জনপ্রতি কৃষিজমির পরিমাণ কমছেই

July 9, 2024 0 Comments
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি উপকূলীয় জেলায় একসময় প্রচুর কৃষিজমি ছিল। এর মধ্যে সাতক্ষীরা রয়েছে। কিন্তু গত চার দশকে এই জেলায় ৬০ হাজার হেক্টর চাষযোগ্য জমি কমেছে। তিন ফসলি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি ঘের করেছেন চাষিরা। এতে আশপাশের জমিরও উর্বরতা কমেছে। দিন দিন কমছে ফসল উৎপাদন। সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান শাকিল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি তাঁর ২০০ বিঘা জমিতে চিংড়ি ঘের করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে চিংড়ির চাষ করছেন। অথচ এই জমিতে আগে প্রচুর ধানের আবাদ হতো। শাকিল হোসেন বলেন, এই অঞ্চলের জমিতে লবণাক্ততা বাড়ায় শস্য আবাদ করা যাচ্ছে না। এখানকার ৯৫ শতাংশ জমিতে চিংড়ির চাষ হচ্ছে। কিন্তু এতেও ভালো নেই খামারিরা। কৃষিজমি আবাদের জন্য ভালো জাত ও বীজ পেলে অনেক খামারি কৃষিতে ফিরে যেতে চাইবেন। এভাবে দেশের কৃষিজমি চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে। আরো যেসব কারণে কৃষিজমি অন্য খাতে চলে যাচ্ছে, এর মধ্যে রয়েছে নতুন বসতভিটা স্থাপন, অবকাঠামো নির্মাণ, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে পেশার পরিবর্তন, মানবসৃষ্ট কারণে নদীভাঙন, রাস্তাঘাট ও ইটভাটা নির্মাণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্প-কারখানা স্থাপন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কৃষিশুমারির তথ্য মতে, গত এক দশকে গড়ে প্রতিবছর কৃষিজমি কমছে ০.২১ শতাংশ। দেশের কৃষিজমি যেমন অন্য খাতে যাচ্ছে, কৃষির ওপর নির্ভরশীল পরিবারও বাড়ছে। এতে জনপ্রতি কৃষিজমির প্রাপ্যতা কমছে। দেশের একজন মানুষের এখন কৃষিজমি মাত্র ১০ শতাংশ, যদিও দেশের ৫৩ শতাংশ পরিবার এখন কৃষিনির্ভর। গত এক দশকে কৃষিনির্ভর পরিবার থেকে জমি কমে গেছে প্রায় পাঁচ লাখ ৩০ হাজার একর। কৃষিজমির বিভিন্ন রূপান্তর ও দেশে জনপ্রতি কৃষিজমির পরিমাণ নিয়ে গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের পরিচালক অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম। তাঁর গবেষণায় কৃষিশুমারির তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রতিবছর গড়ে মোট জমির ০.২১ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমেছে। অন্যদিকে ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত পর্যন্ত জমি কমেছে ০.৭৪ শতাংশ হারে। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৬ এই সময়ে প্রতিবছর কৃষিজমি কমেছে ০.৯৭ শতাংশ হারে। অর্থাৎ এই সময়ে দেশের কৃষিজমি প্রায় ১ শতাংশ হারে কমে গেছে। তবে গত কয়েক দশকের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশি কৃষিজমি কমেছে উপকূলের বিভিন্ন জেলায়। ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত দেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলার ১৬টিতেই কৃষিজমি কমেছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সামগ্রিকভাবে উপকূলে প্রায় ৬ শতাংশ কৃষিজমি কমে গেছে। গত কয়েক দশক ধরে সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি বেসরকারি সংস্থায় উপকূলের মানুষ ও প্রাণ প্রকৃতি নিয়ে কাজ করছেন পাভেল পার্থ। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, মানব সৃষ্ট কারণের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলে কৃষিজমি কমছে। একইভাবে বরেন্দ্র ও হাওর বা পাহাড়ি অঞ্চলে কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে। গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থাকে কৃষি থেকে জোর করে চিংড়ি উৎপাদনের দিকে ঠেলে দেওয়ায় উপকূলের মানুষ কৃষি কাজের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শস্য উৎপাদন কমছে। উপকূলের যেসব জেলায় খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকত, সেগুলোতে এখন খাদ্য ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। চিংড়ি ঘেরের সুবিধা পাচ্ছে হাতে গোনা কিছু ধনী ব্যক্তি। এতে আঞ্চলিক বৈষম্য বাড়ছে। কৃষিনির্ভর খানা বাড়ছে বিবিএসের কৃষিশুমারির তথ্যমতে, দেশে মোট খানার পরিমাণ তিন কোটি ৫৫ লাখ ৫২ হাজার। এর মধ্যে কৃষি খানার পরিমাণ এখন এক কোটি ৬৮ লাখ ৮১ হাজার। অর্থাৎ দেশের প্রায় ৫২.৫৫ শতাংশ পরিবার কৃষিতে নিয়োজিত। গত কৃষি জরিপের চেয়ে এবার কৃষি খানা বেড়েছে ১৬ লাখ ৯৮ হাজারটি। ফলে দেশে কৃষিনির্ভর পরিবার বাড়ছে; কিন্তু জনপ্রতি জমি কমছে। কী পরিমাণ জমি হারাচ্ছেন কৃষক বিবিএসের তথ্য বলছে, কৃষি পরিবারগুলোর পরিচালনাধীন মোট জমির (আবাদি ও নন-আবাদি) পরিমাণ দুই কোটি ২৯ লাখ ৭৫ হাজার একর, যা ২০০৮ সালের ছিল দুই কোটি ৩৫ লাখ পাঁচ হাজার একর। এই সময়ের ব্যবধানে কৃষিনির্ভর পরিবারগুলোর পরিচালনাধীন মোট জমি কমেছে প্রায় পাঁচ লাখ ৩০ হাজার একর। আবার কৃষি খানা বা পরিবারগুলোর অধীন মোট আবাদি জমি রয়েছে এক কোটি ৮৬ লাখ ৮১ হাজার একর, যা ২০০৮ সালে ছিল এক কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার। এতে ১১ বছরে কৃষিজমি কমেছে চার লাখ ১৬ হাজার একর। প্রতিবছর আবাদি জমি কমেছে প্রায় ৩৭ হাজার ৮১৮ একর করে। কৃষিজমিসহ আনান্য জমি চলে যাচ্ছে কৃষিবহির্ভূত লোকজনের হাতে। এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, কৃষিজমি অপ্রয়োজনে বা অপরিকল্পিতভাবে অকৃষি খাতে চলে যাওয়াটা অশনিসংকেত। উত্তরের বেশ কিছু জেলার কৃষিজমিতে ইটভাটা ও অন্যান্য স্থাপনা হচ্ছে। কৃষিজমি যাতে অপরিকল্পিকভাবে অন্য খাতে না যায়, সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কাজ করছে। কৃষিজমি রক্ষা করতে কৃষি মন্ত্রণালয় সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। কৃষিজমি রক্ষা করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, বৈশ্বিক জমির মাত্র ০.১ শতাংশ দখলে রয়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু বৈশ্বিক জনসংখ্যার প্রায় ২.৭ শতাংশ বাংলাদেশের। ফলে মাথাপিছু জমিতে যেমন পিছিয়ে রয়েছে, তেমনি জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে রয়েছে এগিয়ে। এ জন্য আগামীতে স্বল্প জমিতে অধিক ও বহুমুখী ফসল উৎপাদন করতে হবে। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কৃষিজমি রক্ষা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরিকল্পিত ব্যবহার অব্যাহত থাকলে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ২০৪১ সাল নাগাদ ছয় শতকে নেমে আসার শঙ্কা রয়েছে। আইন তৈরি এবং আইনের প্রয়োগ করা না গেলে কৃষিজমি কমতেই থাকবে।

Leave A Comment

To Top