিন্ন সময়ে বাঘের পরিমান:

জানা যায়, ২০০৪ সালে দেশে বাঘের সংখ্যা ছিলো ৪৪০ টি, যার মধ্যে ১২১ টি পুরুষ, ২৯৮ টি স্ত্রী এবং ২১ টি বাচ্চা ছিলো। ২০০৯ সালে ৩০০-৫০০ টির বাঘের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিলো বলে বন অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছিলো। যদিও পরবর্তীতে ২০১০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে দেশে বাঘের সংখ্যা নির্নয় হয় ২৫০ টি। আর ২০১২ সালে ডব্লিউটিপির জরিপে জানা গেছে দেশে এক দশকে বাঘের সংখ্যা ৭০ শতাংশ কমে গেছে বলে জানানো হয়। এরপর ২০১৫ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা কমে দাড়ায় মাত্র ১০৬ টি। অন্যদিকে ২০১৭ সালে ১২১ টি পাওয়া গেলেও ২০১৯ সালে তা ছিলো ১১৪ টি। তবে গনণাগত পদ্ধতির কারনে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ নিয়ে বড় তারতম্য দেখা দিয়েছে। ২০১৫ এবং ২০১৯ সালে বাঘের গননা ক্যামেরা ট্রাপিং এর মাধ্যমে পরিচালানা করা হয়। অন্যদিকে ২০১৭ সালে মূলত ডিএনএ পদ্ধিতিতে গননা করা হয়। কার্যকরভাবে বাঘ আছে এমন ৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সাতে। তবে চলতি বছরের জরিপ তথ্য প্রকাশ পেলে বাংলাদেশের অবস্থান এগিয়ে আসতে পারে।

 

বাঘ বৃদ্ধির কারন:

বাঘের গননায় ক্যামেরা ট্রাপিং এর মাধ্যমে বাঘ গণনার অন্যতম পদ্ধতি হলো বাঘের পায়ের ছাপ গননা ও সেই তথ্য বিশ্লেষন করা। জরিপের সঙ্গে জড়িত গবেষকরা জানিয়েছেন, গত জরিপের পাওয়া বাঘের পায়ের ছাপের তুলনায় এবারে সেটি ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দেখা যাচ্ছে। এছাড়া সুন্দরবনের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত নৌ চলাচলের কারনে বাঘের আবাস স্থল দুইভাবে বিভক্ত হয়ে যায়। এর ফলে একপাশের বাঘ অন্য পাশে যেতে পারে না। এতে হুমকিতে পড়ে বাঘের জীবন চক্র। এছাড়া কভিড-১৯ এর কারনে সুন্দরবনে পর্যটকদের চলাচল সীমিত ছিলো প্রায় দুই বছর। এমনকি সুন্দরবনে মাছ ও পাতা আহরনেও সীমাবদ্ধতা ছিলো। গত দুই বছর নিয়িন্ত্রতভাবে পর্যটক প্রবেশ করেছে। এতে বনের মধ্যে বাঘ নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলাচল করতে পেরেছে। বনের মধ্যে বাঘের খাবার বেশি তৈরি হয়েছে। তেমনি বাঘের প্রজনন নির্বিঘ্ন হয়েছে। বাঘের অন্যতম খাবার হলো হরিণ। এই হরিণ প্রায় ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া অনান্য প্রানীর মধ্যে বন্য শুকর ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতিক সময়ে সন্দরবন ঘুরতে যাওয়া পর্যটনকরাও বাঘের চলাচল কিংবা নদী পাও হওয়ার চিত্র বেশি দেখতে পেয়েছেন।

 

এ বিষয়ে বন অধিদফতরের প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারনে আমরা বাঘ দিবসের অনুষ্ঠান পিছিয়ে দিয়েছি। আমাদের বাঘ জরিপের প্রাথমিক তথ্যে বাঘের পরিমান বাড়তে পারে বলে প্রাথমিক তথ্য এসেছে। জরিপকালীন সময়ে বাঘের পায়ের চিহ্ন অনেক বেশি দেখা গেছে। আমাদের জরিপ তথ্য বলছে এই সময়ে বাঘের খাবার দ্বিগুনের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাঘের ব্রিডিং বেশি হয়েছে।

বাঘ সুরক্ষায় বণ অধিদপ্তর সর্বোচ্চ কার্যক্রম পরিচালনা করছে জানিয়ে তিনি বলেন, বন অধিদফতর ও স্থানীয় বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনরে টিম গঠন করে স্মার্ট পেট্রোলিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কমিউনিটি অংশগ্রহন বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া বাঘের প্রজনন, বংশ বৃদ্ধিসহ অবাধ চলাচলের জন্য সুন্দরবনের আয়তনের ২৩-৫২ ভাগ এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বাঘ রক্ষায় বন বিভাগের পাশাপাশি কোস্টগার্ড ও র্যাবের তত্পরতা বাড়ানো হয়েছে। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাসহ বাঘের অস্তিত আরো বাড়াতে সব পদক্ষেপই গ্রহন করা হচ্ছে।

 

বাঘের মৃত্যু:

গত ৩০ এপ্রিল বিকেলে খুলনার দাকোপ উপজেলাধীন সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের আন্ধারিয়া খাল থেকে ভাসমান অবস্থায় বাঘের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে বন বিভাগ। পুরুষ প্রজাতির বাঘটির আনুমানিক বয়স ছিলো ১১ বছর। এরপর গত ১ মে বাঘটির ময়নাতদন্ত রিপোট প্রকাশ করা হয়। বাঘটির দেহে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। বাঘটি রোগাক্রন্তও ছিলো না বলে প্রমান মিলেছে। দাবদাহে বাঘটি হিট স্ট্রোকে বাঘটি মারা গেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করে বন বিভাগ। এর আগে চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারী পূর্ব সুন্দরবনের আওতাধীন বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার কচিখালীর একটি খাল থেকে এক বাঘের মরদেহ উদ্ধার করে বন বিভাগ। এভাবেই ২০০১ থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ২৩ বছরে সুন্দরবনে নানাভাবে ৪২টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে ২৬টি এবং পশ্চিম বিভাগে ১৬টি। ফলে সন্দরবনের পূর্ব এলাকা বাঘের মৃত্যুর অভয়ারণ্যে পরিনত হয়েছে।

 

বাঘের অঙ্গের চোরাচালান:

বন্য প্রাণীর বাণিজ্য নজরদারি সংগঠন ‘ট্র্যাফিক’ এর প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০০০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫৩ টি চোরা শিকারের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ৩৩ টি বাঘের অপমৃত্যু হয়েছে। তাছাড়া বাঘের অঙ্গ-প্রতঙ্গ, চামড়া, হাড়, দাঁত, নখ পাচার হচ্ছে। গত ২২ বছরে ৩৬ টি বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জব্দ ও ৫০ টি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে বাঘের জব্দ ও অবৈধ বাণিজ্যে ২৩ টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৫২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, চার্জশিট আনা হয়েছে ৪৩ জন এবং জরিমানা করা হয়েছে ৪ জন এবং জেল দেওয়া হয়েছে ৬ জনকে। সারা বিশ্বে বাঘের যে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জব্দ বা বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে তার মধ্যে বাংলাদেশ নবম অবস্থানে রয়েছে। বন্যপ্রাণী আইনের ৩৬ ধারায় বলা হয়েছে, বাঘ শিকারি বা হত্যাকারী জামিন-অযোগ্য হবেন এবং সর্বোচ্চ ৭ বছর সর্বনিম্ন ২ বছর কারাদন্ড এবং জরিমানা এক লাখ থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। তাই এ আইনটিও অপরাধীদের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতা স্পস্ট।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের বাঘ রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা আরো বেশি বাড়াতে হবে। এছাড়া চোরা শিকারিকে শুণ্যে নামিয়ে আনতে বন অধিদফতরকে আরো বেশি শক্তিশালী করতে হবে। এ সংক্রান্ত আইনের সংশোধন করে আরো বেশি বাস্তবায়ন উপযোগি করতে হবে। প্রয়োজনে বন অধিদফতরে স্পেশাল ফোর্স নিয়োজিত করতে হবে। পাশাপাশি অবাধে এ অঞ্চলে শিল্প স্থাপন নিরুত্সাহিত করা এবং নদীর ভিতর দিয়ে নৌ চালাচলকে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। বাঘ যাতে সুন্দরবন ছেড়ে লোকালয়ে বের হতে না পারে এ জন্য বনের সীমানা এলাকায় বন বিভাগের টহল বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। যদিও ইতোমধ্যে সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

এ বিষয়ে ওয়ার্ল্ড কনসারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পাচারের ক্ষেত্রে অস্ত্র ও ড্রাগের পরই রয়েছে বন্যপ্রাণী। বন্যপ্রাণী নিয়ে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্ কালো বাজার চলছে। এ বাজারে প্রতিবছর বিলিয়ন ডলার আদান-প্রদান হচ্ছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে বাংলাদেশে বন্যপ্রাণীর বড় অংশ আজ বিলুপ্ত প্রায়। বন্যপ্রাণী শিকার, পাচার এবং পণ্য হিসেব ব্যবহারের জন্য এশিয়া একটি বৈশ্বিক হটস্পট। বাংলাদেশের বাঘের রক্ষা ও চোরাচালান প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন স্থানীয় জনগনের সহযোগিতা। এজন্য সরকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি করতে হবে। কমিউনিটি ভিত্তিক সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।

 

বৈশ্বিক বাঘ পরিস্থিতি:

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যারয়ের প্রানীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ আজিজ তার গবেষনায় দেখিয়েছেন, বিশ্বে এক সময় ৯ প্রজাতির বাঘ বিরজমান ছিলো। তবে ইতোমধ্যে ৩ টি প্রজাতির বাঘ বিলুপ্তি হয়েছে। জাভান, কাসপিয়ান প্রজাতি সম্পূর্ণ বিলুপ্তি হলেও সাউথ চাইনা টাইগার বিলুপ্তির পথে রয়েছে। ১৯৪০ সালে সারা বিশ্বে প্রায় ৬০ হাজার বাঘ ছিলো। তবে ২০১৮ সালে তা নেমে আসে ৪ হাজার ৭৪৮ টিতে। এর মধ্যে ভারতেই রয়েছে ২ হাজার ৯৬৭ টি। এছাড়া রাশিয়াতে ৫১০ টি, ইন্দোনেশিয়াতে ৩৭১ টি, মালয়শিয়াতে ২৫০ টি, নেপালে ২৩৫ টি, থাইল্যান্ডে ১৮৯ টি, বাংলাদেশে ১১৪ টি, ভূটানে ১০৩টি এবং চীনে ৭ টি। বিশ্বের পাচটি দেশে বাঘ প্রায় কিংবা পুরোপুরি বিলুপ্তি হয়েছে। এর মধ্যে মিয়ানমার বাঘ শূন্য হয়েছে, লাওসে ২টি বাঘ রয়েছে এমন তথ্য ৫ বছর আগে দিলেও এখন তারা আপডেট নেই, অন্যদিকে কম্বোডিয়াতে ২০১৭ সালে এবং ভিয়েতনাম ১৯৯৭ সালে বাঘ বিলুপ্তি এমন ঘোষনা দিয়েছে। তবে চীনেও বিলুপ্তির পথে রয়েছে।

Leave A Comment

To Top