পেঁয়াজের ফলন ও দাম নিয়ে উদ্বেগে কৃষক

November 14, 2025 0 Comments

 

সাহানোয়ার সাইদ শাহীন :

ফরিদপুরের সালথা উপজেলার জয়কালী গ্রামের কৃষক আমিনুল ইসলাম এবার ৫২ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেন। গত বছর প্রায় ৯০ মণ ফলন পেলেও এবার পেয়েছেন ৫০ মণ। গত বছর প্রায় দুই হাজার টাকা মণ বিক্রি করলেও এবার বিক্রি করছেন এক হাজার ২০০ টাকা করে। একদিকে ফলন কম, তার ওপর দামও কম।পেঁয়াজ নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।

 

ফরিদপুরের বেশির ভাগ পেঁয়াজ চাষি এ বছর এই নিত্যপণ্য নিয়ে আমিনুল ইসলামের মতো বিপাকে পড়েছেন। অথচ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পেঁয়াজ উৎপাদনকারী জেলা হিসেবে সুনাম রয়েছে ফরিদপুরের। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক বছরে সারা দেশে পেঁয়াজের দাম কমেছে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ।

 

চাষিরা বলছেন, বীজ প্রতারণা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এবার ফলন কম। প্রতি বিঘা জমিতে কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে আট থেকে ১০ হাজার টাকা।

 

এ ব্যাপারে কালের কণ্ঠকে আমিনুল ইসলাম বলেন, মৌসুমের শুরুতে ভর্তুকির পেঁয়াজ বীজ নিয়ে অনেক কৃষক প্রতারিত হন। পরে সরকার পুনরায় কৃষকদের বীজ দিয়েছে।

 

কিন্তু এবার বৃষ্টিপাত কম হওয়ায়, বালাইনাশক ও ওষুধের দাম বেশি হওয়ায় এবং পোকায় আক্রমণের কারণে ফলন কম হয়েছে। পেঁয়াজ তোলার সময় শ্রমিকপ্রতি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে এ বছর উৎপাদন খরচ তোলা কষ্ট হবে।
ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার হাসামদিয়া গ্রামের কৃষক কওসার মজুমদার বলেন, ‘এ অঞ্চলের কৃষকদের এ বছর এক পাখি (৩০ শতাংশ) জমিতে ৪০ মণের বেশি পেঁয়াজ হচ্ছে না। প্রতি পাখি জমিতে ৩২ থেকে ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

 

কৃষকের ঘাটতি পূরণ করতে হলে পেঁয়াজের দাম দুই হাজার টাকার ওপরে হওয়া প্রয়োজন। সরকারের কাছে আমরা পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বাংলাদেশে দুই ধাপে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। মুড়িকাটা বা মূলকাটা পেঁয়াজ গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ নামে পরিচিত। অন্যটি শীতের পেঁয়াজ। পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বেছে নেওয়া হয় গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজকে। দুই মৌসুম মিলে গত অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৬ লাখ টন। উৎপাদন হয়েছিল ৩৪ লাখ ১৭ হাজার টন।
দেশের পেঁয়াজের বেশির ভাগ উৎপাদন হয় এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাই মাসে। এ ছাড়া স্বল্প পরিমাণে পেঁয়াজের উৎপাদন হয় নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে। ফলে অন্য সময় আমদানি করা পেঁয়াজের ওপর নির্ভর করতে হয়।

 

ফসল তোলার পর ক্ষতি বা পচে যাওয়া, সংরক্ষণ করতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণে দেশের পেঁয়াজ উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ বাদ দিতে হয়। ফলে গত অর্থবছরে প্রকৃত উৎপাদন ছিল ২৪ লাখ টন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সঙ্গে ডিএইর পেঁয়াজ উৎপাদনের তথ্য নিয়ে আবার গরমিল রয়েছে। ফসল-উত্তর ক্ষতি বাদ দিলে দুটি সংস্থার উৎপাদনের তথ্য প্রায় কাছাকাছি থাকে। দেশে পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে প্রায় ৩২ থেকে ৩৫ লাখ টন। প্রতিবছর দুটি সময়ের জন্য পেঁয়াজ বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। সে সময় দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ মায়ানমার, তুরস্ক, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি বাড়াতে হয়। অনেক সময় পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারতের একতরফা নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে।

 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ফরিদপুরের উপপরিচালক কৃষিবিদ শাহাদুজ্জামান বলেন, ‘এটা ঠিক যে পেঁয়াজের দামে খুব একটা খুশি না চাষিরা। কারণ বাজারে পেঁয়াজের জোগান বেড়েছে অনেক, সে তুলনায় ক্রেতার চাহিদা কম থাকায় দাম পড়ে গেছে। এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও চাষাবাদ হয়েছে বেশি। তবে বৃষ্টিপাত কম থাকায় সেই পরিমাণ ফলন হয়নি। এই মুহূর্তে পেঁয়াজ বিক্রি না করে কয়েক মাস সংরক্ষণ করে পরে বিক্রি করলে কৃষকরা ভালো দর পাবেন বলে আশা করছি।’

 

বিশ্লেষকরা বলছেন, পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সারা দেশে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ বাড়াতে হবে। উচ্চফলনশীল বিভিন্ন জাত, বিশেষ করে বারি-৫ জাতের পেঁয়াজের চাষ সারা দেশে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া কৃষকের আর্থিক সুবিধা দিতে স্বল্প সুদে কৃষিঋণ বিতরণ করা এবং মৌসুুমে ভালো দামের নিশ্চয়তা দিতে হবে। আমদানিতে দুটি দেশ নির্ভরতার পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য এবং বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে তদারকির অভাব ও নানা দুর্বলতা কাটাতে হবে।

 

উৎপাদনে ঘাটতি থাকায় দেশের চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর গড়ে আট থেকে ১০ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। তবে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারলে কৃষক ও ভোক্তা উভয় লাভবান হতেন। পেঁয়াজ সংরক্ষণের প্রক্রিয়া জটিল। স্থানীয় পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করলে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত শুকিয়ে যায়। পেঁয়াজ পচনশীল পণ্য বলে স্বাভাবিকভাবে মজুদ করে রাখা যায় না। সহজে মজুদ করে রাখতে পারলে পেঁয়াজ নিয়ে সংকট হতো না। পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানো ও ভোক্তাদের দামে স্বস্তি দিতে হলে মজুদ ও সংরক্ষণাগার সুবিধা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ অনেকটা নিরাপদ।

 

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাজবাড়ীর উপপরিচালক ড. মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, এবার মৌসুমের শুরুতে আবহাওয়া অনুকূলে ছিল না। এর পরও আবাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমি আবাদ হওয়ায় উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সমস্যা হবে না। মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদন করে কৃষক সামান্য লাভবান হয়েছেন। তবে হালি পেঁয়াজ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারলে চাষিরা লাভবান হবেন।

 

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন ফরিদপুর ও রাজবাড়ী প্রতিনিধি)

Leave A Comment

To Top