গত কয়েক দিনের তুলনায় মোকামে ইলিশের দাম কিছুটা কমেছে। চাঁদপুরে সম্রাট বেপারী নামের একজন মাছ ব্যবসায়ী কালের কণ্ঠকে জানান, চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনায় ধরা দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের ইলিশ এক হাজার ৬০০ টাকা থেকে এক হাজার ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নোয়াখালীর দক্ষিণ হাতিয়া থেকে ইলিশের চালান নিয়ে আসা আলমগীর হোসেন জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় জেলেরা গভীর সাগরে যেতে পারছেন। তাঁদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ছে। ভোলার চরফ্যাশনের মাছ বেপারী রহমত আলী জানান, এবার মাঝারি ও ছোট আকারের ইলিশ বেশি ধরা পড়ছে।
সাগরে সম্প্রতি সৃষ্টি হওয়া নিম্নচাপের পর থেকে বেশ বড় ইলিশও পাওয়া যাচ্ছে। জেলেরা খুব খুশি। ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের তুলাতুলি মাছ ঘাটে জেলে মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, গত ১৫ বছরেও এত বড় ইলিশ দেখা যায়নি মেঘনা নদীতে। এ বছর নদীতে মাছ কম থাকলেও মাঝেমধ্যে জালে আড়াই থেকে তিন কেজি ওজনের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।
ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্যাহ কালের কণ্ঠকে জানান, সাগরে প্রচুর বড় বড় ইলিশ ধরা পড়ছে। এ মাছের কিছু কিছু মাঝেমধ্যে মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীতেও দেখা যায়। তবে সংখ্যায় কম। মেঘনা-তেঁতুলিয়ায় ইলিশ ধরা না পড়ার কারণ অনাবৃষ্টি ও নদীর গভীরতা কমে যাওয়া বলে মনে করছেন তিনি। তাঁর মতে, সাগর মোহনায় ডুবোচরের কারণে মাছ নদীতে আসতে পারছে না। নদী থেকে অবৈধ জাল অপসারণে মৎস্য বিভাগ অভিযান চালাচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক অবৈধ জাল জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে।
মোকামে দাম কমেছে
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল বারী জমাদার মানিক কালের কণ্ঠকে জানান, বাজারে ইলিশের চাহিদা রয়েছে, সরবরাহও ভালো। গত মঙ্গলবার চাঁদপুরের বড়স্টেশনের পাইকারি বাজারে আকারভেদে ইলিশের মণ ছিল ২৪ থেকে ৬৪ হাজার টাকা, যা গত সপ্তাহের চেয়ে চার থেকে ছয় হাজার টাকা কম।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মহিপুর মৎস্য আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি দিদার উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশের প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৬৮ থেকে ৭০ হাজার টাকা। ৭০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৫ হাজার টাকায়। এর ছোট ইলিশ ২২ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সৈয়দ আরিফ আজাদ বলেন, ইলিশ মাছ ধরায় যে পাঁচ লাখ জেলে পরিবার নিয়োজিত আছে, তাদের আর্থিকভাবে শক্তিশালী করতে হবে। দাদন কিংবা মহাজনদের কাছে নিষ্পেশিত হওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে। মাছ ধরা বন্ধের সময়ে জেলেদের সুরক্ষায় আরো কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। মাছের উৎপাদন বাড়াতে নদীকেন্দ্রিক যে সুব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
ইলিশ উৎপাদনে বাধা ও বিচরণক্ষেত্র বদল
দুই দশক আগেও দেশের মাত্র ২৪টি উপজেলার নদীতে ইলিশের বিচরণ ছিল। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়। কিন্তু সাগর মোহনায় নদীতে জেগে ওঠা চর ইলিশের পথ আটকে দিচ্ছে। আবার ইলিশের ছয়টি অভয়াশ্রমের আশপাশে গড়ে উঠছে নানা অবকাঠামো। এতে ইলিশের বিচরণক্ষেত্রও বদল হচ্ছে।
সামুদ্রিক মাছ ইলিশ ডিম পাড়ার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিত বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতের নদীগুলোকে। একসময় ইলিশের প্রজননের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থান ছিল দেশের নদীগুলোর উজান অংশ। সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রজননক্ষেত্র পরিবর্তন হয়ে নেমে এসেছে ভাটির দিকে; বিশেষ করে হাতিয়া ও সন্দ্বীপ অঞ্চলে। উজানের অনিরাপত্তাই মাছটির প্রজননক্ষেত্র পরিবর্তনের প্রধান কারণ।
এ ছাড়া সাগরের পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ইলিশ নদীতে আসতে দেরি হচ্ছে। বৃষ্টিও কম হয়েছে এবার। বৃষ্টি ও তাপমাত্রার এ ধরনের আচরণে ইলিশের পেটে ডিম আসার সময় পিছিয়ে গেছে। ইলিশের জীবনচক্রে পরিবর্তন এসেছে।
ইলিশের আকারেও পরিবর্তন আসছে। এ অবস্থায় মাছটির প্রজননস্থল ও অভয়াশ্রমগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে উৎপাদন কমতে পারে।
চাঁদপুর, বরিশাল ও শরীয়তপুর জেলার সীমানাসংলগ্ন মেঘনায় কয়েক বছর ধরে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি বিদ্যমান অভয়াশ্রমগুলোর আশপাশের শাখা নদীতেও মাছ পাওয়ার হার বেড়েছে। পদ্মায় ইলিশের বিচরণ বেড়েছে। একইভাবে যমুনার বিভিন্ন স্থানেও এখন ইলিশের বিচরণ বাড়ছে। এ বিচরণক্ষেত্রগুলোর আরো বেশি সুরক্ষা দেওয়া গেলে মাছের উৎপাদন অনেকখানিই বাড়বে।
উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) ‘জাটকা ও ইলিশের প্রাচুর্যতা ও বিচরণক্ষেত্র রক্ষা এবং জেলেদের বিকল্প আয়ের উপায় নির্ধারণ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রজনন মৌসুমে প্রায় দেড় কোটির বেশি মা মাছ ধরা হয়। আর প্রতিবছর দেশের নদীগুলো থেকে ৩৫ কোটির বেশি জাটকা মাছ ধরা হয়। এসব জাটকা ইলিশের স্বাভাবিক বৃদ্ধির সুযোগ দিলে ইলিশের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। আশার বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে জাটকা বিষয়ে বেশ সচেতনতা অর্জিত হয়েছে।