দেশে সব ধরনের কৃষিশস্যের উৎপাদন ১০ কোটি টন!

November 16, 2025 0 Comments

 

 

সাহানোয়ার সাইদ শাহীন : 

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন হয়েছে প্রায় চার কোটি সাত লাখ টন। কিন্তু মার্কিন কৃষি বিভাগ বলছে, বাংলাদেশে চালের উৎপাদন ৩৭ লাখ টন বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে। গত মৌসুমে চালের প্রকৃত উৎপাদন ছিল তিন কোটি ৭০ লাখ টন। শুধু চাল নয়, প্রায় প্রতিটি কৃষিশস্যের ক্ষেত্রে উৎপাদনের তথ্য বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা রয়েছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার।

 

রাজধানীসহ সারা দেশে চড়া দামে আলু বিক্রি হতে দেখা গেলেও সরকারের তথ্যে বলা হচ্ছে, পণ্যটির উৎপাদন কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। নানা সংকট ও প্রতিবন্ধকতার কারণে পাটের আবাদ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু সেই পণ্যটির উৎপাদনও ১৩ শতাংশের বেশি বেড়েছে বলে জানিয়েছে বিবিএস।

 

গত দুই বছর বাংলাদেশকে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়েছে।

দুর্যোগের সেই প্রভাব যেন শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। অসত্য তথ্য দেওয়ার কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হচ্ছে সরকারের অন্য সংস্থাগুলোকে। এর ফলে বাজার অস্থিতিশীল হচ্ছে, ভোক্তা প্রতারিত হচ্ছে আর কৃষক তাঁর ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে সব ধরনের শস্যের উৎপাদন ছাড়িয়েছে ১০ কোটি আট লাখ টন।

 

এই উৎপাদনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ১০ কোটি টনের মাইলফলক অর্জন করেছে। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব ধরনের শস্যের উৎপাদন ছিল ৯ কোটি ৭৪ লাখ টন। কিন্তু শস্যের উৎপাদন ও অর্জনের এই তথ্যের সঠিকতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম কৃষি ক্ষেত্রে তথ্য চুরি এবং শস্যের উৎপাদন বাড়তি দেখানোর কঠোর সমালোচনা করেছেন।
মোহাম্মদ শফিকুল আলম বলেন, ‘আমাদের বলা হচ্ছে আলুর উৎপাদন এত টন হয়েছে।

 

তাহলে সেই আলু গেল কোথায়? আলুর হিমাগারে সেই আলু নেই কেন? আর এই না থাকার তথ্য যখন বাজারে যাচ্ছে, ঠিক তখনই ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। এমন সব জায়গা রয়েছে যেখানে আদৌ কৃষি হচ্ছে না, কিন্তু সেখানকার কৃষি কর্মকর্তা বছরের পর বছর কৃষির উৎপাদন বাড়ছে বলে তথ্য পাঠাচ্ছে। এর প্রতিফলন সার্বিক উৎপাদনের তথ্যে এসেছে। এগুলো ভয়াবহ চুরির তথ্য। গত সরকার পরিকল্পিতভাবে চুরির অর্থনীতির মধ্যে দেশকে ঠেলে দিয়েছিল।

 

গত সরকার দেশকে ১৯৭৪ সালের পরিস্থিতির মধ্যে রেখে গেছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘ওই সময় বলা হয়েছিল চাল আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে চাল সরকারের কাছে ছিল না। উল্টো ওই সময়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতারা চাল অবৈধভাবে মজুদ করেছিল। ফলে দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল।

 

খাদ্য নিয়ে এত বড় বিপর্যয় আর বাংলাদেশে আসেনি। বর্তমানে চালের তথ্য যেটি বলা হচ্ছে সেটি আসলে সঠিক তথ্য নয়। ফলে বর্তমানে আমরা এমন জায়গায় আছি যে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। তবে প্রকৃত তথ্যটা কী, সেটা জেনে সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করছে। এ জন্য চালের আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ভোক্তা ও কৃষককে বাঁচাতে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আগের সরকারের কাঠামোগত সব ধরনের কার্যক্রম সংস্কার করা হবে।

 

বিবিএস বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিভিন্ন শস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ। পাটের উৎপাদনে বড় ধরনের বৃদ্ধি ছাড়াও ধানের উৎপাদন বেড়েছে ৪.০১ শতাংশ। ভুট্টা ৬.৮৭ শতাংশ, আলু ১.৬২ শতাংশ এবং ফলজাতীয় শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৬.৪৯ শতাংশ।

 

মোট উৎপাদনের এই ছয় জাতীয় কৃষিপণ্যের অবদান প্রায় সাড়ে আট লাখ টন বা মোট উৎপাদনের প্রায় ৮৪ শতাংশ। তবে একক পণ্য হিসেবে ধান-চালের উৎপাদন এখনো শীর্ষে রয়েছে। মোট উৎপাদনে ধানের অবদান প্রায় ৬০ শতাংশ। এ ছাড়া আলুর উৎপাদন এক কোটি ছয় লাখ টন এবং ভুট্টার উৎপাদন প্রায় ৪৯ লাখ টন হয়েছে। দেশে সব ধরনের ফলের উৎপাদন ৬০ লাখ টন ছাড়িয়েছে বলে জানাচ্ছে বিবিএস।

 

এ ছাড়া গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের সবজি, আখ ও চিনিজাতীয়, ডালজাতীয়, তেলজাতীয়, মসলাজাতীয়, তুলা, মিষ্টি আলু, ঘাস ও তুঁত, পান ও সুপারি, তামাক, চা, ফুলজাতীয় শস্যের উৎপাদনকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এই কয়েকটি পণ্যের উৎপাদন এখনো চূড়ান্ত করা যায়নি। তবে কৃষিপণ্যের উৎপাদন তথ্য বাড়িয়ে দেখানো এখনই বন্ধ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

 

এ বিষয়ে সাবেক কৃষিসচিব আনোয়ার ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কয়েক দশক ধরে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে দেখানোটা একটি অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। সরকারকে এসব বিকৃত তথ্য দিয়ে খুশি রাখা হয়। সরকারের সংস্থাগুলো কৃষি বিষয়ে যে তথ্য দিচ্ছে সেগুলো মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।

 

কৃষিপণ্যের অতিরঞ্জিত তথ্য বন্ধ করতে প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। আবার দেশে উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া হলেও বিপণনে নজর দেওয়া হচ্ছে না। ফলে কৃষক তার ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। তাই উৎপাদনের তথ্য যেমন সঠিক রাখতে হবে তেমনি কৃষকের পণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

Leave A Comment

To Top