দুর্যোগে বছরে ক্ষতি ৩০০ কোটি ডলার

November 15, 2025 0 Comments

 

 

সাহানোয়ার সাইদ শাহীন :

চরম বন্যা, খরা, ঝড় ও তাপপ্রবাহে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৩০০ কোটি ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার সমান ১২০ টাকা) হিসাব করলে তা প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। দুর্যোগে প্রতিবছর গড়ে ৬৩ লাখ ৫৮ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। দুর্যোগে আক্রান্ত ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হিসাবের জন্য ১৯৯৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নানা দুর্যোগের তথ্য বিশ্লেষণ করা হযেছে।

 

বন্যা, ঝড় ও তাপপ্রবাহের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ৩১তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
পরিবেশবিষয়ক সংস্থা জার্মানওয়াচের ‘ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী এই প্রতিবেদন একযোগে প্রকাশিত হয়েছে। চলতি বছর ১৭৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৪৬তম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

 

প্রতি লাখে ৪৭৯ জন মানুষ দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। গত ৩০ বছরে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলো চরম আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলোতে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কার্যকর অভিযোজন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দুর্যোগজনিত মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৯৩ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ৯ হাজার ৪০০টির বেশি চরম আবহাওয়া সংক্রান্ত দুর্যোগে প্রায় আট লাখ মানুষ প্রাণ হারায়।

 

সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৪.২ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। ২০২২ সালের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত একটি তীব্র তাপপ্রবাহ পাকিস্তানের নবাবশাহ শহরে ৪৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল। এই চরম তাপপ্রবাহ ভারত ও বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে তিন দেশে ৯০ জনের বেশি মানুষ মারা যায়। জলবায়ু পরিবর্তনে এই ধরনের তাপপ্রবাহের আশঙ্কা ৩০ গুণ বেড়েছে।

 

চরম আবহাওয়ার কারণে কিছু দেশে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ তাদের মোট জিডিপির চেয়েও বেশি। জলবায়ু ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন, যাতে মানবিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি কমানো যায়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান অব বাংলাদেশ (২০২৩-২০৫০)’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, কয়েক দশকের ব্যবধানে দেশে খরাপ্রবণতা বেড়েছে।
খরাপ্রবণ জেলাগুলোতে কৃষিজমির পরিমাণ প্রায় ৫৫ লাখ হেক্টর। এসব জমির মধ্যে খরায় ক্ষতির শিকার হচ্ছে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৩৫ লাখ হেক্টর।

 

শুধু খরার কারণে বছরে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কমে গেছে। খরায় ক্ষতির কবলে পড়ছে কৃষকের ফসল। আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশে জলবায়ু ক্ষতির শীর্ষে যে ১০টি ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে শীর্ষে থাকবে লবণাক্ততা। উপকূলীয় এলাকার ১৯ জেলায় মোট আবাদি জমির পরিমাণ ২৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর।

 

এর মধ্যে চাষযোগ্য জমি ২১ লাখ ৬২ হাজার হেক্টর। কিন্তু এ অঞ্চলে বিভিন্ন মাত্রায় লবণে আক্রান্ত জমি ১০ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর, অর্থাৎ আবাদি জমির প্রায় ৩৭ শতাংশ জমি এখন লবণে আক্রান্ত। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

 

এ বিষয়ে জার্মানওয়াচের আন্তর্জাতিক জলবায়ু নীতি বিভাগের প্রধান লরা শেফার জানিয়েছেন, জলবায়ু সংকট একটি বৈশ্বিক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পরিণত হচ্ছে, যা বহুপক্ষীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে মোকাবেলা করা প্রয়োজন। এখন বৈশ্বিক ক্ষতি জার্মানির মোট জিডিপির সমান। তাই জলবায়ু মোকাবেলায় কর্মসূচি বাস্তবায়নে দেরি করলে আরো বড় অর্থনৈতিক ও মানবিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর জন্য বেশি অর্থায়ন প্রয়োজন।

 

ব্রাজিলে আসন্ন জলবায়ু সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য অতিরিক্ত জলবায়ুু অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত বলে মনে করেন জার্মানওয়াচের অভিযোজন ও ক্ষয়ক্ষতি বিষয়ক নীতি উপদেষ্টা লিনা আদিল।

 

উল্লেখ্য, জার্মানওয়াচ একটি স্বাধীন উন্নয়ন, পরিবেশ ও মানবাধিকারবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা এবং থিংকট্যাংক। ১৯৯১ সাল থেকে সংস্থাটি সামাজিক ন্যায়বিচার, প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি টেকসই বৈশ্বিক উন্নয়নের পক্ষে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
জার্মানওয়াচ ২০০৬ সাল থেকে ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স প্রকাশ করে আসছে, যেখানে চরম আবহাওয়া সম্পর্কিত দুর্যোগের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বিশ্লেষণ করা হয়।

 

চলতি বছর থেকে ইনডেক্সের পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করেছে এবং এখন এটি আন্তর্জাতিক দুর্যোগ ডেটাবেইস থেকে চরম আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সামাজিক-অর্থনৈতিক তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হচ্ছে।

Leave A Comment

To Top