কৃষকের সবচেয়ে কম আয় ধান-গমে

November 15, 2025 0 Comments

 

সাহানোয়ার সাইদ শাহীন :

দেশের প্রায় ৭৪ শতাংশ জমিতে ধান চাষে উৎপাদন এখন প্রায় ছয় কোটি টন। কিন্তু ধান চাষে কৃষকের মুনাফা খুবই সীমিত। শীর্ষ উৎপাদনকারী ১৩টি শস্যের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন মুনাফা ধান চাষে। সবচেয়ে কম মুনাফা গমে।

 

এই মূহূর্তে কৃষকদের সবচেয়ে বেশি মুনাফা দিচ্ছে ফল ও ফুলের আবাদ।
কৃষক কী পরিমাণ মুনাফা করছে তার ওপর গবেষণা করেছে আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইএফপিআরআই)। ‘ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন বাংলাদেশ : এভিডেন্স বেজড স্ট্র্যাটেজিস ফর অ্যাডভান্সমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি আজ শনিবার প্রকাশ করা হবে।

 

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ছয় ধরনের ফসল আবাদে কৃষকের মুনাফা লাখ টাকার ওপরে থাকে।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুনাফা ফল চাষে। প্রতি হেক্টর জমিতে ফল চাষে কৃষকের মুনাফা থাকে দুই লাখ ৮১ হাজার ৮৬৯ টাকা। অন্যদিকে ফুল চাষে এক লাখ ৯১ হাজার ৮৭১ টাকা, সবজিতে এক লাখ ৪৬ হাজার ৫৫৪ টাকা। আখ চাষে এক লাখ ৪০ হাজার ৯১০ টাকা, পেঁয়াজ চাষে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৫৯ টাকা, মরিচ চাষে এক লাখ ৯ হাজার ৭৫ টাকা।
অন্যদিকে ভুট্টায় ৬০ হাজার ৬২৪, পাট আবাদে ৬০ হাজার ৪০৬, আলুতে ৫৬ হাজার ৬১৩, সরিষায় ৫৩ হাজার ৬৫৬, মসুর ডাল চাষে ৩৪ হাজার ৪৬৭ টাকা।

 

সবচেয়ে কম মুনাফা প্রদানকারী ধান আবাদে কৃষকের মুনাফা থাকে ২৯ হাজার ৩৮৫ ও গমে ১৮ হাজার ৭৯১ টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ধান চাষে কৃষি উপকরণ খরচ বিশেষ করে সেচ, সার, চাষ, শ্রমিক ও অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ায় ধান আবাদে উৎপাদন খরচ প্রতিবছর বাড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় ধানের দাম না বাড়ায় কৃষক ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে অনেক বছর ফলন কম পাচ্ছেন কৃষক।

 

এতে ধান চাষিরা মুনাফা বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যদিকে শীত কমে যাওয়ার পাশাপাশি আবহাওয়াগত পরিবর্তনে গমের ফলন কমছে। অধিক মাত্রায় শীতনির্ভর এই ফসলটি প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবের কারণে কৃষককে লোকসানি করে তুলছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে শস্যের দামের সমন্বয় করলে মুনাফার পরিমাণ আরো কমবে।
কৃষক যদি সঠিক দাম না পায় কিংবা ভর্তুকির অর্থের সুবিধা দিয়ে উৎপাদন খরচ কমাতে না পারে, তাহলে শস্য আবাদে কৃষক নিরুৎসাহিত হতে পারে। কৃষি থেকে সে নিরুৎসাহিত হয়ে আবাদ কমিয়ে অন্য পেশায় চলে যেতে পারে।

 

যার প্রভাব পড়বে সার্বিক কৃষিপণ্যের উৎপাদনে। এতে খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে। তাই কৃষকের ন্যায্যদাম নিশ্চিতে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের অর্থ সহায়তায় বাজার ব্যবস্থাপনা, মজুদাগার, শিল্পে ব্যবহার বাড়ানো ও সাধারণ কৃষকের উন্নয়নে ব্যয় করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।

 

এ বিষয়ে আইএফপিআরআইয়ের কান্ট্রি পরিচালক ড. আখতার আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কৃষকের শস্য আবাদ কী পরিমাণ মুনাফা দিচ্ছে, সেটি জানতে আমরা একটি স্বাভাবিক অর্থবছরের কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর তথ্য বিশ্লেষণ করেছি। গবেষণাটি তথ্য ও উপাত্তভিত্তিক বিধায় এটি নীতিকাঠামো তৈরিতে সহায়ক হবে।’

 

তিনি বলেন, কৃষকের মুনাফা করতে না পারার পেছনে অন্যতম কারণই হলো ফসলের দাম না পাওয়া। ফলন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হওয়া বা বাজার ব্যবস্থাপনায় নানা ঝুঁকি থাকায়ও মুনাফা বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষক। লাভবান করতে হলে অবশ্যই বাজারে চাহিদা সৃষ্টির মাধ্যমে কৃষককে ন্যায্যদাম দিতে হবে। কৃষকদের যান্ত্রিকীকরণ সুবিধা ও উচ্চ ফলনশীল জাত দেওয়ার মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে হবে। কৃষিতে উচ্চ ফলনশীল জাত সম্প্রসারণে কৃষি খাতের গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এ ছাড়া কৃষকের শ্রম খরচ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।

 

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক খাদ্য ও নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের যৌথ আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভারত, চীন ও বাংলাদেশের কৃষকদের মধ্যে বাংলাদেশের ধান চাষিরা সবচেয় কম দাম পান।

 

ইন্টারন্যাশনাল ক্রপস রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর দ্য সেমি-অ্যারিড ট্রপিকসের (আইসিআরআইএএসটি) গবেষণায় দেখা গেছে, এক হেক্টর জমিতে সেচ দিতে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশকে তিন গুণ বেশি করচ করতে হয়। এক হেক্টর জমিতে সারের জন্য ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের কৃষকদের প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি খরচ করতে হয়। অন্যদিকে মেশিন ভাড়া ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে চার গুণ বেশি। সব মিলিয়ে সার, সেচ, মেশিনের খরচ ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের কৃষকদের ২৭১ শতাংশ বেশি দিতে হচ্ছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষুদ্র আয়তনের জমি ও প্রযুক্তির অভাব মোকাবেলা করেই উৎপাদন করতে হচ্ছে কৃষকদের। পাশাপাশি রয়েছে কৃষকদের জ্ঞানের স্বল্পতা আর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিও। ফসলোত্তর ক্ষতি, আবাদে আঞ্চলিক বৈষম্য, উপকরণের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় শস্য আবাদে কৃষকের পক্ষে ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে সরকারের দেওয়া বিভিন্ন ধরনের ভর্তুকির স্বাভাবিকভাবে সঠিক মাত্রায় কার্যকর হচ্ছে না।

Leave A Comment

To Top