প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বড় চার বাধা

July 27, 2024 0 Comments

দেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য ও কৃষিপণ্য রপ্তানিতে চারটি বড় বাধা রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা কমে যাওয়া, পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়া, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় উপকরণ খরচ বেশি হওয়া এবং পর্যাপ্ত বন্দর সুবিধা না পাওয়া।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসব সমস্যার কারণে রপ্তানির ক্ষেত্রে শুধু ব্যয়ই বাড়েনি, সময়ও বেশি লাগছে।

প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য ও কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এর আগে প্রায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ প্রণোদনা ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের জুন মাসের প্রজ্ঞাপনে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা কমিয়ে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত করা হয়েছে, যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে। আবার ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশ হবে বাংলাদেশ। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর রপ্তানিতে নগদ সহায়তা বন্ধ হবে। এই প্রণোদনা প্রত্যাহার করা হলে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য ও কৃষিপণ্যের শিল্প বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এর মধ্যে কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রপ্তানি কমেছে।

প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য ও কৃষিপণ্য রপ্তানিকারক ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কথা বলে জানা গেছে, উন্নত বিশ্বে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এর ধারাবাহিকতায় গত কয়েক দশকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য ও কৃষিপণ্য রপ্তানি বেড়ে যায়। এ ছাড়া আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায়ও রপ্তানি হচ্ছে। এসব দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিসহ দক্ষিণ এশীয় প্রবাসীরা বাংলাদেশি পণ্যের মূল ভোক্তা। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ অর্থ সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিলো, নগদ সহায়তার সর্বোচ্চ হার ১৫ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ০.৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়ছে। এই সিদ্ধান্ত ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কার্যকর হবে। অর্থাৎ প্রতিনিয়তই নগদ প্রনোদনার পরিমান কমানো হচ্ছে। যদিও রপ্তানি প্রণোদনার কারণে কয়েক বছর ধরে এই খাতে রপ্তানি আয় বাড়লেও নানা প্রতিবন্ধকতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানিতে যেমন সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি বড় ধরনের চারটি প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বাড়তি ফ্রেইট চার্জ (পণ্য জাহাজীকরণের ভাড়া) দেশের প্রক্রিয়াজাত শিল্পের জন্য বড় বাধা। প্রতিবেশী দেশগুলোতে এই ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে। বাংলাদেশে এই বাড়তি ব্যয়ের জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে। রপ্তানির বিকল্প পরিবহন হিসেবে উদ্যোক্তারা যখন আকাশপথ বেছে নেন, তখন আরেক বিপাকে পড়েন তাঁরা। বিমানে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় জায়গা না পাওয়া এবং বিমানবন্দরে হিমাগারের পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকা বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।

আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দরগুলোতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুুবিধার অভাবে রপ্তানিকারকদের পণ্য রপ্তানিতে সময় বেশি লাগছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বাংলাদেশের উপকরণ ব্যয় বেশি। এর পাশাপাশি বিভিন্ন পণ্যের প্রয়োজনীয় পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগারের অভাব, বিভিন্ন কৃষিপণ্যের ভালো জাতের অভাব, ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট প্রাপ্তিতে জটিলতা, দুর্বল প্যাকেজিং পণ্য রপ্তানিতে বাধা হিসেবে কাজ করছে। তাই প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের রপ্তানি বাড়াতে উত্তম কৃষি চর্চা (জিএপি) ও উত্তম উৎপাদন চর্চা (জিএমপি) বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। পণ্যের মান ঠিক রাখতে দেশে পণ্যের শনাক্তকরণ (ট্রেসিবল) পদ্ধতির উন্নতি ঘটাতে হবে। কৃষিপণ্য রপ্তানি উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষিজাত ও মৎস্যজাত সব পণ্যের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২০২ কোটি ৮১ লাখ ডলার। সেখানে রপ্তানি আয় হয়েছে ১২৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। এর মধ্যে শুধু কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার। কিন্তু আয় হয়েছে প্রায় ৮৪ কোটি ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৩৯ শতাংশ কম। আবার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষিজাত পণ্য ও মৎস্যজাত সব পণ্যের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪২ কোটি ডলার। সেখানে ১১ মাসে আয় হয়েছে ১২০ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। ফলে লক্ষ্যমাত্রা থেকে এখনো প্রায় ১৫ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে। আগের অর্থবছরের তুলনায় লক্ষ্যমাত্রাও কমানো হয়েছে। ফলে প্রণোদনা কমার বিরূপ প্রভাব ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার কারণে রপ্তানি কমতে শুরু করেছে। তবে কয়েক বছর ধরেই প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের রপ্তানির বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।

এ বিষয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা পার্শ্ববর্তী ও আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় উৎপাদন খরচে পিছিয়ে রয়েছি। কনটেইনার ও ফ্রেইট চার্জ এখন দ্বিগুণ বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বন্দর সুুবিধার অভাবে পণ্যটি গন্তব্যে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিযোগী দেশের তুলনায় উপকরণ ব্যয় বেশি। স্ন্যাকসজাতীয় পণ্য তৈরিতে চিনি ও আটার প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ দুটি পণ্য পাশের দেশের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দামে কিনতে হয়। নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে পণ্য পৌঁছাতে আমাদের খরচ বেশি হচ্ছে। এ অবস্থায় রপ্তানি প্রণোদনা একবারেই উঠিয়ে দেওয়াটা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। তাই রপ্তানি প্রণোদনার বিকল্প হিসেবে এই খাতে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনা প্রয়োজন। উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে বন্দর সুবিধা বাড়ানোর এবং উপকরণ খরচ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী বিকল্প সুবিধা বাস্তবায়নে নজর দিতে হবে।’

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য খাতের সম্ভাবনা নিয়ে গত বছর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ২০২২ সালে কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক বাজার ছিল ১৩ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। আর বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বাজার (দেশীয় চাহিদা ও রপ্তানি) ছিল ৪৮০ কোটি ডলার। সেখানে ভিয়েতনাম ও ভারতের বাজার প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে। এ ছাড়া কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানিতে দেশ দুটি নেতৃত্ব দিচ্ছে। প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা সম্ভব হলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।

Leave A Comment

To Top